মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণার ক্রমবিকাশ
ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সময়েও মানুষ খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যেত, যারা ভাবত পৃথিবী সমতল। এমনকি আজকের দিনেও এমন কিছু লোক খুঁজে পাওয়া যাবে। তবু আধুনিক জ্যেতির্বিদ্যার শুরু কিন্তু সেই গ্রিকদের আমলেই। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৩৪০ বছর আগে অ্যারিস্টটল On The Heavens (বাংলায় বলা চলে মহাকাশ প্রসঙ্গ) নামে েএকটি বই লিখেন। বইটিতে তিনি থালার মতো চ্যাপ্টা পৃথিবীর বদলে গোলক আকৃতির পৃথিবীর সপক্ষে কিছু ভালো যুক্তি তুলে ধরেন।
একটি যুক্তি ছিলো চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে। অ্যারিস্টটল বুঝতে পেরেছিলেন, পৃথিবী সূর্য ও চাঁদের মাঝে এসে পড়লে চন্দ্রগ্রহণ হয়। এ অবস্থায় চাঁদে পৃথিবীর ছায়া পড়ার কারণে গ্রহণটি ঘটে। অ্যারিস্টটল দেখলেন, পৃথিবীর ছায়া সব সময় গোল হয়ে পড়ে। পৃথিবী যদি চ্যাপ্টা চাকতির বদলে গোলকের মতো হয়, তবেই কেবল এমনটা সম্ভব। পৃথিবী যদি চাকতির মতো সমতল হতো, তবে গোল ছায়া শুধু তখনই পড়ত যখন সূর্য চাকতির ঠিক কেন্দ্র বরাবর থাকত। অন্য সময় ছায়া লম্বা হয়ে উপবৃত্তের মতো হয়ে যেত (একটি বৃত্তকে একদিকে টেনে লম্বা করে দিলে যে আকৃতি পাওয়া যায় সেটিই হলো উপবৃত্ত)।
পৃথিবীর আকৃতি গোলকীয় হবার পক্ষে গ্রিকদের আরকটি যুক্তি ছিলো। পৃথিবী যদি সমতল হতো, তবে দূর থেকে আসা কোন জাহাজকে দিগন্তের কাছে একটি ছোট্ট ও সাধারণ বিন্দু হিসেবে দেখা যেত। এরপর ক্রমেরই কাছে আসতে থাকলে এর আরো খুঁটিনাটি যেমন, পাল, কাঠামো ইত্যাদি দেখা যেত। কিন্তু বাস্তবে এমন হয় না। জাহাজ আসার সময় দিগন্তের দিকে তাকালে আমারা সবার আগে দেখি জাহাজের পাল। এর আরো অনেক্ষণ পরে চোখে পড়ে এর মূল কাঠামো। জাহাজের লম্বা মাস্তুল এর মূল কাঠামো থেকে অনেক উঁচুতে থাকায় সবার আগে একে দিগন্তে উঁকি দিতে দেখা যায়। এ থেকে প্রমাণ হয়, পৃথিবীর আকৃতি গোলকের মত (সমতল নয়)।
পৃথিবীর আকৃতি গেলকীয় হবার কারণ দিগন্ত থেকে আসা জাহাজের পাল ও মাস্তুল এর মূল কাঠামোর আগে চোখে পড়ে।
রাতের আকাশের ব্যাপারে গ্রিকরা দারুণ উৎসাহী ছিল। অ্যারিস্টটলের সময় থেকেই কয়েক শতক ধরে মানুষ রাতের আকাশের আলোগুলোর চলাচলের তথ্য লিখে রাখতো। তারা দেখলো, আকাশজুড়ে হাজার হাজার আলোর সবাই একই সাথে চললেও এদের পাঁচজন (চাঁদ বাদে) এই নিয়ম মানছে না। কখনো এরা নিয়মমাফিক পূর্ব-পশ্চিম পথে চলতে থাকে, কখনো আবার যেতে থাকে উল্টো দিকে। এই আলোগুলোর নাম দেওয়া হল প্লানেট বা গ্রহ। ইংরেজী প্ল্যানেট শব্দটি গ্রিক ভাষার যাযাবর বোঞাকে ব্যবহৃত হয়। গ্রিকদের চোখে শুধু পাঁচটি গ্রহই ধরা পড়েছিল, কারণ আমরা খালি চোখে বাকি গ্রহদের দেখতে পাই না। আমরা খালি চোখে দেখি বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিকে। বর্তমানে আমরা জানি, গ্রহরা কেন এই অদ্ভুত পথে চলে। আমাদের সৌরজগতের সাপেক্ষে নক্ষত্রদেরকে প্রায় স্থির বলা চলে, কিন্তু গ্রহরা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এ কারণে রাতের আকাশে গ্রহদের চলাচলের পথ দূরবর্তী নক্ষত্রদের তুলনায় অনেক জটিল।
অ্যারিস্টটল মনে করতেন, পৃথিবী স্থির এবং সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ এবং নক্ষত্ররা পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার পথে ঘুরছে। তাঁর এই বিশ্বাসের কারণ ছিল একটি অতিন্দ্রীয় যুক্তি। পৃথিবীর অবস্থান মাহবিশ্বের কেন্দ্র এবং বৃত্তাকার গতিই হচ্ছে সবচেয়ে নিখুঁত। দ্বিতীয় শতাব্দীতে আরেক গ্রিক পণ্ডিত টলেমি এই ধারণাকে একটি পরিপূর্ণ মডেলে রূপ দান করেন। তাঁর গবেষণা সম্পর্কে তিনি আবেগসিক্ত ভাষায় বলেন, ‘বৃত্তাকার পথে চলনশীল নক্ষত্রদের গতির কথা ভাবতে থাকলে আমার মনেই হয় না আমি এই পৃথিবীতে আছি।’
টলেমির মডেলে আটটি ঘূর্ণায়মান গোলক পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছিলো। এর প্রতিটি আগেরটির চেয়ে ক্রমান্বয়ে বড় ছিল, অনেকটা রুশদের নেস্টিং ডলের মতো। এই গোলকদের কেন্দ্রে ছিল পৃথিবীর অবস্থান। সবচেয়ে বাইরের গোলকের পরে কী আছে তা কখনোই স্পষ্ট করে বলা হয়নি, তবে এক মানুষের পর্যবেক্ষযোগ্য মাহবিশ্বের মধ্যেও গন্য করা হয়নি। ফলে বােইরের গোলকটিই ছিল মহাবিশ্বের সীমানা বা ধারক। এই গোলকের মধ্যে নক্ষত্ররা স্থিরভাবে বসেছিল, ফলে গোলকটি আবর্তন করলেও নক্ষত্রদের পারস্পরিক অবস্থান একই থাকত এবং এরা দলবেঁধে একই সাথে পুরো আকাশজুড়ে আবর্তন করতো।
টলেমির মডেলে পৃথিবীর অবস্থান ছিল মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এবং একে ঘিরে রাখা আটটি গোলক মহাকাশের সবগুলো বস্তুকে ধারণ করে রেখেছিলো।
গ্রহদের গোলক ছিল ভেতরের দিকে। এরা এদের নিজস্ব গোলকের মধ্যে নক্ষত্রদের মতো স্থির ছিলো না বরং গোলকের মধ্যেই এরা আবার ছোট ছোট বৃত্তাকার পথে চলত। এই বৃত্তাকার পথকে বলা হত মন্দবৃত্ত (Epicycle) । গ্রহরা গোলকের সাথে ঘূর্ণনের পাশাপাশি নিজেরাও গোলকের মধ্যে চলাচল করছে বলে পৃথিবী থেকে দেখতে এদের চলাচলের পথকে জটিল দেখাচ্ছে। এভাবে টলেমি আকাশে গ্রহদের দৃশ্যমান কক্ষপথকে প্যাঁচানো দেখা যাচ্ছে কেন তার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হলেন।
টলেমির মডেলের সাহায্যে আকাশের বস্তুদের অবস্থানের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল। কিন্তু এই অবস্থানগুলোর সঠিক পূর্বাভাস দিতে গিয়ে মেনে নিতে হচ্ছিল যে চাঁদের কক্ষপথ একে কোন কোন সময় অন্য সময়ের চেয়ে পৃথিবীর দ্বিগুণ কাছে নিয়ে আসে। এটা সঠিক হলে কোন কোন সময় চাঁদকে অন্য সময়ের দ্বিগুন বড় দেখানোর কতা ছিলো। টলেমি তাঁর মডেলের এই খুঁত সম্পর্কে জানতেন। তবুও তাঁর মডেলটি সাধারণভাবে স্বীকৃত ছিল, যদিও সবাই তা মেনে নেয়নি। ধর্মগ্রন্থের সাথে মলে যাওয়ায় খ্রিস্টানদের গির্জায়ও িএই মডেলকে স্বাগত জানানো হয়। গির্জার জন্য এই মডেলে সুবিধা ছিল, এতে স্থির গোলকদের বাইরে স্বর্গ ও নরকের জন্য যথেষ্ট জায়গা উপস্থিত ছিল।
কিন্তু ১৫১৪ সালে পোলিশ যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাস অন্য একটি মডেল উপস্থাপন করেন। সম্ভবত গির্জাবিরোধী হিসেবে পরিচিত হবার ভয়ে শুরুতে তিনি এটি প্রকাশ করেন নাম গোপন রেখে। তিনি একটি বৈপ্লবিক মতামত প্রকাশ করলেন। তাঁর মতে, মহাকাশের সব কিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এটা সত্য নয়। বরং সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রে স্থির আছে এবং পৃথিবী ও গ্রহরা সূর্যের চারপাশে বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। টলেমির মডেলের মতোই এটিও কিছুটা সফল হলো, কিন্তু পর্যবেক্ষনের সাথে পুরোপুরি মিলল না। এটি টলেমির মডেলের চেয়ে অনেক সরল ছিল বলে একে মেনে নেওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু এক শতাব্দী পার হয়ে গেলেও এটি কোথাও গুরুত্ব পেল না। এরপর দুজন জ্যেতির্বিদ-জার্মানির জোহানেস কেপলাও ও ইতালির গ্যালিলিও গালিলেই প্রকাশ্যে কোপার্নিকান তত্ত্বের পক্ষে অবস্থান নেন।
১৬০৯ সালে গ্যালিলিও াতার কিছুদিন আগে আবিষ্কৃত টেলিস্কোপের সাহায্যে রাতের আকাশ দেখা শুরু করেন। তিনি বৃহস্পতির (Jupiter) দিকে তাকিয়ে দেখেন, েএর চারপাশে কিছু ছোট ছোট উপগ্রহ একে প্রদক্ষিণ করছে। এর অর্থ হচ্ছে অ্যারিস্টটল ও টলেমিদের চিন্তা সঠিক নয় - সব কিছুকে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে, এম কোন কথা নেই। একই সময়ে কেপলার কোপার্নিকাসের তত্ত্বটি উন্নত করেন। নতুন তত্ত্বের বক্তব্য ছিল, গ্রহরা বৃত্তাকার পথে নয়, চলছে উপবৃত্তাকার পথে। এই পরিবর্তনের ফলে তত্ত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ মিলে গেল। এটি ছিল টলেমির মডেলের কফিনের শেষ পেরেক।
উপবৃত্তাকার কক্ষপথের মাধ্যমে কোপার্নিকাসের মডেল উন্নত হলেও কেপলার নিজে একে চূড়ান্ত মনে করতেন না। এর কারণ ছিল প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর কিছু বদ্ধমূল ধারণা, যেগুলোকে তিনি পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানের চেয়ে শক্তিশালী মনে করতেন। অ্যারিস্টটলের মতো তিনিও মনে করতেন উপৃত্তের চেয়ে বৃত্তের কম সুন্দর। তাঁর মতে, এমন ত্রুটিপূর্ণ পথে গ্রহদের চলার বিষয়টি বিশ্রী লাগছে, যা চূড়ান্ত সত্য হতে পার না। এই ধারণা অবিশ্বাস করার পেছনে তাঁর আরেকটি কারণ ছিল। তাঁর মতে গ্রহরা সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সূর্যের চৌম্বক বলের কারণে, যার ফলাফল উপবৃত্তাকার পথের সাতে মেলে না। যদিও তিনি ভূল করে গ্রহদের কক্ষপথের জন্য চৌম্বক বলকে দায়ী করেছেন, তবুও আমরা তাঁকে এর পেছনে কোনো বলের উপস্থিতি থাকার বিষয়টি বুঝতে পারার জন্য কৃতিত্ব দিতে পারি। এর আরো অনেক পরে , ১৬৮৭ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন সূর্যের চারদিকে গ্রহদের কক্ষপথের সঠিক ব্যাখ্যা দেন। এটি প্রকাশিত হয় ফিলোসোফিয় ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা (philosophiae Naturalis Principia Mathematica) প্রবন্ধে। সম্ভবত এটিই পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক অবদান।
প্রিন্সিপিয়াতে নিউটনের একটি সূত্রের বক্তব্য ছিল, কোন েবল কাজ করার আগ পর্যন্ত সকল স্থির বস্তু স্থিরই থাকবে। এতে তিনি আরো দেখলেন যে বলের প্রভাবে কীভাবে একটি বস্তু চলতে শুরু করে বা গতির পরিবর্তন করে। তাহলে গ্রহরা সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার পথে চলে কেন? নিউটনের মতে, এর পিছনে দায়ী হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বল। তাঁর মতে, এই বলের কারণে উপরে নিক্ষিপ্ত বস্তু ভূমিতে ফিরে আসে। তিনি এই বলের নাম দিলেন মহাকর্ষ বা গ্রাভিটি (Gravity) । নিউটনের আগে gravity শব্দটি মেজাজের রুক্ষতা বা ওজনের গুণ হিসেবেই শুধু ব্যবহৃত হত।
এছাড়া মহাকর্ষ বা অন্য কোন বলের প্রভাবে বস্তুর কী প্রতিক্রিয়া হয় তাও তিনি গাণিতিকভাবে বের করে ফেললেন। সমাধান করলেন উদ্ভূত সমীকরণগুলো। এভাবে তিনি দেখাতে সক্ষম হলেন যে সূর্যের মহাকর্ষের ফলেই পৃথিবী ও অন্য গ্রহরা উপবৃত্তাকার পথে চলে। এটি মিলে গেল কেপলারের বক্তব্যের সাথে। নিউটেনের মতে, এই সূত্র মহাবিশ্বের সব কিছুর জন্যই প্রযোজ্য, তা চাই পড়ন্ত আপেল হোক অথবা গ্রহ বা নক্ষত্রই হোক। ইতিহাসে এই প্রথম কেউ গ্রহদের গতির এমন ব্যাখ্যা দিলেন, যা পৃথিবীর গতিও নিয়ন্ত্রন করে। আধুনি পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার এখানেই পথচলা শুরু।
টলেমির গোলকীয় ধারণা বাদ দিলে মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক কোন সীমানা (সর্ববহিঃস্থ গোলক) আছে বলে মনে করার আর কোন কারণ বাকি ছিল না। অন্যদিকে যেহেতু দেখা যাচ্ছে যে রাতের আকাশের নক্ষত্ররা শুধু পৃথিবীর আবর্তনের কারণে আকাশের অবস্থান ঘুরে যাবার ফলেই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই বোঝা গেল, এরাও সূর্যের মতোই বস্তু কিন্তু অনেক দূরে অবস্থিত। আমরা শুধু পৃথিবীকেই মাহবিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরাইনি, বরং সূর্য এমনকি সৌরজগৎও যে মহাবিশ্বের বিশেষ কোন অংশ হবে পারে - এমন ধরণাও বাদ দিয়েছি। মতের এই পরিবর্তনের সাথে চিন্তার জগতেও বড় একটি পরিবর্তন সাধিত হয়। মহাবিশ্ব সম্পর্কে আধুনিক জ্ঞানেরও সূচনা এখানেই।
পৃথিবীর আকৃতি গেলকীয় হবার কারণ দিগন্ত থেকে আসা জাহাজের পাল ও মাস্তুল এর মূল কাঠামোর আগে চোখে পড়ে।
রাতের আকাশের ব্যাপারে গ্রিকরা দারুণ উৎসাহী ছিল। অ্যারিস্টটলের সময় থেকেই কয়েক শতক ধরে মানুষ রাতের আকাশের আলোগুলোর চলাচলের তথ্য লিখে রাখতো। তারা দেখলো, আকাশজুড়ে হাজার হাজার আলোর সবাই একই সাথে চললেও এদের পাঁচজন (চাঁদ বাদে) এই নিয়ম মানছে না। কখনো এরা নিয়মমাফিক পূর্ব-পশ্চিম পথে চলতে থাকে, কখনো আবার যেতে থাকে উল্টো দিকে। এই আলোগুলোর নাম দেওয়া হল প্লানেট বা গ্রহ। ইংরেজী প্ল্যানেট শব্দটি গ্রিক ভাষার যাযাবর বোঞাকে ব্যবহৃত হয়। গ্রিকদের চোখে শুধু পাঁচটি গ্রহই ধরা পড়েছিল, কারণ আমরা খালি চোখে বাকি গ্রহদের দেখতে পাই না। আমরা খালি চোখে দেখি বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিকে। বর্তমানে আমরা জানি, গ্রহরা কেন এই অদ্ভুত পথে চলে। আমাদের সৌরজগতের সাপেক্ষে নক্ষত্রদেরকে প্রায় স্থির বলা চলে, কিন্তু গ্রহরা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। এ কারণে রাতের আকাশে গ্রহদের চলাচলের পথ দূরবর্তী নক্ষত্রদের তুলনায় অনেক জটিল।
অ্যারিস্টটল মনে করতেন, পৃথিবী স্থির এবং সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ এবং নক্ষত্ররা পৃথিবীর চারদিকে বৃত্তাকার পথে ঘুরছে। তাঁর এই বিশ্বাসের কারণ ছিল একটি অতিন্দ্রীয় যুক্তি। পৃথিবীর অবস্থান মাহবিশ্বের কেন্দ্র এবং বৃত্তাকার গতিই হচ্ছে সবচেয়ে নিখুঁত। দ্বিতীয় শতাব্দীতে আরেক গ্রিক পণ্ডিত টলেমি এই ধারণাকে একটি পরিপূর্ণ মডেলে রূপ দান করেন। তাঁর গবেষণা সম্পর্কে তিনি আবেগসিক্ত ভাষায় বলেন, ‘বৃত্তাকার পথে চলনশীল নক্ষত্রদের গতির কথা ভাবতে থাকলে আমার মনেই হয় না আমি এই পৃথিবীতে আছি।’
টলেমির মডেলে আটটি ঘূর্ণায়মান গোলক পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছিলো। এর প্রতিটি আগেরটির চেয়ে ক্রমান্বয়ে বড় ছিল, অনেকটা রুশদের নেস্টিং ডলের মতো। এই গোলকদের কেন্দ্রে ছিল পৃথিবীর অবস্থান। সবচেয়ে বাইরের গোলকের পরে কী আছে তা কখনোই স্পষ্ট করে বলা হয়নি, তবে এক মানুষের পর্যবেক্ষযোগ্য মাহবিশ্বের মধ্যেও গন্য করা হয়নি। ফলে বােইরের গোলকটিই ছিল মহাবিশ্বের সীমানা বা ধারক। এই গোলকের মধ্যে নক্ষত্ররা স্থিরভাবে বসেছিল, ফলে গোলকটি আবর্তন করলেও নক্ষত্রদের পারস্পরিক অবস্থান একই থাকত এবং এরা দলবেঁধে একই সাথে পুরো আকাশজুড়ে আবর্তন করতো।
চিত্রঃ টলেমির মডেল।
টলেমির মডেলে পৃথিবীর অবস্থান ছিল মহাবিশ্বের কেন্দ্রে এবং একে ঘিরে রাখা আটটি গোলক মহাকাশের সবগুলো বস্তুকে ধারণ করে রেখেছিলো।
গ্রহদের গোলক ছিল ভেতরের দিকে। এরা এদের নিজস্ব গোলকের মধ্যে নক্ষত্রদের মতো স্থির ছিলো না বরং গোলকের মধ্যেই এরা আবার ছোট ছোট বৃত্তাকার পথে চলত। এই বৃত্তাকার পথকে বলা হত মন্দবৃত্ত (Epicycle) । গ্রহরা গোলকের সাথে ঘূর্ণনের পাশাপাশি নিজেরাও গোলকের মধ্যে চলাচল করছে বলে পৃথিবী থেকে দেখতে এদের চলাচলের পথকে জটিল দেখাচ্ছে। এভাবে টলেমি আকাশে গ্রহদের দৃশ্যমান কক্ষপথকে প্যাঁচানো দেখা যাচ্ছে কেন তার ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হলেন।
টলেমির মডেলের সাহায্যে আকাশের বস্তুদের অবস্থানের পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল। কিন্তু এই অবস্থানগুলোর সঠিক পূর্বাভাস দিতে গিয়ে মেনে নিতে হচ্ছিল যে চাঁদের কক্ষপথ একে কোন কোন সময় অন্য সময়ের চেয়ে পৃথিবীর দ্বিগুণ কাছে নিয়ে আসে। এটা সঠিক হলে কোন কোন সময় চাঁদকে অন্য সময়ের দ্বিগুন বড় দেখানোর কতা ছিলো। টলেমি তাঁর মডেলের এই খুঁত সম্পর্কে জানতেন। তবুও তাঁর মডেলটি সাধারণভাবে স্বীকৃত ছিল, যদিও সবাই তা মেনে নেয়নি। ধর্মগ্রন্থের সাথে মলে যাওয়ায় খ্রিস্টানদের গির্জায়ও িএই মডেলকে স্বাগত জানানো হয়। গির্জার জন্য এই মডেলে সুবিধা ছিল, এতে স্থির গোলকদের বাইরে স্বর্গ ও নরকের জন্য যথেষ্ট জায়গা উপস্থিত ছিল।
কিন্তু ১৫১৪ সালে পোলিশ যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাস অন্য একটি মডেল উপস্থাপন করেন। সম্ভবত গির্জাবিরোধী হিসেবে পরিচিত হবার ভয়ে শুরুতে তিনি এটি প্রকাশ করেন নাম গোপন রেখে। তিনি একটি বৈপ্লবিক মতামত প্রকাশ করলেন। তাঁর মতে, মহাকাশের সব কিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এটা সত্য নয়। বরং সূর্য সৌরজগতের কেন্দ্রে স্থির আছে এবং পৃথিবী ও গ্রহরা সূর্যের চারপাশে বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। টলেমির মডেলের মতোই এটিও কিছুটা সফল হলো, কিন্তু পর্যবেক্ষনের সাথে পুরোপুরি মিলল না। এটি টলেমির মডেলের চেয়ে অনেক সরল ছিল বলে একে মেনে নেওয়াই উচিত ছিল। কিন্তু এক শতাব্দী পার হয়ে গেলেও এটি কোথাও গুরুত্ব পেল না। এরপর দুজন জ্যেতির্বিদ-জার্মানির জোহানেস কেপলাও ও ইতালির গ্যালিলিও গালিলেই প্রকাশ্যে কোপার্নিকান তত্ত্বের পক্ষে অবস্থান নেন।
১৬০৯ সালে গ্যালিলিও াতার কিছুদিন আগে আবিষ্কৃত টেলিস্কোপের সাহায্যে রাতের আকাশ দেখা শুরু করেন। তিনি বৃহস্পতির (Jupiter) দিকে তাকিয়ে দেখেন, েএর চারপাশে কিছু ছোট ছোট উপগ্রহ একে প্রদক্ষিণ করছে। এর অর্থ হচ্ছে অ্যারিস্টটল ও টলেমিদের চিন্তা সঠিক নয় - সব কিছুকে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে হবে, এম কোন কথা নেই। একই সময়ে কেপলার কোপার্নিকাসের তত্ত্বটি উন্নত করেন। নতুন তত্ত্বের বক্তব্য ছিল, গ্রহরা বৃত্তাকার পথে নয়, চলছে উপবৃত্তাকার পথে। এই পরিবর্তনের ফলে তত্ত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ মিলে গেল। এটি ছিল টলেমির মডেলের কফিনের শেষ পেরেক।
উপবৃত্তাকার কক্ষপথের মাধ্যমে কোপার্নিকাসের মডেল উন্নত হলেও কেপলার নিজে একে চূড়ান্ত মনে করতেন না। এর কারণ ছিল প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর কিছু বদ্ধমূল ধারণা, যেগুলোকে তিনি পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানের চেয়ে শক্তিশালী মনে করতেন। অ্যারিস্টটলের মতো তিনিও মনে করতেন উপৃত্তের চেয়ে বৃত্তের কম সুন্দর। তাঁর মতে, এমন ত্রুটিপূর্ণ পথে গ্রহদের চলার বিষয়টি বিশ্রী লাগছে, যা চূড়ান্ত সত্য হতে পার না। এই ধারণা অবিশ্বাস করার পেছনে তাঁর আরেকটি কারণ ছিল। তাঁর মতে গ্রহরা সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সূর্যের চৌম্বক বলের কারণে, যার ফলাফল উপবৃত্তাকার পথের সাতে মেলে না। যদিও তিনি ভূল করে গ্রহদের কক্ষপথের জন্য চৌম্বক বলকে দায়ী করেছেন, তবুও আমরা তাঁকে এর পেছনে কোনো বলের উপস্থিতি থাকার বিষয়টি বুঝতে পারার জন্য কৃতিত্ব দিতে পারি। এর আরো অনেক পরে , ১৬৮৭ সালে স্যার আইজ্যাক নিউটন সূর্যের চারদিকে গ্রহদের কক্ষপথের সঠিক ব্যাখ্যা দেন। এটি প্রকাশিত হয় ফিলোসোফিয় ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকা (philosophiae Naturalis Principia Mathematica) প্রবন্ধে। সম্ভবত এটিই পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক অবদান।
প্রিন্সিপিয়াতে নিউটনের একটি সূত্রের বক্তব্য ছিল, কোন েবল কাজ করার আগ পর্যন্ত সকল স্থির বস্তু স্থিরই থাকবে। এতে তিনি আরো দেখলেন যে বলের প্রভাবে কীভাবে একটি বস্তু চলতে শুরু করে বা গতির পরিবর্তন করে। তাহলে গ্রহরা সূর্যের চারদিকে উপবৃত্তাকার পথে চলে কেন? নিউটনের মতে, এর পিছনে দায়ী হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বল। তাঁর মতে, এই বলের কারণে উপরে নিক্ষিপ্ত বস্তু ভূমিতে ফিরে আসে। তিনি এই বলের নাম দিলেন মহাকর্ষ বা গ্রাভিটি (Gravity) । নিউটনের আগে gravity শব্দটি মেজাজের রুক্ষতা বা ওজনের গুণ হিসেবেই শুধু ব্যবহৃত হত।
এছাড়া মহাকর্ষ বা অন্য কোন বলের প্রভাবে বস্তুর কী প্রতিক্রিয়া হয় তাও তিনি গাণিতিকভাবে বের করে ফেললেন। সমাধান করলেন উদ্ভূত সমীকরণগুলো। এভাবে তিনি দেখাতে সক্ষম হলেন যে সূর্যের মহাকর্ষের ফলেই পৃথিবী ও অন্য গ্রহরা উপবৃত্তাকার পথে চলে। এটি মিলে গেল কেপলারের বক্তব্যের সাথে। নিউটেনের মতে, এই সূত্র মহাবিশ্বের সব কিছুর জন্যই প্রযোজ্য, তা চাই পড়ন্ত আপেল হোক অথবা গ্রহ বা নক্ষত্রই হোক। ইতিহাসে এই প্রথম কেউ গ্রহদের গতির এমন ব্যাখ্যা দিলেন, যা পৃথিবীর গতিও নিয়ন্ত্রন করে। আধুনি পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যার এখানেই পথচলা শুরু।
টলেমির গোলকীয় ধারণা বাদ দিলে মহাবিশ্বের প্রাকৃতিক কোন সীমানা (সর্ববহিঃস্থ গোলক) আছে বলে মনে করার আর কোন কারণ বাকি ছিল না। অন্যদিকে যেহেতু দেখা যাচ্ছে যে রাতের আকাশের নক্ষত্ররা শুধু পৃথিবীর আবর্তনের কারণে আকাশের অবস্থান ঘুরে যাবার ফলেই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই বোঝা গেল, এরাও সূর্যের মতোই বস্তু কিন্তু অনেক দূরে অবস্থিত। আমরা শুধু পৃথিবীকেই মাহবিশ্বের কেন্দ্র থেকে সরাইনি, বরং সূর্য এমনকি সৌরজগৎও যে মহাবিশ্বের বিশেষ কোন অংশ হবে পারে - এমন ধরণাও বাদ দিয়েছি। মতের এই পরিবর্তনের সাথে চিন্তার জগতেও বড় একটি পরিবর্তন সাধিত হয়। মহাবিশ্ব সম্পর্কে আধুনিক জ্ঞানেরও সূচনা এখানেই।

0 মন্তব্যসমূহ