আঙুলের ছাপে অপরাধের হদিশ
অপরাধী শনাক্ত করতে তো বটেই, হাতের আঙ্গুলের ছাপ আজ আমাদের কাজে লাগে আরও নানা ভাবে। সকলের চোখের সামনে থাকা এই অনন্য বৈশিষ্ট্য আমাদের জানালেন কারা? কীভাবে আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়?
আঙুলের ছাপ থেকে যে কত গোপন তথ্য পাওয়া যায়, তা না দেখেলে বোঝা ভার। আজকাল যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু হয়েছে, তাতে আঙুলের ছাপের বৈশিষ্ট্যই বেশি গ্রহণযোগ্য। এই বায়োমেট্রিক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন অ্যালফোঁস বের্তিলন, ১৮৮০ সালে, প্যারিসে। একটু নজর দিলে দেখা যায় যে আমাদের আঙুলে আছে অসংখ্য খাঁজ। আর প্রতিটি খাঁজের দু’পাশই উঁচু অর্থাৎ ফ্রিকশন রিজ সুস্পষ্ট। এই ফ্রিকশন রিজগুলোই আঙুলের ছাপের জন্য দায়ী। ত্বকে অবস্থিত স্বেদ বা ঘর্মগ্রন্থিগুলো ছোট-ছোট ফ্রিকশন রিজে উন্মুক্ত হয়ে স্বেদক্ষরণ করে। তথ্যে ভরা এই আঙুলের ছাপ পরীক্ষা করে শনাক্তকরণের পদ্ধতিই হল ‘ড্যাকটাইলোস্কোপি’।
আঙুলের ছাপের উৎসঃ
আঙুলের ছাপের উৎস কিন্তু এই এশিয়া মহাদেশেই। এর উল্লেখযোগ্য গবেষণা ও অগ্রগতি ঘটেছে ভারতে। খ্রিস্টপূর্ব তিন শতকে চিনে বিভিন্ন নথিপত্রে ও চুক্তিস্বাক্ষরে আঙুলের ছাপকেই সিল হিসেবে ব্যবহার করা হত। জার্মানির জে সি এ মেয়ার ১৭৮৮ সালে তাঁর এক তত্ত্বে জানান যে, আঙুলের ফ্রিকশন রিজ দু’টি ব্যক্তির ক্ষেত্রে কখনওই এক হয় না। পরে, অর্থাৎ ১৮২৩ সালে অধ্যাপক জে ই পারকিনজি ন’টি বিভিন্ন ভাগে আঙুলের ছাপের শ্রেণিবিন্যাস করেন। আঙুলের ছাপের আধুনিক ধারণা আত্মপ্রকাশ করে অবশ্য ১৮৫৮ সালে, ব্রিটিশ প্রশাসক উইলিয়াম হার্শেলের হাত ধরে কলকাতায়। ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম যে-কোনও চুক্তিপত্রে আঙুলের ছাপ নেওয়ার রীতি প্রচলন করেন। পরে, অর্থাৎ ১৮৯৬ সালে তৎকালীন বাংলার পুলিশের আইজি স্যার এডওয়ার্ড হেনরি নিজস্ব পদ্ধতিতে আঙুলের ছাপের এক উন্নত শ্রেণিবিন্যাস করেন,যা ভারতবর্ষ ও লন্ডনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ১৯০১ সালে গৃহীত হয়। কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে আঙুলের ছাপের এই ‘হেনরি সিস্টেম’-ই বর্তমানে বহু দেশে চালু আছে।
আঙুলের ছাপ কেন বিশ্বাসযোগ্যঃ
আঙুলের ছাপ বিশ্বাসযোগ্য এ-কারণেই যে, কোনও ব্যক্তির দু’টি আঙুলের ছাপ কখনওই একরকম হয় না। সমকোষী যমজ দেখেতে এক হলেও তাদের আঙুলের ছাপ আলাদা হয়। এছাড়া জীবদ্দশায় আঙুলের ছাপ গঠনকারী রিজ প্যাটার্ন কখনও পালটায় না। এমনকি, গ্রাফ্টিং (শল্যচিকিৎসার মাধ্যমে এক জায়গার ত্বক তুলে অন্যত্র বসানো) দ্বারাও ফিঙ্গারপ্রিন্ট চিরতরে বদলানো যায় না। আঙুলের ছাপ খুব সহজে কোনও মসৃণ বস্তুর উপর নেওয়া যায়। অপরাধীর অজ্ঞাতসারে অপরাধস্থলে সৃষ্ট এই ছাপ অপরাধের কিনারায় সাহায্য করে। বর্তমানে সারা পৃথিবীতেই প্রমাণ হিসেবে আঙুলের ছাপ আইনত গ্রাহ্য। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি দফতরেও বিভিন্ন কাজে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রে এই ছাপ গ্রহণ বাধ্যতামূলক হয়েছে।
ছাপ নেওয়ার পদ্ধতিঃ
স্বাভাবিকভাবে আঙুলের ছাপ নেওয়ার আগে সাবানজলে হাত পরিষ্কার করে অর্থাৎ শুকনো করে আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। আঙুল যাতে ঘামে না ভেজে, সেদিকে নজর রাখা হয় এবং নখের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত আঙুলের শেষ পর্বে কালি বুলিয়ে নিতে হয়। ছাপ নেওয়ার সময় আঙুলের উপর বেশি চাপ দেওয়া ঠিক নয়।
ছাপের প্রকারভেদঃ
অপরাধস্থলে অজ্ঞাতসারে আঙুলের যে ছাপ অপরাধী রেখে যায়, তাকে বলে ‘চান্স প্রিন্ট’ এবং এই প্রিন্টকেই বলা হয় বার্গলার্স, অর্থাৎ চোরের ভিজিটিং কার্ড! এটিকে তিনভাগে ভাগ করা হয়, পেটেন্ট প্রিন্ট, প্লাস্টিক প্রিন্ট ও ল্যাটেন্ট প্রিন্ট। পেটেন্ট প্রিন্ট কালি, রক্ত, রং ইত্যাদি দিয়ে তৈরি করা হয়। প্লাস্টিক প্রিন্ট তৈরি করা হয় সাবান, কাদা, নরম প্যারাফিন, আঠা ইত্যাদির উপর। রইল বাকি ল্যটেন্ট প্রিন্ট, যার জন্য ত্বকের তৈলাক্ত বস্তুই দায়ী। এই ছাপ সহজে বোঝা যায় না।
ছাপ কিভাবে ফুটবেঃ
অপরাধীর আঙুলের ছাপ বোঝার জন্য বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়। ভৌত পদ্ধতিতে প্রিন্টকে ফুটিয়ে তোলার জন্য ব্যবহার করা হয় কালো পাউডার (গ্রাফাইট, চারকোল বা ভুসো কালি), লাল পাউডার, সাদা বা ধূসর পাউডার (জিঙ্ক অক্সাইড, মিহিচক, অ্যাকাসিয়া আঠা), রুপোলি পাউডার (অ্যালুমিনিয়াম গুঁড়ো) ও ফ্লুরোসেন্ট পাউডার (বোডামিন বি, অ্যানফ্রাসিন)। ভৌত পদ্ধতি ব্যতীত রাসায়নিক পদ্ধতিতেও আঙুলের ছাপ ফুটিয়ে তোলা যায়। যেমন সিলভার নাইট্রেট কিংবা নিনহাইড্রিনের সাহায্যে। সিলভার নাইট্রেটের জলীয় দ্রবণ (৩%) প্রিন্টের সংস্পর্শে এলে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় সিলভার ক্লোরাইড তৈরি করে। সিলভার ক্লোরাইড আলোকসংবেদী হওয়ায় আলোর উপস্থিতিতে গাঢ় প্রিন্ট তৈরি করে। অপরাধের এক-দু’বছর পরেও এই পদ্ধতিতে ছাপ ঠিকভাবে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। অন্যদিকে নিনহাইড্রিন পদ্ধতি একটি উন্নত, আধুনিক পদ্ধতি। এক্ষেত্রে প্রিন্টে থাকা ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে আসা অ্যামিনো অ্যাসিড নিনহাইড্রিনের সংস্পর্শে এসে বেগুনি রং তৈরি করে এবং ফিঙ্গারপ্রিন্টের রিজের গঠন স্পষ্ট করে। যদিও আঙুলের ছাপের সর্বাধিক উন্নত পদ্ধতি হল লেজার পদ্ধতি।
স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিঃ
কম্পিউটারের সাহায্যে দ্রুতগতিতে, দক্ষতার সঙ্গে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন ছাপ পৃথক করা যায়। সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যও চিহ্নিত করা যায়। বিভিন্ন আঙুলের ছাপের তথ্যভাণ্ডারে রাখা ছাপের সঙ্গে নতুন কোনও ছাপ মিলিয়ে দেখে নিতে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সময় লাগে এক সেকেন্ডেরও কম।
0 মন্তব্যসমূহ