কিভাবে লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরি হয়?
লিথিয়াম ব্যাটারি ইলেকট্রনিক্স জগতের উন্নয়নে একটি বিপ্লব সাধন করেছে। এর জনপ্রিয়তা বাসাবাড়ি ভিত্তিক ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিক যানবাহন এবং এমনকি সামরিক এবং মহাকাশ অ্যাপ্লিকেশনগুলিতে দেখা যায়। লিথিয়াম ব্যাটারি বড় লিড এসিড ব্যাটারির একটি সফল বিকল্প ব্যবস্থা যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ছিলো। লিথিয়াম ব্যাটারি এর পিছনের ধারণাটি খুব সহজ মনে হলেও এটির উন্নয়ন প্রকল্পে কয়েক দশক ধরে গবেষণা করার প্রয়োজন হয়েছিলো। বর্তমানে সিলিন্ডার আকৃতির প্রায় সকল ছোট বড় ব্যাটারিই লিথিয়াম আয়ন প্রযুক্তিতে তৈরি করা হয়।
লিথিয়াম ব্যাটারির উৎপাদন প্রক্রিয়া (Manufacturing Process of Lithium batteries):-
লিথিয়াম ব্যাটারির এনোড এবং ক্যাথোড এর কার্যনীতি একই, এবং এগুলো একটি বিদ্যুৎ সংগ্রহকারী এবং সেলের ভিতরে ও বাহিরে পরিবহণকারী হিসেবে কাজ করে থাকে। এ্যানোড সাধারণত কার্বণ জাতীয় পদার্থ দ্বারা গঠিত হয় এবং ক্যাথোড লিথিয়াম মেটাল অক্সাইড দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে। এই কার্বণকে কালো পাউডার আকৃতিতে সরবরাহ করা হয় এবং অত্যান্ত সতর্কতার সাথে তা সংরক্ষণ করা হয়।
এরপর এগুলোকে মেটাল ইলেকট্রিক ফয়েলের রিলের মধ্যে রাখা হয়। এই ফয়েল প্রায় ৫০০ পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এখানে এ্যানোড হিসেবে তামা এবং ক্যাথোড হিসেবে এ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করা হয় যা খুব সাবধানে প্রলেপ দেওয়ার মেশিনের সাহায্যে করা হয়ে থাকে। একটি রোলার মেশিনের সাহয্যে ফয়েলগুলোকে সাবধানে রিলের উপর প্রলেপ আকারে দেওয়া হয়ে থাকে।রিলের উপর এই এ্যানোড এবং ক্যাথোডের প্রলেপের পুরুত্ব মুলত ব্যাটারির ক্যাপাসিটি, বিদ্যুৎ প্রবাহের পরিমাণ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়। এই রিলের প্রলেপ দেওয়া মেশিনটির মাধ্যেমে রিলের উপর প্রলেপ দেওয়া হয় এবং তা উচ্চ তাপমাত্রায় তা শুকানো হয় এবং পুনঃরায় তা রিল করা হয়। এরপর এই রিলগুলোকে প্রয়োজন অনুযায়ী কিংবা নির্দিষ্ট মাপ অনুযায়ী কেটে নেওয়া হয়।
সেল এসেম্বলি (The Cell Assembly):-
বড় বড় এবং নামকরা উৎপাদনকারী কোম্পানীগুলো সেল এসেম্বলি করার জন্য স্বয়ংক্রিয় মেশিন ব্যবহার করে থাকে, কিন্তু ছোট খাটো কোম্পানীগুলো ম্যানুয়ালী এসেম্বলি করে থাকে। প্রথম ধাপে এ্যানোড এবং ক্যাথোড এর মাঝখানে একটি সেপারেটরকে বসানো হয় বা জড়ানো হয়। এর কারণ হল এ্যানোড এবং ক্যাথোড যাতে সরাসরি সংস্পর্শে এসে সর্ট সার্কিট সংগঠিত না করে। সেল কেসিং এর উপর নির্ভর করে দুই ধরণের সেল কাঠামো হয়ে থাকে। চ্যাপ্টা আকৃতির ব্যাটারির জন্য সেলকেও চ্যাপ্টা বা চতুষ্কোণ আকৃতির করা হয়। অন্যদিকে সিলিন্ডার আকৃতির বা পেন্সিল ব্যাটারি আকৃতির ব্যাটারির ক্ষেত্রে সেলকেও অনুরূপ গোল করে জালি আকৃতিতে পেচানো হয়।
প্রিজম আকৃতির সেল (Prismatic cells):- এই ধরণের সেল সাধারণত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যাটারিতে ব্যবহৃত হয়। এখানে এ্যানোড এবং ক্যাথোড দুটোকে লেড এসিড ব্যাটারির মত প্লেট আকৃতিতে আলাদাভাবে সেপারেটর দ্বারা বসানো হয়ে থাকে। এটা দেখতে গেলে অনেকটা লেড এসিড ব্যাটরির মতই তবে এর ভিতরে কোন এসিড থাকে না। মজার ব্যাপার হল এই সেলের ব্যবহার কিন্তু আমরা সবাই করে থাকি। আমাদের হাতে যে স্মার্টফোন বা মোবাইল ফোন আছে তাতে এই সেল ব্যবহৃত হয়। আপনার মোবাইল ফোনটির ব্যাটারি হাতে নিয়ে দেখবেন সেখানে লিখা আছে Li-ion Battery. আর এটি হল লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির সংক্ষিপ্ত প্রকাশ রূপ। এছাড়াও আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নানান ছোট বড় ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশে এই ব্যাটারি ব্যবহার করে থাকি।
সিলিন্ডার আকৃতির সেল (Cylindrical cells):- এই প্রকৃয়ায় ব্যাটারি দেখতে সিলিন্ডারের মত। বলতে গেলে আমরা ঘড়ি কিংবা রিমোটে কিংবা খেলনা গাড়িতে যে পেন্সিল ব্যাটারি ব্যবহার করে থাকি দেখতে হুবহু ওরকমই। এর মধ্যে সেলকে রোল আকারে গোল করে পেচানো হয় এবং উক্ত রোল এর মাঝখানে সর্ট সাকিংট প্রতিহত করার জন্য একটি সেপারেটর ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এবং দুই প্রান্তে এ্যানোড এবং ক্যাথোড আলাদা ভাবে আউটপুট নেওয়া হয়। সাধারণত আমরা ডিজিটাল ক্যামেরা, হাই পাওয়ার টর্চ লাইট ইত্যাদিতে এই ধরণের সিলিন্ডার আকৃতির ব্যাটারি ব্যবহার করে থাকি। মজার ব্যাপার আপনি যে ল্যাপটপ বা নোটবুকটি ব্যবহার করেন তার ব্যাটারিও কিন্তু এই সিলিন্ডার আকৃতির লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি। আবার আপনার মোবাইল ফোনটি চার্জ করার জন্য যদি পাওয়ার ব্যাংক ব্যবহার করে থাকেন তবে সেখানেও এই ধরণের ব্যাটারি খুঁজে পাবেন।
একবার কল্পনা করুন এই ব্যাটারি যদি আবিষ্কৃত না হত তাহলে আমাদেরকে হয়তো এসিড ব্যাটারি ব্যবহার করতে হত। আর আমাদের ব্যবহৃত স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ক্যামেরা কিংবা অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসে এধরণের এসিড ব্যাটারি ব্যবহারের ফলে যখন তখন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো যা একবারেই অনিরাপদ। অন্যদিকে আপনি যদি নিরাপত্তার খাতিরে ড্রাইসেলকে বেছে নেন তাহলে ড্রাইসেল একবার এর বেশি ব্যবহার করা যায় না এবং এটিকে পুনরায় চার্জও করা যায় না। ফলে চার্জ শেষ হলে বার বার নতুন ব্যাটারি লাগাতে হত। এটাও কিন্তু আমাদের জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে পড়তো। কিন্তু একদিকে এই লিথিয়াম ব্যাটারি আমাদেরকে দিচ্ছে ব্যবহারের নিরাপত্তা। অন্যদিকে বার বার চার্জ করে ব্যবহার করার সুবিধার ফলে আমাদের ব্যায় অনেক কমেছে। তাছাড়া এই ধরণের ব্যাটারি অনেক দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। তাই আমরা এক কথায় বলতে পারি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এক অভূতপূর্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে যা ছাড়া যেন আমাদের কার্যক্রম অচল হয়ে পড়বে।
বিভিন্ন ধরণের ব্যাটারি, তার গঠন ও ব্যবহার ক্ষেত্র সম্পর্কে জানতে এখানে ক্লিক করুন।



0 মন্তব্যসমূহ