মহাবিশ্বের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বৈশিষ্ট


মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট এবং এর কোন শুরু আছে কি নেই - এসব নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আগে জানা দরকার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কাকে বলে। সোজা কথায় বললে, থিওরি বা তত্ত্ব হচ্ছে মাহবিশ্বের একটি মডেল বা নমুনা, অথবা সেই নমুনার কোন সীমিত অংশবিশেষ এবং এমন একগুচ্ছ নিয়ম বা সূত্র, যে সূত্রগুলো পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত তথ্যকে মডেলের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে পারবে। এই তত্ত্ব থাকে আমাদের মস্তিষ্কে এবং এর অন্যরকম কোন বাস্তবতা নেই (বাস্তবতার সংজ্ঞা য হয় হোক)। একটি তত্ত্বকে ভালো বলা হয়, যদি এর মধ্যে দুটো গুণ পাওয়া যায়। এক, অনেকগুলো পর্যবেক্ষণকে একটি অল্প কথায় সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে। দুই, একে ভবিষ্যৎ পর্যবেক্ষণের ফলাফল সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দিতে হবে। অ্যারিস্টটল িএমপেডোক্লেসের এই তত্ত্ব মেনে নিয়েছিলেন যে জগতের সব কিছু মাটি, বায়ু, আগুন ও পানি এই চারটি উপাদান দিয়ে তৈরি। তত্ত্বটি যথেষ্ট সরল ছিলো, কিন্তু এটি কোন সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দিতে পারেনি। অন্যদিকে, নিউটনের মাহকর্ষ তত্ত্বটি উপস্থাপন করা হয় আরো সরলভাবে। এই তত্ত্বে বস্তুরা এক অপরকে তাদের ভরের সমানুপাতিক ও তাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক বলে আকর্ষণ করে। তত্ত্বটি দেখতে সরল হলেও এটি অনেক নিখুঁতভাবে সূর্য, চন্দ্র এবং গ্রহদের গতির পূর্বাভাস দিতে পারে। 

যেকোন ভৌত তত্ত্বই এই অর্থে অস্থায়ী যে এটি শুধুই একটি অনুমান। একে কখনোই পুরোপুরি প্রমাণ করা যাবে না। পরীক্ষার ফলাফলের সাথে হাজারবার মিলে গেলেও আপনি কখনই নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না এটি পরের বার বিপরীত ফলাফল দেবে না। উল্টো দিকে একটি তত্ত্বকে ভূল বলার জন্য এর বিপক্ষে একটিমাত্র পর্যবেক্ষণই যথেষ্টে। বিজ্ঞানের দার্শনিক কার্ল পপার যেমন জোর দিয়ে বলেছেন, একটি ভালো তত্ত্বের বৈশিষ্ট হচ্ছে, এত এম অনেকগুলো পূর্বাভাস থাকবে যাদেরকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ভূল বা মিথ্যা প্রমাণ করার সুযোগ থাকবে। যখনই নতুন কোন পরীক্ষার সাথে এর পূর্বাভাস মিলে যাবে, তত্ত্বটি বেঁচে যাবে। কিন্তু কখনো নতুন কোন পর্যবেক্ষণ এর সাথে না মিললে আমাদেরকে তত্ত্বটি পরিত্যাগ বা সংস্কার করতে হবে। 

এটাই হচ্ছে সাধারণ নীতি। কিন্তু যিনি পরীক্ষা চালিয়েছেন তাঁর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তো তোলা যেতেই পারে। 

বাস্তবে দেখা যায় নতুন তত্ত্ব আসলে আগের তত্ত্বেরই পরিবর্ধন মাত্র। উধাহরণ হিসেবে বলা যায় বুধ গ্রহের গতির কথা। নিউটরের মহাকর্ষ তত্ত্বের পূর্বাভাসের সাথে এর গতির সামান্য ভিন্নতা দেখা যায়। আইনস্টাইনের সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব নিউটনের তত্ত্বের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন অনুমান প্রদান করে, যা পর্যবেক্ষণের সাথে ঠিক ঠিক মিলে যায়। নিউটনের তত্ত্বের জায়গায় নতুন এই তত্ত্বের জায়গা করে নিতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবুও এখনও আমরা বাস্তবে নিউটনের তত্ত্বই বেশি ব্যবহার করি, কারণ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দুটো থিওরির পার্থক্য সমান। নিউটনের তত্ত্বের আরেকটি সুবিধা হল এটি আইনস্টাইনের সূত্রের চেয়ে অনেক সরল। 

বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটি তত্ত্ব প্রদান করা, যা সমগ্র মাহবিশ্বকে ব্যাখ্যা করতে পারবে। অবশ্য অধিকাংশ বিজ্ঞানীই বাস্তবে সমস্যাটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে কাজ করেন। প্রথমত, কিছু সূত্র আমাদেরকে বলছে যে সময়ের সাথে সাথে মাহবিশ্বের কীরূপ পরিবর্তন ঘটছে। (আমরা যদি কোন একটি সময়ে মাহবিশ্বের অবস্থা জানি, এই ভৌত সূত্রগুলো আমাদের বলবে পরবর্তী কোন সময়ে মহাবিশ্ব কী অবস্থায় থাকবে। ) দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো মহাবিশ্বের আদি অবস্থা নিয়ে কাজ করা। তাঁদের মতে, মহাবিশ্বের আদি অবস্থার বিষয়টি অধিবিদ্যা বা ধর্মের আলোচ্য বিষয়। তাঁদের মতে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর মহাবিশ্বের সূচনা নিজের যেভাবে েইচ্ছা সেভাবেই করেছেন। তা হলেও হতেও পারে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ঈশ্বর মহাবিশ্বকে কোন অনির্দিষ্ট প্রক্রিয়াতেই বিবর্তিত হতে দিতেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তিনি একে কিছু নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন করেছেন, যা কিছু সূত্র মেনে চলছে। কাজেই মাহবিশ্বের আদি অবস্থাও কিছু নিয়ম মেনে চলছিল মনে করাটাই যুক্তির দাবি। 

মহাবিশ্বের সব কিছুকে একই তত্ত্বে গেঁথে ফেলা কঠিন একটি কাজ। ফলে আমরা একে ভেঙে অনেকগুলো আংশিক তত্ত্ব তৈরি করি। এই আংশিক তত্ত্বদের প্রতিটি কিছু নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণের ব্যাখ্যা ও পূর্বাভাস দিতে পারে। এর আওতায় বাইরের বিষয়গুলো সম্পর্কে এটি নীরব থাকে অথবা তাদেরকে কিছু সংখ্যা দ্বার প্রকাশ করে। খুব সম্ভব, এটি একটি ভূল পদ্ধতি। যদি মৌলিক জায়গাটিতে মাহবিশ্বের সব কিছু অন্য সব কিছুর ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে এদেরকে আংশিকভাবে মূল্যায়ন করে পূর্ণাঙ্গ সমাধানে পৌঁছা সম্ভব নাও হতে পারে। তবুও আমরা অতীতে কিন্তু এটাই করে এসেছি। উধাহরণ হিসেবে আবারও বলব নিউটরের মহাকর্ষ তত্ত্বের কথা। এটি বলছে, দুটো বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল মহাকর্ষ বল বস্তুদ্বয়ের একটিমাত্র নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ওপর (ভর) নির্ভরশীল। বস্তু কি দিয়ে তৈরি তার উপর এই বল নির্ভর করে না কাজেই গ্রহদের কক্ষপথের হিসাব বের করার জন্য এদের এবং সূর্যের গঠন ও উপাদানের জন্য আমাদের আলাদা কোন তত্ত্বের প্রয়োজন নেই । 

বর্তমান মহাবিশ্বের ব্যাখ্যায় বিজ্ঞানীরা দুটি মৌলিক আংশিক তত্ত্ব কাজে লাগাচ্ছেন। এরা হলো জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এই দুটি তত্ত্ব বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের বুদ্ধির জগতের এক বিরাট অর্জন। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব মাহকর্ষ বল ও মহাবিশ্বের বড় দৈর্ঘ্যের কাঠামোকে (Large scale structure) ব্যাখ্যা করে। মাত্র কয়েক মাইল থেকে শুরু করে অন্তত এক হাজার কোটি কোটি কোটি (১ এর পরে ২৪ টি শূন্য) মাইল তথা পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের আকারের সমপরিমাণ অংশ এই তত্ত্বের আওতায় আছে। অন্যদিকে কোয়ান্টাম মেকানিক্স কাজ করে এক ইঞ্চির এক লক্ষ কোটি ভাগের এক ভাগের মতো অত্যন্ত ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যের জগতে। এই  ‍দুটি তত্ত্ব আবার একে অপরের বিরোধী - এদের দুটোই যে ঠিক হবে সেটি সম্ভব নয়। বর্তমানে পদার্থবিদ্যার একটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নতুন একটি তত্ত্ব প্রদান করা, যা এই দুটো তত্ত্বকে একীভূত করে কোয়ান্টাম গ্রাভিটি নামে কমন একটি তত্ত্বের জন্ম দেবে।  আমরা এখনও এমন তত্ত্ব প্রস্তুত করতে পরিনি। হতে পারে, আমরা এখনও এর থেকে বহু দূরে আছি। কিন্তু এই তত্ত্বের কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত তার অনেকগুলোই আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি। 



চিত্রঃ পরমাণু থেকে মহাবিশ্ব


[বিংশ শতকের প্রথমার্ধ] পর্যন্ত নিউটনীয় পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো কাজ করত শুধু দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রগুলোতে। এরপরে এসে পদার্থবিদ্যার পরিধি বিস্তৃত হয়ে পৌঁছায় মাহবিশ্বের ক্ষুদ্রতম থেকে বৃহত্তম চৌহদ্দি পর্যন্ত।]

এখন আমরা যদি বিশ্বাস করি যে মহাবিশ্ব এলোমেলোভাবে নয় বরং চলছে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে, তহলে এই আংশিক সূত্রগুলো অবশ্যই একটি পূর্ণাঙ্গ একীভূত তত্ত্বে রূপদান করতে হবে, য ব্যাখ্যা দেবে মহাবিশ্বের সব কিছুর। কিন্তু  এ রকম একটি একীভূত তত্ত্বের সন্ধানে নামলে একটি সঙ্কটের মুখে পড়তে হয়। ওপরে উল্লিখিত বিজ্ঞানের  এই চিন্তা - ভাবনাগুলোতেও ধরে নেওয়া হচ্ছে যে আমরা বুদ্ধিমান জীব, যারা স্বাধীনভাবে মহাবিশ্বকে দেখছি ও তা থেকে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। যদি এটা সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে আমরা উন্নতি করতে করতে একদিন মহাবিশ্বের কার্যকরী নিয়মগুলোর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারব বলে মনে করা খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, এমন কোন পূর্ণাঙ্গ একীভূত সূত্র যদি থাকেই তবে সেটি নির্ধারণ করবে যে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাব? সেটা তো আমাদের জন্য  এটাও নির্ধারণ করে রাখতে পারে যে আমরা ভূল সিদ্ধান্তে পৌঁছাব, তাই না? অথবা এমনও হতে পারে, এটি নির্ধারণ করে রাখবে যে আমরা কোন সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে পারব না।

এই সমস্যার জবাব দেওয়ার জন্যে আমাদের মাথায় ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের নীতি ছাড়া আর কিছু আসছে না। এই নীতি অনুসারে, স্বপ্রজননে সক্ষম প্রাণীদের নিজেদের মধ্যে জীনগত উপাদানও বেড়ে ওঠার মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকবে। এই পার্থক্যের কারণে এদের কেউ কেউ পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ও সেই অনুসারে কাজ করতে অন্যদের চেয়ে বেশি দক্ষ হয়ে উঠবে। অন্যদের চেয়ে এদের টিকে থাকা ও সংখ্যা বৃদ্ধির সম্ভাবনা হবে বেশি। ফলে এদের অাচরণ ও চিন্তাই হবে প্রভাবশালী। অতীতে এটাই সত্য হয়ে এসেছে এবং বুদ্ধিও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার টিকে থাকার ক্ষেত্রে একটি সুবিধা প্রদান করেছে। নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে এটাই এ ক্ষেত্রেও হচ্ছে। আমাদের বৈজ্ঞানীক আবিষ্কারগুলো আমাদের ধ্বংসের কারণও হয়ে যেতে পারে। আর যদি তা নাও হয়, একটি পূর্ণাঙ্গ একীভূত তত্ত্ব হয়তো আমাদের টিকে থাকার সম্ভাবনায় খুব বেশি পরিবর্তন আনবে না। অবশ্য মহাবিশ্ব যদি একটি নিয়ম মেনে তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আশা করতে পারি প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রাপ্ত আমাদের বুদ্ধি পূর্ণাঙ্গ একীভূত তত্ত্ব অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও আমাদের সহায় হবে, যাতে আমরা ভূল সিদ্ধান্তের দিকে চলে না যাই।

অতিরিক্ত চরম কিছু অবস্থার  কথা বাদ দিলে আমাদের বর্তমান আংশিক তত্ত্বগুলো সব ক্ষেত্রেই পূর্বাভাস দিতে সক্ষম। এ কারণে বাস্তব জগতের কতা ভাবলে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত তত্ত্বের সন্ধান করাকে  অযৌক্তিক মনে হয়। (উল্লেখ্য যে, একই রকম যুক্তি আপেক্ষিক তত্ত্ব ও কোয়ান্টম মেকানিক্সের বিপক্ষেও তোলা যেত, কিন্তু এই তত্ত্বগুলো আমাদের জন্য নিউক্লিয়ার শক্তি ও মাইক্রোইলেট্রনিক্স বিপ্লব সম্ভব করেছে) কাজেই একীভূত তত্ত্ব মানব প্রজাতিকে টিকে থাকার ব্যাপারে সাহায্য করবে - এমনটি বলা যাচ্ছে না। এটি হয়তো আমাদের লাইফস্টাইলে কোন প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু সভ্যতার শুরু থেকেই দেখা গেছে, মানুষ বিভিন্ন ঘটনাকে সম্পর্কহীন ও ব্যাখ্যাতীত মনে করে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। আমরা জগতের অন্তর্নিহিত রহস্য জানার জন্য অধীর থেকেছি। আজও আমরা জানতে উৎসুখ, আমরা কেন এখানে আছি এবং কোথা থেকেই বা এসেছি। গভীর জ্ঞান পিপাসাই আমাদের অবিরত অনুসন্ধান চালিয়ে যাবার পেছনে একটি যৌক্তিক কারণ। আমরা যে মহাবিশ্বে বাস করি তার একটি সম্পূর্ণ বিবরণ পাওয়ার চেয়ে ছোট নয় আমাদের উদ্দেশ্য।