হাঙর মানেই খুনি নয়
একটা ভালুক কি মানুষকে আক্রমণ করতে পারে? খিদে পেলে করতেই পারে। বাঘ নাকি এমনিতে মানুষকে আক্রমণ না-করলেও একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে মানুষখেকো হয়ে ওঠে। কিন্তু ডায়নোসরদের চেয়েও ঢের আগে থেকে এই পৃথিবীর বাসিন্দা হাঙররা? জলের তলার বড়সড় চেহারার এই প্রাণী কি তার ধারালো দাঁত আর ক্ষিপ্রগতির সাহায্যে মানুষকে আক্রমণ করতে পারে? এই ছোট্ট প্রশ্নটা এককালে মানুষকে এত ভাবিয়েছে যে ১৮৯১ সালে নিউ ইয়র্কের এক কোটিপতি, হারমান ওলরিক্স ঘোষণা করলেন, কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে কোনও হাঙর মানুষকে আক্রমণ করেছে, নিজের পকেট থকে সঙ্গে-সঙ্গে তাকে তিনি ৫০০ ডলার পুরষ্কার দেবেন। আজকের দিনে যা প্রায় ১০ লক্ষ ভারতীয় টাকার সমান। ছোট্ট অথচ গুরুতর সেই প্রশ্নের একটা উত্তর পাওয়া গেল বটে। তবে ততদিনে এদেশে গঙ্গা আর ওদেশে হাডসন নদী দিয়ে বয়ে গিয়েছে বহু জল, কেটে গিয়েছে পাক্কা ২৫ বছর.....
‘আতঙ্কের ১২ দিন’
উত্তর আমেরিকার উত্তর-পূর্বদিকে, নিউ জার্সির মনোরম সমুদ্রসৈকগুলোয় সেসময় ছুটি কাটাতে আসতেন এমনকী, মর্কিন প্রেসিডেন্টও। ১৯১৬ সাল, আমেরিকায় সেবছর খুব গরম পড়েছে আর চারদিকে পোলিয়োর প্রাদুর্ভাবও সেবছর ভীষণ। সারা সপ্তাহের ক্লান্তি মেটাতে তখন নিউ জার্সির সমুদ্রসৈকতে ভিড় করেছেন প্রচুর মানুষ। সেবছল জুলাই মাসের ১-১২ তারিখ ওই সৈকতগুলোয় হাঙরের হামলায় চার ব্যক্তি প্রাণ হারালেন। এক ভাগ্যবান প্রাণে বেঁচে গেলেও হাঙরের কামড়ে গুরুতর জখম হলেন। ঘটনাগুলো শুনে মনে হচ্ছিল, এর জন্য দায়ী একাধিক নয়, বরং মাত্র একটিই ধূর্ত হাঙর! সারা আমেরিকায় পড়ে গেল তুমুল হইচই, খুনে হাঙরের রক্তপিপাসার খবর গিয়ে পৌঁছল স্বয়ং প্রেসিডেন্টের কানেও! খবরের কাগজে লেখা হল শিরোনাম, ‘টুয়েল্ভ ডেজ অফ টেরর’! হাঙরের তো নানা রকমফের আছে। খুনি ধরা পড়ার আগে তািই কেউ সন্দেহ করলেন, এর পিছনে আছে কোনও বুল শার্ক। কেউ বললেন, নাহ, এ কাজ নির্ঘাত কোনও টাইগার শার্কের। শেষে এক টাইগার শার্ককেই মেরে দেখা গেল, তার পেটে তখনও মানুষের দেহাবশেষ! বোঝা গেল, এই সেই খুনি।
জল্পনা>উপন্যাস>সিনেমা
তারপর থেকে জল্পনাটা চলতেই থাকল। হাঙর কি মানুষ দেখলেই তেড়ে এসে কামড়ে খেতে চাইবে? হলিউডে হাঙর শিকার আর খুনি হাঙর নিয়ে বহু আজগুবি সিনেমাও তৈরি হতে থাকল। অবশেষে দীর্ঘদিনের এই জল্পনার ধিকিধিকি আগুনকে দাউদাউ করে তুললেন পিটার বেঞ্চেলে আর স্টিভেন স্পিলবার্গ নমে দুই ভদ্রলোক। প্রথমজন খুনি হাঙরের হামলা নিয়ে ১৯৭৪ সালে ‘জজ’ নামে একটা উপন্যাস লিখলেন। বছর না-ঘুরতে সেই বইয়ের তুমুল বিক্রি দেখে চিত্রপরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ একটুও দেরি না করে ঠিক তার পরের বছর, ১৯৭৫ সালে ওই উপন্যাস অবলম্বনে ‘জজ’ নামে একটা ছবি বানিয়ে ফেললেন। ব্যাস, মেরুদণ্ড দিয়ে হিমস্রোত বইয়ে দেওয়া সেই উপন্যাস আর তা অবলম্বনে বানানো ছবি, দুয়ের চূড়ান্ত সাফল্য সারা পৃথিবীর লোকজনের মনে মানুষের উপর হাঙরের আক্রমণ নিয়ে ঢুকিয়ে দিল অমূলক ভয়, আজকাল যার পোশাকি না ‘গ্যালিয়োফোবিয়া’।
ভয় এবং ভোজন
‘জজ’ - এর তুমুল সাফল্যের চোটে মানুষের মনে এমন ভয় ঢুকল যে ছবি মুক্তির পরের ক’বছর, বিশেষ করে আমেরিকায় এবং সারা পৃথিবীতেই মানুষ নিছক বীরত্ব দেখাতে সমুদ্রে গিয়ে হাঙর মারতে শুরু করল। হাঙর মারতে এমনিতেও কোনও নিষেধ ছিল না কোথাও। মারতে পারলে একে তো ‘ওহ! কত সাহস! মানুষ মারবে ভেবেছিল না? ধরেছি ওদের এক ব্যাটাকে!’ বলে বেশ কলার তোলা যাবে, পাশাপাশি পাড়াপড়শিরাও চিরকাল সেই শিকারিকে মানুষের উদ্ধারকর্তা বলে সম্মান দেবে। ওদিকে এশিয়ার পূর্বদিকে অর্থনীতি ক্রমশ জোরদার হওয়ায় সেখানকার মানুষের হাতে ধীরে-ধীরে টাকাপয়সা বাড়ছিল। তাঁরা একদিন চেখে দেখলেন শার্কের পাখনা বা ডানার সুপ। ভীষণ সুস্বাদু সেই সুপের চাহিদা যত বাড়ল, দল বেঁধে, একেবারে দিনের আলোয়, নৃশংসভাবে হাঙরদের হত্যা করাও বাড়ল পাল্লা দিয়ে। ডাঙার বাঘ-সিংহের মতোই জলের তলার বড়সড় চেহারার শিকারী প্রাণী হাঙরদের কফিনে প্রথম পেরেক পুঁতেছিলেন ওই লেখক-চলচ্চিত্রকার জুটি। শেষ পেরেক পুঁতল ওদের এই বাণিজ্যিক নিধনযজ্ঞ। সেই হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিক বিবরণ শুনলে আর কারও কষ্ট না হোক, তোমার-আমার হবে জানি, তাই সে লজ্জাজনক বর্ণনায় আর না-ই বা ঢুকলাম......
পরিবেশে কী প্রয়োজন?
সবার আগে এটা বোঝা প্রয়োজন যে পরিবেশে আনুবীক্ষণিক জীব থেকে শুরু করে দৈত্যাকার প্রাণী, প্রত্যেকের নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে, যা ঠিক করে দিয়েছে প্রকৃতি। হাঙরের ৪০০-রও বেশি প্রজাতি, যেমন, মরণাপন্ন, অসুস্থ এবং অবশ্যই সুস্থ সামুদ্রিক প্রাণীদেরও শিকার করে খেয়ে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করে ।সেই কথাটা না-বুঝে উন্মত্তের মতো ওদের মারতে থাকলে তাতে সামগ্রিকভাবে সারা পৃথিবীর সমুদ্রের সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। যা আমরা ইতিমধ্যেই দিয়েছি। প্রতি বছর মানুষের হাতে প্রায় তিন থেকে সাত কোটি হাঙর মারা যায় এখনও। হাঙরদের মেজাজ ওদের চেহারা এবং উন্নত ইন্দ্রিয়শক্তির মতোই রাজকীয়। ফলে ওরা সমুদ্রের এক জায়গায় স্থির না-থেকে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে বেড়ায় ইচ্ছেমতো। তাই সমুদ্রে হাঙর শিকাারে নিষেধাজ্ঞা বলবত করতে গেলে অনেকটা জায়গা জুড়ে নজরদারি চালানোর প্রয়োজন। সেও কি সহজ কাজ? ওদের বাঁচাতে তাই কড়া আইনের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন আমাদের শুভবুদ্ধির।
কেন সংঘাত বেড়েছে?
১৯৭৫ সালে ‘জজ’ সিনেমা মুক্তির পর বিশ্বজুড়ে হাঙর নিধন এমন তীব্র আকার নিয়েছিল যে, ‘জজ’ উপন্যাসের লেখক পিটার বেঞ্চলে অনুতপ্ত হয়ে নিজের বাকি জীবনটা হাঙরদের সংরক্ষণে ব্রতী হয়ে কাটিয়ে দেন। তবুও, ২০০৬ সালে তাঁর মৃত্যুর ন’বছর পর, ২০১৫ সালে যখন উত্তর আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনায় হাঙর মানুষকে অন্তত আটবার আক্রমণ করেছে শোনা গেল, মানুষের মনে ফিরে এল তাঁর উপন্যার আর তা থেকে বানানো ছবিতে দেখানো আতঙ্কই। ২০১৫-য় বিশ্বের নানা প্রান্তে হাঙরের আক্রমণের অন্তত ৯৮ টি খবর পাওয়া গেল। চিন্তার ব্যাপার, এই সংখ্যাটা বছর-বছর বাড়ছে। সঙ্গে রটছে, ওরা নাকি জলের তলায় আমাদের পাতা ইন্টারনেটের তার কেটে দিচ্ছে, এমন নান মিথ্যে, গুজব। কিন্তু কেন? পরিবেশবিদরা বলছেন, এর জন্য দায়ী হাঙররা কম আর আমরা বেশি। বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ক্রমশ পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ায় এবং দিন-দিন এই গ্রহে মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকায় একদিকে সমুদ্রসৈকতগুলোয় মানুষের ভিড় বেড়েছে। অন্যদিকে বিশেষ করে বড়-বড় সামুদ্রিক প্রাণীদের নির্বিচারে শিকার করে মানুষ সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে এমন নড়বড়ে করে দিয়েছে যে হাঙরের মতো বড় শিকারি প্রাণীরা কোথাও-কোথাও খুদে মাছ কিংবা সিল ছেড়ে সহজ শিকার মানুষে মজেছে।
তা হলে? উপায় কী?
আমরা ওদের মারছি বছরে তিন থেকে সাত কোটি। আর ওরা আমাদের হামলা করছে বছরে বড়জোর ১০০বার। ওরা আছে ওদের পাড়াতেই, আমরাই বারবার ওদের পাড়ায় ঢুকে ঝামেলা পাকাচ্ছি। ওরা কেউ কখনও খিদের চোটে আমাদের মেরে খেতে চেয়েছে। আর আমরা অন্য অনেক খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও ওদের কেটেকুটে খাওয়ার ব্যবসা ফেঁদে বসে ওদের উজাড় করেছি প্রায়! তা হলে তোমরাই বলো, বেশি বিপদে আছে কারা? এতদিনে তাই মনে হয় সময় এসেছে, ওদের দিক থেকেও পরিস্থিতিটা ভেবে দেখার।
উপায় তাহলে কী? হাঙর বললেই আমাদের মনে যে ধারালো দাঁতের, ক্ষিপ্রগতির খুনে শিকারির ছবি ভেসে ওঠে, বাস্তব পরিস্থিতি যে তার ঠিক উল্টো আমরাই যে ওদের পক্ষে অনেক বেশি ভয়ানক প্রাণী, একথাটা নিজেরা বুঝতে হবে আর আশপাশের ছোট-বড় সবাইকে বুঝিয়ে বলতে হবে। আমি-তুমি যাদের বোঝাব, তারা আবার নিজেদের আত্মীয়-বন্ধুদের কথাগুলো বুঝিয়ে বলবে। এভাবেই একদিন সামগ্রিকভাবে আমাদের বুঝতে হবে যে হাঙররা খুনে শিকারি কম, নিজেরােই বিপন্ন এবং অবশ্যই পরিবেশের পক্ষে উপকারী প্রাণী বেশি। তবেই না দূর হবে অমূলক গ্যালিয়োফোবিয়া। তবেই না প্রকৃতির ইচ্ছে মেনে, জলের তলায় হাঙর আর ডাঙায় মানুষ, কোনও সংঘাত ছাড়াই যে যার দুনিয়ায় হেসে-খেলে বেড়াবে পাশাপাশি!

0 মন্তব্যসমূহ