রহস্যে ঘেরা পিরামিড
দীর্ঘদিন ধরে অনেকে ভেবেছেন, পিরামিড মানেই বুঝি মৃত মানুষকে মমি বানিয়ে রেখে দেওয়ার জন্য তৈরি সমাধি। গত ২০ বছরে কিন্তু আমূল পালটে গিয়েছে সেই ধারণা। কারা তৈরি করেছিল এইসব সুউচ্চ সৌধ? কীভাবেই বা করেছিল? কী প্রয়োজন ছিল এদের? আজকে আমরা সেগুলোই জানার চেষ্টা করবো।
সালটা ১৯৯৯। মুক্তি পেল হলিউডের ছবি, ‘দ্য মমি’। কল্পনা, বাস্তব আর কম্পিউটারের কারিকুরি মিলেমিশে ছবির পর্দায় ফুটে উঠল ৩০০০ বছর আগের মিশর। ফারাওকে হত্যার অপরাধে সেখানকার উচ্চপদস্থ পুরোহিত ইমহোটেপকে দেওয়া হল চরম শাস্তি। তার জিভ কেটে, হাত-পা বেঁধে, সারা গায়ে কাপড় জড়িয়ে জ্যান্ত মমি বানিয়ে দেওয়া হল। তারপর, তখনও জীবন্ত, ছটফট করতে থাকা সেই মমির গায়ে ছেড়ে দেওয়া হল শয়ে-শয়ে স্ক্যারাব বিটল পোকা। সিনেমার পর্দায় গুবরে পোকার তুতোভাই সেই পোকা তার চলার পথে কোনও জ্যান্ত প্রাণী পেলে তার গয়ের চামড়া ভেদ করে ঢুকে পড়ে (বাস্তবে যদিও তা হয় না)। তারপর চামড়ার তলা দিয়ে খুঁড়ে-খুঁড়ে পৌঁছে যায় মানুষের মাথায়।
মিশরের পিরামিডের পেটের মধ্যে ৩০০০ বছর ওভাবেই বন্দি থাকার পর অবশেষে ইমহোটোপ ছাড়া পায় এবং বেঁচে ওঠে। তারপর একের পর-এক মানুষকে শুষে ইমহোটেপ ক্রমশ কঙ্কাল থেকে মানুষের চেহারা পায়, কালক্রমে নিজের মৃত প্রিয়জনকে বাঁচিয়ে তোলার ব্যবস্থা করতে যায় এবং ছবির নায়ক-নায়িকার সঙ্গে সেই নিয়ে তার লেগে যায় ধুন্ধুমার। ১৯৩২ সালে তৈরি হলিউডি ছবির এই আধুনিক রিমেক মুক্তি পাওয়ামাত্র একে নিয়ে শুরু হল হইচই। যে টাকায় ছবি বানানো হয়েছিল, তার বহু গুণ বেশি মুনাফা বাজার থেকে তুলে ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী জায়গা করে নিল ১৯৯৯ সালের ‘দ্য মমি’। চটপট িইতিহাস বইয়ের পাতা খুুলেও দেখা গেল, কী আশ্চর্য! প্রাচীন মিশরের প্রথম পিরামিড নির্মাতার নাম ছিল ইমহোটেপ, যিনি পেশায় সত্যিই পুরোহিত ছিলেন। ব্যস, আর যায় কোথায়! ‘দ্য মমি’ দেখে আমাদের বিশ্বাস হল, পিরামিড মানেই প্রাচীন মিশরের সম্ভ্রান্ত মানুষের সমাধি। এমনকী, আজও পৃথিবীর বহু মানুষের বদ্ধমূল ধারণা, হাজার-হাজার বছর আগে, অন্তত মিশরে, পিরামিড তৈরি করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ওইটিই-সম্ভ্রান্ত রাজা-রানি কিংবা পুরোহিতদের মৃতদেহকে মমি বানিয়ে সমাধিস্থ করা।
অথচ সত্যিটা এই যে, মিশরের সুপ্রাচীন পিরামিডগুলোর কোনওটিতেই একটিও মমি খুঁজে পাওয়া যায়নি। পিরামিডে মমি রাখা হত বলে যাঁদের বিশ্বাস, তাঁরা অবশ্য বলেই থাকেন, ‘আরে, ও কী আর পাওয়া যায় নাকি! রাজা-রানির মমির সঙ্গে সোনাদানা, উপঢৌকনও রাখা হত সমাধিতে। হাজার-হাজার বছর ধরে চোর-ডাকাতরা সেসব লুটেপুটে নিয়ে গিয়েছে বলেই আজ পিরামিডের ভিতরে মমি বা তার সঙ্গে রাখা সামগ্রী দেখতে পাওয়া যায় না।’ কিন্তু তাই বলে সারা মিশর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এত-এত পিরামিডের একটিতেও মমি পাওয়া যাবে না? আর যদি মেনে নিউ যে সত্যিই পিরামিডে মমি রাখা হত না, তা হলে এই সুবিশাল সৌধগুলো বানানো হয়েছিল কেন?
মিশর-ই কেন?
পিরামিডের রহস্যভেদের জন্য এবার আমরা পাড়ি দেব মিশর। কিন্তু তার আগে তোমরা বলতেই পার, মিশরই কেন? মিশর ছাড়া পৃথিবীর অন্যত্রও তো পিরামিড খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। কথাটা মিথ্যে নয়। তবু কেন মিশর? তার উত্তর সরাসরি দেওয়ার আগে একটা তথ্য জানাই। আমাদের পৃথিবীর তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল, জান নিশ্চয়ই? সাতখানা মহাদেশ মিলে ওই যে একভাগ স্থল, তার জ্যামিতিক কেন্দ্রর অক্ষাংশ আর দ্রাঘিমাংশ যথাক্রমে ৩০ ডিগ্রি উত্তর এবং ৩১ ডিগ্রি পূর্ব। সারা পৃথিবীর অনেক, বড়-বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানী দীর্ঘদিন এই হিসেবে বিশ্বাস করেছেন এবং আমরা অবাক হয়ে দেখেছি যে, গিজার গ্রেট পিরামিড ঠিক সেই জায়গাতেই তৈরি। অথচ কী আশ্চর্য, আমাদের এই গ্রহে যে সাতখানা মহাদেশ আছে, এ তথ্য আমরা, অর্থাৎ আদুনিক মানুষ জানতে পেরেছি মাত্র ৬০০ বছর আগে! তারপর থেকে আজ পর্যন্ত বিস্তর মাপজোক করে এই সবে ২০১৬ সালে আমরা পৃথিবীর স্থলভাগের জ্যামিতিক কেন্দ্রের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ পেয়েছি যথাক্রমে, ৪০ ডিগ্রি ৫২ মিনিট উত্তর এবং ৩৪ ডিগ্রি ৩৪ মিনিট পূর্ব। ঠিক গ্রেট পিরামিডের জায়গাতেই নয়, তবে তার চেয়ে অনেক দূরে কোথাও, তা-ও কিন্তু নয়! মিশরের বাসিন্দারা যদি সত্যিই আজ থেকে হাজার-হাজার বছর আগে জেনেবুঝে, হিসেবনিকেশ করে ওই বিশেষ জায়গায় গ্রেট পিরামিড বানিয়ে থাকেন, তা হলে আশ্চর্য হতেই হয়। আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া কী করে তাঁরা করেছিলেন এই প্রায় নিখুঁত গনণা? সমাধি যদি না-ই হবে, পিরামিড তবে কী? মিশরের বিভিন্ন পিরামিডে ঘুরে-ঘুরে আমরা এবার খুঁজে বেড়াব এইসব প্রশ্নের উত্তর।
পাহাড়ের উপর পিরামিড
সবার আগে আমরা যাব গিজার আট কিলোমিটার উত্তরে, আবু রাওয়াশ-এ। মিশরের সর্বত্র ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা পিরামিডদের মধ্যে একটি আছে এখানে। কিন্তু অন্য সবার চেয়ে আবু রাওয়াশের পিরামিড আলাদা, কারণ এখানকার পিরামিডটি তৈরি করা হয়েছিল একটা পাহাড়ের উপর। পিরামিড তৈরিতে যে পাথরের ব্লক ব্যবহার করা হত, সেগুলো দৈত্যাকৃতি। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়া এত ভারী পাথরগুলোকে কীভাবে একে অন্যের উপর সাজিয়ে পিরামিড তৈরি হত, সেকথা ভাবলে এমসিনতেই মাথা ঘোরে। আবু রাওয়াশের পিরামিড যেহেতু পাহাড়ের উপর তৈরি, তাই আরও অবাক লাগে এই ভেবে যে, পিরামিড তৈরির ভারী-ভারী পাথরগুলো পাহাড়ের মাথায় তুলে আনল কে? কীভাবেই বা আনল?
আবু রাওয়াশের পিরামিড বিশেষ আরও এক কারণে। মিশরের এই একমাত্র পিরমিড, যার মাথাটা খোলা। অন্যান্য পিরামিড যেমন চারদিক দিয়ে বন্ধ আর সেগুলোর ভিতরে ঢোকা যায় একটা বা দুটো মাত্র সুড়ঙ্গপথ দিয়ে, এই পিরামিড একেবারেই তেমনটা নয়। পিরামিড চত্বরে হেঁটেচলে বেড়ালে দেখতে পাবে, ইতিউতি ছড়িয়ে আছে তিন রকমের পাথর। আকারে ছোট আর বয়সে নবীন পাথর, মাঝারি আকারের পাথর এবং বয়সে প্রাচীন আর বিশালকৃতি পাথর। দেখতে পাবে বহু গ্রানাইট পাথরের খণ্ড। এদের যে কোনও এককালে যন্ত্রের সাহায্যে নিখুঁত টানে কাটা হয়েছিল, পাথরগুলোকে খালি চোখে দেখলেই সেকথা বোঝা যায়। আর যদি সিঁড়ি বেয়ে মাথাখোলা পিরামিডের পেটের মধ্যে নেমে যাই? দেখতে পাব, একেবারে নীচের ধাপে পাথর কেটে তৈরি করা আছে মস্ত গর্ত। সেই গর্তে যে একসময় দাউদাউ করে আগুন জ্বলত, তা বুঝতে পারা যায় গর্তের আশপাশের পাথরগুলোয় কালো ছোপ দেখে। কিন্তু পাহাড়ের মাথায় একখানা মাথাখোলা পিরামিড তৈরি করে তার পেটের মধ্যে আগুন জ্বালানো দরকারটা কী ছিল? উত্তর এখনও অজানা।
ব্যান্ড অফ পিস
মিশরের উত্তর থেকে দক্ষিণে যেন সার দিয়ে পরপর দাঁড়িয়ে আছে ২২ খানা পিরামিড। এই সারির নাম রাখা হয়েছে ‘ব্যন্ড অফ পিস’. যার সবচেয়ে উত্তরে আবু রাওয়াশ পিরামিড আমরা ইতিমধ্যে ঘুরে এসেছি। মানচিত্রে এই পিরামিডের সারির দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এককালে নিশ্চয়ই নীল নদ বয়ে যেত পিরামিডগুলোর ঠিক পাশ দিয়েই। নদী থেকে পিরামিডগুলোয় পৌঁছানোর জন্য রাস্তাও ছিল। আজ নীল নদ আর ব্যন্ড অফ পিস-এর পিরামিডদের মধ্যে দূরত্ব প্রায় আট মাইল। আমরা জানি, যে-কোনও সভ্যতার সৃষ্টি এবং তার বাড়বাড়ন্তের পিছনে নদীর ভূমিকা ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তা হলে হাজার-হাজার বছর আগে যখন মিশরের মানুষ পিরামিড তৈরি করলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই নদী থেকে আট মাইল দূরে সেসব তৈরি করবেন না? এই সহজ যুক্তি আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতে বাধ্য করে যে নীল নদ একসময় বয়ে যেত পিরামিডগুলোর ঠিক পাশ দিয়ে। সেখান থেকে আট মাইল দূরে সরে যেতে নদীর কত সময় লাগল?
ভূতাত্ত্বিকরা বলেছেন, অতটা সরতে কোনও নদীর সময় লাগতে পারে ২০.৩০,৪০ কিংবা হয়তো ৫০ হাজার বছর! এদিকে আধুনিক মানুষের যে ইতিহাস আমরা জানি, তার সূচনা মোটামুটি ৬০০০ বছর আগে। নীল নদের গতিপথ পালটানোর এই হিসেব মেনে নিলে এ-ও মানতে হয় যে ২০,০০০ বছরেরও বেশি প্রাচীন সময়ে উন্নত বুদ্ধিধর মানুষ ছিলেন। আর তাঁরাই তৈরি করেছিলেন (অন্তত কিছু) পিরামিড।
গিজার তিন পিরামিড
ব্যান্ড অফ পিসের অন্য কোনও পিরামিডে যাওয়ার আগে আমরা অতি অবশ্যই ঢুঁ মারব বিখ্যাত গিজা মালভূমিতে, যেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে তিন-তিনখানা সুউচ্চ পিরামিড। তাদের ঠিক পাশেই সিংহের শরীর আর মানুষের মাথা নিয়ে হাজার-হাজার বছর ধরে অপেক্ষারত সুপ্রাচীন স্থাপত্য ‘স্ফিংস’।
তিন পিরামিডের মধ্যে সবচেয়ে বড় যেটা, সেই গ্রেট পিরমিড তৈরি হয়েছিল ১৩ একর বা প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ বর্গফুট জমির উপর। ওই একটি পিরামিড তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল ২৩ লক্ষ পাথর, যার এক-একটার ওজন ছিল ২০০ টন পর্যন্ত!
এই পিরামিডুগলো সম্পর্কে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন তিনটে। কবে তৈরি হল? কীভাবে তৈরি হল? আর কেন তৈরি হল? এদের উত্তর খোঁজার জন্য সবার আগে উলটেপালটে দেকার দরকার ছিল প্রাচীন মিশরীয় লিপি। প্যাপাইরাস গাছ থেকে তৈরি আদি কাগজ প্যাপাইরাস এবং পাথরের ব্লক, এই দুইয়ের উপর অনেক কিছুই লিখে রেখে গিয়েছেন প্রাচীন মিশরীয়রা। এদের মধ্যে অন্তত একটি প্যাপাইরাস এবং একটি পাথরের ব্লকে তাঁরা সাফ-সাফ লিখে দিয়েছেন, মিশরের সভ্যতার বয়স বহু-বহু প্রাচীন। মানে গোদা বাংলায়, আমরা যাঁদের প্রাচীন বলে ভাবছি, তাঁরা নিজেরাই বলে গিয়েছেন, যে তাঁদের চেয়েও প্রাচীন এবং বুদ্ধিমান মানুষ তাঁদের আাগে ছিলেন। আর এরই প্রমাণ ছড়িয়েছিটিয়ে আছে মিশরের সর্বত্র। গিজা মালভূমির তিন পিরামডি আর স্ফিংসের িইতিউতি আজও সেইসব প্রমাণ যেন গিজগিজ করছে। কীরকম?
স্ফিংস আগে, না পিরামিড?
গিজার গ্রেট পিরামিডের তলায়, মাটির নীচে আজও অক্ষত আছে সুড়ঙ্গপথ। পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, এই সুড়ঙ্গের বয়স গ্রেট পিরামিডের বয়সের চেয়ে অনেক-অনেক বেশি। প্রাচীন মিশরীয় লিপির হায়রোগ্লিফ অনুযায়ী, গিজার তিন পিরামিডের মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড় গ্রেট পিরামিড নয়, বরং আকারে দ্বিতীয় বৃহত্তম পিরামিডটিই ওখানকার মূল পিরামিড। উপরন্তু, এই দ্বিতীয় পিরামিডের একদম নীচের ধাপে আজও দেখতে পাওয়া যায় লাল গ্রানাইট পাথরের সারি। মিশরের অন্যান্য সৌধ যাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, তাঁরা বলছেন, পুরনো কোনও স্থাপত্যকে নতুন করে সাজানোর সময়ই প্রাচীন মিশরীয়রা অমন লাল গ্রানাইট পাথর ব্যবহার করতেন। যা থেকেও প্রামাণ হয় যে গিজা মালভূমির দ্বিতীয় বৃহত্তম পিরামিডটি সম্ভবত গ্রেট পিরমিডের চেয়েও প্রাচীন। প্রমাণিত হয় এ-ও যে, গিজা মালভূমির দ্বিতীয় আর তৃতীয় পিরামিডদু’টি দুই বা তারও বেশিবার সংস্কারের মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল। এত পুরনো কোনও জিনিস প্রথমে একবার তৈরি হওয়ার পর বেশ ক’বার সংস্কারের মধ্যে দিয়ে গেলে তার প্রকৃত বয়স ভীষণ নিশ্চিত করে বলা যায় কি?
রইল বাকি স্ফিংস। একটাই মাত্র পাথর কেটে বানানো, সিংহের শরীর আর মানুষের মাথাওয়ালা এই মূর্তি যখন প্রথমবার আমাদের চোখে পড়েছিল, বালির মধ্যে থেকে সে-সময় জেগেছিল শুধু মূর্তির মাথাটুকুই। খোঁড়াখুঁড়ি করে স্ফিংসের আস্ত চেহারাটা বেরিয়ে এলে পর দেখা গেল, স্ফিংসের গায়ে বহু বছরের জল আর বাতাসের ঝাপটার ছাপ প্রচুর। আলাদা করে চোখে পড়বেই বৃষ্টির জল বয়ে যাওয়ার ফলে স্ফিংসের ক্ষয়। বিশেষ করে স্ফিংসের অবস্থান যে চত্বরে, তার পিছন দিকের পাথগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, কোনও একাকলে তাদের উপর দিয়ে হুড়মুড়িয়ে বয়ে গিয়েছে ঝমঝম বৃষ্টির জল। মজার ব্যাপার, স্ফিংসের সামনেই আছে একটা পাথরের খাদান। গ্রেট পিরামিড তৈরিতে সেখানকার পাথরই ব্যবহার করা হয়েছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু ওই খাদান ওখানে থাকলে স্ফিংসের গায়ে অত ঝড়-জলের ঝাপটা লাগার কথা নয়। তা হলে কি স্ফিংস তৈরির সময় পাশে ওই খাদানটা ছিল না? সেটা খোঁড়া হয়েছিল অনেক পরে? সেক্ষেত্রে স্ফিংসের বয়স এক ধাক্কায় পিছিয়ে যাবে আরও কয়েক হাজার বছর! হয়তো এই অবিশ্বাস্যতার জন্যই স্ফিংসের অতিপ্রাচীনত্ব সংক্রান্ত এই মতামত পৃথিবীর বহু ভূতাত্ত্বিকের না-পছন্দ।
আকাশ দেখার জন্য?
এতক্ষণ দিনের আলোয় সব আলোচনা হয়েছে। এবার আমরা পিরামিড চত্বরে যাব রাত নামার পর। রাতের আকাশ বরাবরই মানুষের কাছে এক বিস্ময় হয়ে থেকেছে। আজ প্রযুক্তির উন্নতির চোটে আমরা এমনকী, সশরীরেও মহাকাশে পাড়ি দিয়েছি, যার নেপথ্যে আছে আধুনিক মানুষের কয়েকশো বছরের কষ্টার্জিত বিজ্ঞান। মিশরে আমাদের রহস্যময় পূর্বপুরুষেরা সেই অবধি পৌঁছেছিলেন কিনা জানা নেই, তবে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে তাঁদের আগ্রহের প্রমাণ পাওয়া যায় গিজা মালভূমির তিন পিরামিড আর স্ফিংসের অবস্থানের দিকে তাকালে। মিশরের রহস্যভেদের জন্য যাঁরা দিবারাত্র মাথা ঘামিয়ে চলেছেন, তাঁদের অনেকেরই বিশ্বাস, গিজার তিন পিরামিড আর স্ফিংসের সঙ্গে যোগ ছিল রাতের আকাশের। কীরকম?
গ্রেট পিরামিডের ভিতরে গ্রান্ড গ্যালারি নামের একটা অংশের ছাদ খোলা। ওই অংশটায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকালে পৃথিবীর আবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে আকাশে তারার বিন্যাসে কী-কী পরিবর্তন হচ্ছে, তা দেখা যায় দিব্যি। মিশরীয়রা সেখান থেকেই আকাশের তারাদের দিকে নজর রাখতেন, তাঁর উল্লেখও সেখানকার প্রাচীন নথিপত্রে পাওয়া গিয়েছে। রাতের আকাশে কালপুরুষ নামের তারামণ্ডলের দিকে তাকিয়ে দেখেছ তো কখনও? কোমরবন্ধনী পরা এক শিকারী উদ্যত তলোয়ার নিয়ে শিকারে বেরিয়েছে যেন রাতের আকাশে কালপুরুষ আর মানচিত্রে গিজা মালভূমির দিকে যদি পরপর তাকা, তা হলে বোঝা যায়, গিজার ওই তিন পিরামিড যেন কালপুরুষের কোমরবন্ধনীর তিনটে তারার অবস্থান দেখে বানানো। স্ফিংসের মুখ এমন দিকে, যেন সে ঠায় বসে নজর রেখেছে পৃথিবীর তারামণ্ডলের দিকে।
এবার কথা হল, সূর্য এবং অন্যান্য তারাদের নিয়ে প্রাচীন মিশরীয়দের আগ্রহের প্রমাণ আমরা তাঁদের লেখাপত্তরে ভূরি-ভূরি পেয়েছি। সূর্যসহ অন্য বেশ কিছু তারাকে তাঁরা দেবতা মেনে পুজোও করতেন। গিজার তিন পিরামিডের অবস্থান এমন যে আজও বছরের আলাদা-আলাদা সময়ে কখনও সেখানে সূর্য অস্ত যায় প্রথম আর দ্বিতীয় পিরামিডের মাঝের অংশ দিয়ে। কখনও আবার দ্বিতীয় আর তৃতীয়র মাঝের অংশ দিয়ে। সূর্যের চলন লক্ষ করে মিশরীয়রাও ৩৬৫ দিনের সৌর-ক্যালেন্ডার ব্যবহার করতেন। মিশর নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন, তাঁদের অনেকেরই বিশ্বাস, সূর্যের গতির সঙ্গে নীলনদের বন্যার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছিলেন প্রাচীন মিশরীয়রা। যেহেতু নীলনদের বন্যার সঙ্গে তাঁদের চাষবাস এবং জীবনধারণ জড়িত ছিল, তাই বিপুল অর্থ ও পরিশ্রম করে সূর্য এবং অন্যান্য তারার চলন লক্ষ করার জন্য তাঁরা এই দৈত্যাকৃতি স্থাপত্যগুলো বানিয়েছিলেন, এমনটাও হতেই পারে। অবিশ্বাসীরা যতই মাথা নেড়ে এ তত্ত্ব নাকচ করুন না কেন, একে গাঁজাখুরি দেগে দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায় না কিছুতেই।
আবু গরাব
গিজা থেকে এবার আমরা যাব আরও প্রায় ১৩ কিলোমিটার দক্ষিণে, আবু গরাব নামের এক জায়গায়। পাণ্ডববর্জিত এই এলাকায় এখন গেলে দেখতে পাবে সূর্যমন্দিরের ধ্বংসস্তূপ। এখানেই পাওয়া গিয়েছে মিশরের সবচেয়ে বড় ওবেলিস্কের ভগ্নাবশেষ। ও হ্যাঁ, ওবেলিস্ক কী জিনিস, তা জান তো? পাথর কেটে বানানো লম্বা স্তম্ভ, যার চারতে তল থাকবে আর মাথার উপরটা সাধারণত হবে একটা ছোট্ট পিরামিড আকারের। সারা মিশরে পিরামিড আর মন্দিরের ছড়াছড়ির মধ্যে এমন ওবেলিস্কও চোখে পড়বে বহু, যারা হাজার-হাজার বছরের ঝড়-ঝাপটা-ভূমিকম্প সামলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঠায়। আবু গরাবের ওবেলিস্ক অবশ্য ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। ওই চত্বরটায় এখন পা রাখলে সবার আগে চোখে পড়বে সামনে এটা বেদির উপর। সমস্ত বেদিটাই কোয়ার্টজ ক্রিস্টাল দিয়ে তৈরি, যাকে আমারা বাংলায় বলি স্ফটিক। বেদি থেকে উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব আর পশ্চিম দিকে মুখ করে চারটে প্রসারিত অংশ দেখতে পাবে, যেগুলোও স্ফটিক দিয়েই তৈরি। আর বেদির ঠিক মাঝে আছে ছ’ফুট ব্যাসের নিখুঁত গোলাকার একটা পাথর। একমাত্র লেজারের সাহায্য ছাড়া কোনও পাথরকে কীভাবে এত নিখুঁত গোল আকারে কাটা যায়, আমাদের আজও জানা নেই। মন্দির চত্বরে ছড়িয়েছিটিয়ে ছিল স্ফটিকের তৈরি কিছু বিশালাকৃতি বেসিন, যেগুলো এখন ওখানেই পাশাপাশি সার দিয়ে দাঁড় করানো আছে। স্ফটিকের বেসিনগুলোর গায়ে আবার দেখা যায় এক বা একাধিক গোলে ফুটো। কী হত এই বেসিনগুলোয়? কেউ-কেউ বলেন, মিশেরের সূর্যদেবতা রা-কে সন্তুষ্ট করার জন্য পশুবলি দেওয়া হত এই বেসিনগুলোয়। যদিও ওই চত্বরের কোথাও নিদেনপক্ষে ছোটখাট কোনও অস্ত্রও খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে এই পশুবলির গল্পটা অনেকেরই অপছন্দের। আর ওই ওবেলিস্ক? সারা মিশর জুড়ে জায়গায়-জায়গায় ওরকম আখাম্বা স্তম্ভ তৈরির দরকারটা কী ছিল? সেই রহস্যের সলতে আর-একটু উসকে দিয়েই শেষ করব এই অনুসন্ধান।
নিখরচার বিদ্যুৎ?
পৃথিবী নিজেই একটা মস্ত বড় চুম্বক, জান তো? নিরন্তর নিজের অক্ষের চারদিকে পাক খেতে-খেতে যে চুম্বক প্রদক্ষিণ করছে সূর্য নামের তারাকে। ওদিকে পৃথিবীর পেটের মধ্যে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে গলিত লোহা। মূলত সেই ঘোরাফেরার ফলে পৃথিবীতে তৈরি হয় খুব দুর্বল তড়িচ্চুম্বক ক্ষেত্র। মিশর-বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই বিশ্বাস, পৃথিবীতে তৈরি হওয়া ওই ক্ষীণ তড়িচ্চুম্বক ক্ষেত্রের শক্তি বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হত পিরামিডকে। মিশরের বহু পিরামিডের তলাতেই মাটির নীচে সুড়ঙ্গের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। পাওয়া গিয়েছে ছিদ্রবহুল পাথরের স্তর (অ্যাকুইফার)। অনেকে মনে করেন, নীল নদের বন্যার কারণে এই ছিদ্রবহুল পাথরের স্তরে ঢুকে পড়ত বন্যর জল। পাথরের মধ্যে দিয়ে তা বয়ে যাওয়ার সময় তৈরি করত ক্ষীণ শক্তির বিদ্যুৎ। পিরামিডের মধ্যে তৈরি করে রাখা সুড়ঙ্গগুলোতেও বুদ্ধি করে এমনভাবে নানা রকম পাথরের স্তর (বিশেষ করে গ্রানাইট) রাখা হত যাতে ওই ক্ষীণ বিদ্যুৎ ক্রমশ উপরের দিকে উঠতে-উঠতে নিজের শক্তি বাড়াতে পারে। গ্রানাইটই কেন? খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, গ্রানাইট যে-সে পাথর নয়। ওর মধ্যে আছে সামান্য তেজস্ক্রিয়তা। প্রাচীন মিশরীয়রা সেকথা জানতেন বলেই নিশ্চয়ই পৃথিবীর তড়িৎশক্তির প্রাবাল্য বাড়ানোর কাজে তাঁরা ব্যবহার করতেন গ্রানাইট। এভাবে যে বিদ্যুৎশক্তি পাওয়া গেল, তা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। তার জন্য পরিবেশ দূষিত হল না। আর কী আশ্চর্য দেখো, পিরামিডের ভিতর ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকলেও কোথাও মশাল বা আগুন জ্বালানোর ফলে তৈরি হওয়া ঝুলকালির দাগ কিন্তু দেখা যায় না। তা হলে কি প্রাচীন মিশরীয়রা পিরামিডের সাহায্যেই তৈরি করেছিলেন অফুরন্ত পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎশক্তি? ওঁদের আঁকা কিছু-কিছু দেওয়ালচিত্রেও দেখা গিয়েছে ইলেকট্রিক বালবের আকারের যন্ত্রপাতি। কিন্তু সেগুলো কি সত্যিই বালব? প্যাপাইরাস বা পাথরের গায়ে সেকথা স্পষ্ট করে লিখে যাননি কেউ। ফিরে আসি এই যুগে। ১৯০১ সালে নিকলো টেসলা নামের এক বিজ্ঞানী মার্কিন মুলুকে তৈরি করেছিলেন টেসলা টাওয়ার নামের এক বিশেষ স্তম্ভ। টেসলার বিশ্বাস ছিল, এই টাওয়ারের সাহায্যে সারা পৃথিবীর মানুষকে তিনি নিখরচায় বিদ্যুৎ জোগাতে পারবেন। কিন্তু বিদ্যুৎ তৈরি করে ও বেচে যে ব্যবসায়ীদের দিন গুজরান হয়, তাঁরা মোটেও নিখরচার বিদ্যুতের ধারণাটা মেনে নিতে পারলেন না। ফলে ১৯০৬ সালে পর্যপ্ত অনুদানের অভাবে বন্ধ হয়ে গেল টেসলা টাওয়ার। মিশর-বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, নিকোলা টেসলার ওই টেসলা টাওয়ারেরই আদি এবং সুবিশাল সংস্করণ ছিল মিশরের পিরামিড। তাঁদের ধারণা, বিদ্যুৎ তৈরির এই কাজেই ব্যবহৃত হত ওবেলিস্ক নামের লম্বা পাথরগুলোও।
আমরা ঠিক কত প্রাচীন?
দক্ষিণ আমেরিকার মায়া এবং ইনকো সভ্যতার বহু সৌধ। ইংল্যন্ডে স্টোনহেঞ্জ। মিশরের পিরামিড এবং অন্যান্য সৌধ। সবগুলোই সুপ্রাচীন। সবগুলোর সঙ্গেই যোগ আছে আকাশের গ্রহ আর তারাদের। ভারতেও সেই একই সময়ে বসে হিন্দু মুনি-ঋষিরা যা লিখে গিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে মিল পাওয়া গিয়েছে পৃথিবীর নানা জায়গার উন্নত সভ্যতাদের। দেখা গিয়েছে, হাজার-হাজার বছর আগের এই উন্নত সভ্যতাগুলোর পণ্ডিতরা সকলেই বলে গিয়েছেন ২৬,০০০ বছরের একটা চক্রের কথা। হিন্দুদের শাস্ত্র অনুযায়ী এই ২৬,০০০ বছরের চক্রেই ঘুরেফিরে আসে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগ। প্রাচীন মিশরীয়রাও মনে করতেন, ওই ২৬,০০০ বছরে পালা করে-করে আসে স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ এবং লৌহ যুগ। রাতের আকাশের তারাদের চলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এই সময়চক্রের কথা বলে গিয়েছেন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোও। এই সময়চক্রকে সত্যি বলে মানলে মিশরের স্ফিংস তৈরির সময় গিয়ে দাঁড়ায় ৩৬,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে! মানে আজ থেকে প্রায় ৩৮,০০০ বছর আগে! অবিশ্বাসীদের কথা ছেড়েই দিলাম, আমাদের পক্ষেও এটা মেনে নেওয়া খুব একটা সহজ নয়। এত বছর আগে কীভাবে তৈরি হল সুবিশাল এইসব সৌধ? তা হলে কি সুপ্রাচীন মানুষ এমন কিচু জানতেন যা আমরা জানতে পারিনি আজও?
কেউই পারিনি, তা অবশ্য বলা ভুল। ১৯২০ সালে উত্তর আমেরিকার ফ্লোরিডায় এডওয়ার্ড লিডসকালনিন নামে এক ভদ্রলোক তৈরি করে ফেললেন চুনাপাথরের এক বিশাল দুর্গ। পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে সেখানে ঢুকে সবাই অবাক হয়ে দেখলেন, বহু টন ওজনের এক-একটা পাথরকে ভদ্রলোক কীভাবে কে জানে, সাজিয়ে রেখেছেন ইডিউতি। ফ্লোরিডার ওই এলাকায় সে আমলে খুব বেশি মানুষ থাকতেন না। ফলে দুর্গ তৈরির সময় এডওয়ার্ড কীভাবে পাথরগুলো সরালেন, তা নিজের চোখে দেখতে পাননি প্রায় কেউই। আর এডওয়ার্ড নিজে? সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি শুধু জানালেন, “মিশরের পিরামিড তৈরির রহস্য আমি জানি। ওটা জানলে এসব বানানো কোনও ব্যাপারই নয়।”
কিন্তু কী সেই রহস্য? এডওয়ার্ড কিছুতেই তা ফাঁস করলেন না। ফলে পিরামিড ‘কেন বানালেন’ আর ‘কবে বানালেন’, - এর উত্তর। কবে যে জানতে পারব, জানা নেই তা-ও।



0 মন্তব্যসমূহ