জ্যামিতির ইতিহাস

একদিকে পারস্যের রাজসিংহাসন অন্যদিকে জ্যামিতির উপপাদ্য – এই দুইয়ের মধ্যে বেছে নিতে বলা হলে তুমি কোনটা চাইবে? ডেমোক্রিটাস নামে এক গ্রীক পণ্ডিত বলেছিলেন শেষেরটাই তাঁর পক্ষে বেশি লোভনীয়। শুনে কি আশ্চর্য হচ্ছ? ত্রিভুজের বাহু আর কোণের মধ্যে কে কার চেয়ে বড়, কে কার সমান এইসব জটিল প্রমাণ নিয়ে যখন হিমসিম খেতে হয় তখন আমরা ভুলেই যাই, আসলে কিন্তু জ্যামিতির উদ্ভব হয়েছিল মানুষেরই প্রয়োজনে।

কেমন প্রয়োজন? সভ্যতার আদি যুগে ফিরে যাওয়া যাক চল। মিশরের রাজারা, শোনা যায়, প্রজাদের মধ্যে চৌক চৌক আকারে জমি বিলি করতেন, মনে রেখো তখনও কিন্তু স্কুলে জ্যামিতির প্রচলন হয়নি। বর্গক্ষেত্র, আয়তক্ষেত্র কাকে বলে? তাদের এক বাহু যদি এই মাপের হয় তাহলে তার বিপরীত বাহু কত বড় হবে, এইসব ধারণাই মিশরীয় চাষীদের ছিল না। রাজা সমানভাবে সকলের মধ্যে জমি ভাগ করে দিতেন। তারপরে ঠিক করা হত খাজনা কত হবে। এদিকে নদীতে বন্যা তো লেগেই আছে। কারো জমির খানিকটা হয়ত নদীর ভাঙ্গনে জলের তলায় চলেই গেল। নিয়ম ছিল, এরকম ঘটনা ঘটলে জমির মালিক এসে রাজাকে জানাবে। রাজা তারপর লোকজন পাঠাবেন মাপ করে হিসেব করার জন্য। তখন তাদের যে নামেই ডাকা হোক না কেন, আসলে তারা ছিল ইঞ্জিনিয়ার। এইভাবে জ্যামিতির ধারণাগুলো ক্রমশঃ দানা বাঁধতে লাগল। এই কথা লিখে গেছেন সেকালের বিখ্যাত ঐতিহাসিক হেরোডোটাস।

সেকালে আর একটি সভ্যতার কেন্দ্র ছিল ব্যাবিলন। ব্যাবিলনীয়দের হিসেবপত্র লিখে রাখার উপায় ছিল খুবই অভিনব। নরম মাটির চাকতি বা পাত্রের উপর তারা লিখত ছুঁচল কাঠি দিয়ে। তাদের এই লিপিকেক বলা হত কিউনিফর্ম। বলাই বাহুল্য, এই পদ্ধতিতে লেখার ফলে তাদের অক্ষরগুলো হত সরু, লম্বা এবং চোখা। আমাদের হাতের লেখার মত গোল গোল নয়। লেখার পর তারা ঐ মাটির ফলকগুলো পুড়িয়ে লেখাটা পাকা করে রাখত। এই সব পোড়া মাটির লিপিগুলো থেকে জানা যায় জ্যামিতি সম্বন্ধে তাদের প্রাথমিক জ্ঞান মোটামুটি বেশ ভালই ছিল। যেমন ব্যাসার্ধের সমান মাপের জ্যা যে বৃত্তের কেন্দ্রে ষাট ডিগ্রি কোণ উৎপন্ন করে এবং এই জ্যা বৃত্তের ভেতরে আঁকা সুষম ষড়ভুজের একটি বাহুর সমান এই ধরনের কিছু কিছু উক্তি ঐসব ফলকে পাওয়া গেছে। একটি ত্রিভুজের তিনটি বাহুর দৈর্ঘ্য যদি হয় ৩, ৪ ও ৫ তাহলে ত্রিভুজটি যে সমকোণী এই তথ্যও তাদের জানা ছিল। তোমরা নিশ্চয় বুঝতে পারছ, এটা পিথাগোরাসের প্রতিপাদ্যের কাছাকাছি। তাহলে কি ব্যাবিলনীয়রা পিথাগোরাসের কাছ থেকেই এই তথ্যটি পেয়েছিল? এই সব প্রশ্নের কিন্তু কোন সদুত্তর পাওয়া সম্ভব হয়নি।

মিশরীয়রা অবশ্য ব্যাবিলনের লোকদের চেয়ে জ্যামিতিতে অনেক বেশি উন্নতি করেছিল। তারা ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল বার করত ১/২ × ভূমি × উচ্চতা এইভাবে। এ ছাড়া তারা বৃত্ত, চতুর্ভুজ, বহুভুজ ইত্যাদিরও ক্ষেত্রফল নির্ণয় করার উপায় জানত। সিলিন্ডার ও পিরামিডের ঘনফলও বার করতে পারত তারা। যারা পিরামিড তৈরি করেছিল তাদের যে নিখুঁত জ্যামিতি জ্ঞান থাকবে তাতে আর আশ্চর্য কি। তবে ব্যাবিলনের লোকেরাও পিরামিডের ঘনফল বের করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল, যদিও তাদের চেয়ে মিশরীয়দের পদ্ধতিটা আরো নির্ভুল। ব্যাবিলনীয়রা যে গোলায় শস্য রাখত তার আকার পিরামিডের মত। শস্যের পরিমাণ মাপার জন্য গোলাঘরের আয়তন জানা দরকার। কাজেই তাদের জ্যামিতি শিখতে হয়েছিল একান্তই দায়ে পড়ে।

একটি পুরোনো প্যাপিরাসে এই রকম একটি অঙ্ক পাওয়া যায়ঃ

মনে কর, একটা পিরামিড কাটা হয়েছে – কাটা অংশের আয়তন বার করতে হবে। তোমাকে বলা হয়েছে কাটা পিরামিডের উচ্চতা ৬ কিউবিট, নিচের ভূমির দৈর্ঘ্য ৪ কিউবিট, উপরের ভূমির দৈর্ঘ্য ২ কিউটি।

৪ এর বর্গ বের কর; উত্তরঃ- ১৬

৪ এর দ্বিগুণ করো; উ্তরঃ- ৮

২ এর বর্গ বের কর; উত্তরঃ ৪

১৬ এর সঙ্গে ৮ এবং তার সঙ্গে ৪ যোগ কর, যোগফল হল ২৮

৬ এর ১/৩ বের কর; উত্তরঃ- ২

২৮ এর দ্বিগুণ বের কর; উত্তর ৫৬

দেখ, তাহলে উত্তর পাওয়া গেল। এই হল প্যাপিরাসে কষা অঙ্ক। যদিও কিভাবে এই উত্তর পাওয়া গেল সেটা স্পষ্ট করে বলা হল না। মনে হয়, পিরামিড তৈরি করার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কিচু জ্যামিতির সূত্র সম্বন্ধে তাদের নির্ভুল ধারণা জন্মেছিল। আগে ফর্মুলা বের করে তার প্রয়োগ না করে মিশরীয়দের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়েছিল উলটো।

সিন্ধু সভ্যতা, যাকে আমরা হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর সঙ্গে যুক্ত করি – যে ঠিক কোন সময়ে বিকাশ লাভ করেছিল সে বিষয়ে কোন পণ্ডিতই একমত হতে পারেননি। সেখানে পর পর সাতটি স্তরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। লোহার তৈরি কোন জিনিসই সেখানে পাওয়া যায়নি, এবং মাটির বাসনের গড়ন ইত্যাদি থেকে অনুমান করা হয়, সময়টা হয়ত খৃষ্ট জন্মের তিন হাজার বছর আগে হবে। কিন্তু ওদের নগর পরিকল্পনা, ৯ ফুট থেকে ৩৪ ফুট চওড়া উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম প্রসারিত রাস্তা, এ সবই যে অত্যন্ত আধুনিক ছিল তা স্বীকার করতেই হয়। রাস্তাগুলি সহরকে ছোট বড় বর্গক্ষেত্র ও আয়তক্ষেত্রে ভাগ করেছে। কিন্তু জ্যামিতির কোন সূত্র পর্যন্ত তারা পৌঁছতে পেরেছিল কিনা তার কোন লিখিত প্রমাণ পাওয়া যায় নি। আসল কথা, ওদের লিপির কাজ অবধি পাঠোদ্ধার করা যায় নি। গেলে হয়ত কিছু আভাস পাওয়া যেত।

প্রাচীন ভারতে জ্যামিতির ধারণা কতটা হয়েছিল জানতে গেলে এর পরে আসতে হবে বৈদিক যুগে। বৈদিক সাহিত্যে অনেক জায়গায় বলা হয়েছে, সকল বিদ্যার মধ্যে শ্রেষ্ঠ হল গণিত। জ্যামিতিকে বলা হত রেখাগণিত বা ক্ষেত্রগণিত। বেদাঙ্গ জ্যোতিষে এক জায়গায় একটি শেলাকেক বলা হয়েছে ময়ূরের মাথায় যেমন শিখা, সাপের মাথায় যেমন মণি, সেইরকম বেদাঙ্গ নামে অভিহিত সকল বিজ্ঞানের শীর্ষস্থানে গণিতের অবস্থিতি।

সেই যুগে বাগযজ্ঞ করার সময় বেদী তৈরি করা হত। বেদী থেকে নানারকম জ্যামিতিক সমস্যার উদ্ভব হয়, যেমন একটি বর্গক্ষেত্রকে কেটে আয়তক্ষেত্রে পরিণত করতে হবে। বর্গক্ষেত্রের একটি বাহু জানা আছে, আয়তক্ষেত্রের একটি বাহু জানা আছে। অপর বাহুটি কত?

সেই সময়কার যজ্ঞ অনুষ্ঠানে প্রায়ই মহাবেদী কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাবেদী আসলে একটি সমদ্বীবাহু ট্রাপিজিয়াম যার দুই সমান্তরাল বাহুর দৈর্ঘ্য ২৪ ও ৩০ এবং উচ্চতা ৩৬, এখন এই সমান্তরাল বাহু দুটিকে যদি সমান অনুপাতে বাড়ান যায় এবং তার ফলে ট্রাপিজিয়মের ক্ষেত্রফল বাড়ে, তাহলে ঐ অনুপাতের সঙ্গে ক্ষেত্রফলের বর্দ্ধিত অংশের সম্পর্ক কি? বলাই বাহুল্য, এই সব জ্যামিতিক সমস্যার সমাধান অ্যালজাব্রা দিয়েই করা হত। প্রাচীন কালে ভারতীয়রা শুধু যে ক্ষেত্রফল, ঘনফল বার করতে জানতেন তা নয়, বৃত্তকে বর্গে রূপান্তরিত করতেও পারতেন। জ্যামিতিবিদ পণ্ডিতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাম শোনা যায় বৌধায়ন,কাত্যায়ন ও আপস্তম্বের। পিথাগোরারেস উপপাদ্য বলে এখন যেটা পরিচিত, অর্থাৎ একটি সমকোনী ত্রিভুজের অতিভুজের উপর আঁকা বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল বাহু দুটির উপর আঁকা বর্গক্ষেত্রদুটির ক্ষেত্রফলের সমান – এই উপপাদ্যটিকে ভারতীয় জ্যামিতিবিদরা বর্ণনা করেছেন –

‘একটি আয়তক্ষেত্রের কর্ণ যে বর্গক্ষেত্র উৎপন্ন করে তার ক্ষেত্রফল আয়তক্ষেত্রের বাহুদ্বয়ের উপর উৎপন্ন বর্গক্ষেত্রের মিলিত ক্ষেত্রফলের সমান।’

হয়ত ভারতবর্ষে এই উপপাদ্যের আবিষ্কার আগেই হয়েছিল – এমনও অনেকে মনে করেন। পিথাগোরাসের অনেক আগেই তাঁরা সম্পর্কটি আবিষ্কার করে থাকলে অবাক হবার কিছু নেই।