আমরা রংধনু কেন দেখি?
সকাল বেলায় ঘুম
থেকে উঠে যে দিকেই চোখ মেলে তাকাও দেখবে আলো। শুধু আলো, আর আলো: আকাশে আলো, গাছের পাতায়
আলো, নদীর ঢেউ-এ আলো-চারিদিকে শুধু আলো। কিন্তু হঠাৎ যদি প্রশ্ন ওঠে, ‘আলো কি?’ –
তাহলে নিশ্চয়ই বেশ অসুবিধায় পড়ে যাবে: ভাবতে ভাবতে এত পরিচিত আলোকেও হয়তো অনেক অচেনা
বলে মানে হবে। না তাতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। যে আলো অবিরাম পৃথিবীর মাটিতে এসে পড়ছে,
স্মরণাতীত কাল থেকে মানুষ তার আসল চেহারাটা আবিষ্কার করতে চেয়েছে। কত চিন্তাশীল মানুষ
সমস্ত জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন এই চিন্তায়! এমন কি নিউটন, আইস্টাইনের মত দিকপাল বিজ্ঞানীরাও
আলো সম্বন্ধে মাথা ঘামিয়েছেন, আর তাঁদের অমূল্য চিন্তার ফসল জমা পড়েছে বিজ্ঞানের ভান্ডারে।
জ্ঞানের আলোয় মানুষ আলোকে আজ নতুনভাবে চিনেছে।
তা সে বিজ্ঞান
যাই বলুক, আলো বলতে আমরাও তো কিছু একটা বুঝি। আলো বলতে আমরা কি বুঝি? খুব সহজ কথায়
বললে, ‘আলো বলতে আমরা এমন একটা কিছুকে বুঝি যা কোন জিনিসের ওপর এসে পড়লে আমরা স্পষ্ট
দেখতে পাই। অন্ধকার ঘরের জানলা খুলে দাও, আলো এসে পড়বে; আর স্পষ্ট হয়ে উঠবে ঘরের প্রতিটি
জিনিস। এই হল আলোর ধর্ম। আমাদের চোখে আলোকে আমরা এই-ভাবেই জানি। কিন্তু বিজ্ঞানের চোখে
আলোর সংজ্ঞাটা আরো একটু ব্যাপক; যেমন ধরো আমরা যাকে তাপ বলি, বিজ্ঞান তাকেও আলো বলে।
শুধু তাপই নয় এমন আরো অনেকরকম আলো বিজ্ঞানের চোখে ধরা পড়েছে, যা আমাদের সাধারণ চোখ
দিয়ে আমরা দেখতে পাই না। কিন্তু প্রশ্ন হল, তাহলে বিজ্ঞান তাকে আলো বলবে কেন? বিজ্ঞানের
তো আর সত্যি সত্যি চোখ নেই।
না, তা অবশ্য
নেই। তবে বিজ্ঞানের আছে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা, আর তার ফলেই বিজ্ঞান এমন সব আলোর
সন্ধান পেয়েছে, যা মানুষের চোখে ধরা পড়ে না। এইরকম একটা পরীক্ষার কথা তোমরা হয়ত অনেকেই
জান। সূর্যের আলো বিশ্লেষণের পরীক্ষার কথাই আমি বলছি। জানালার ছিদ্র দিয়ে আলো এসে ঘরে
ঢুকেছে। বিজ্ঞানী তার সামনে একটি ত্রিকোণ কাঁচের টুকরো তুলে ধরলেন। ত্রিকোণ এই কাঁচটির
বৈজ্ঞানিক নাম প্রিজম। আলোর সামনে এই প্রিজমটা তুলে ধরলে বিজ্ঞানী দেখতে পাবেন – ঐ
কাঁচটার মধ্যে দিয়ে যাবার সময় সূর্যের আলোয় এক অদ্ভূত পরিবর্তন ঘটে, আর তার ফলে সাদা
আলোর বদলে দেওয়ালের গায়ে রংধনুর মত সারি সারি সাতটি বিভিন্ন রঙের আলোর ফালি ফুটে ওঠে।
একে বলে ‘বর্ণালী’। আকাশে যে রংধনু ওঠে, ঠিক তারই মত বর্ণালীতেও প্রথমে থাকে বেগুনী
রঙ, তারপর নীল, তারপর আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা এবং অবশেষে থাকে লাল রঙ। রংধনু সঙ্গে
বর্ণালীর তফাৎ হল – রংধনু ওঠে আকাশের গায়ে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে,
আর বর্ণালী ফুটে ওঠে পরীক্ষাগারে দেওয়ালের গায়ে কিংবা সাদা পর্দার ওপর, আর তার রঙের ফিতেগুলো বাঁকা নয় – পুরোপুরি সোজা।
এটা কি ভাবে
হয়? এত রঙ কোথা থেকে আসে? তোমরা হয়ত ভাবছো কাঁচটার থেকেই এই সব রঙ-বেরঙের আলো বেরিয়ে
এসেছে; ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই তা নয়। ছেলেবেলায় আমারও প্রথমে মনে হয়েছিল যে, এটা বোধহয়
ঐ প্রিজমটারই কারসাজি; কিন্তু বিজ্ঞানের বই পড়ে ধারনাটা এখন একেবারে পাল্টে গেছে। ব্যাপারটা
আসলে একটু অন্যরকম। রঙগুলো ঐ সূর্যের আলোর মধ্যেই মিশে ছিল: প্রিজম তাদের আলাদা করে
দিয়েছে মাত্র। তার কারসাজি শুধু ঐটুকুই। যেমন স্কুলে যাবার পথে ছেলেরা থাকে মিলে মিশে।
তখন, কে ক্লাস ফাইভের ছেলে আর কে ক্লাস সেভেনের – তা আলাদা ভাবে বুঝে ওঠা কঠিন; কিন্তু
স্কুলের দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকেই ছেলেরা যে যার শ্রেনী অনুসারে নিজেরাই আলাদা হয়ে যায়।
বড় ছেলেরা যায় উঁচু ক্লাসের দিকে আর শিশু-শ্রেনীর দিকে চলে যায় চলে যায় সবচেয়ে ছোট
ছোট শিশুর দলটি। যারা একসঙ্গে মিশে ছিল তাদের আর আলাদাভাবে চিনতে কষ্ট হয় না।
তাহলে কি বিভিন্ন
রঙের আলোর মধ্যেও এরকম শ্রেণী বিভাগ আছে? কিন্তু কথা হল, আলোরা তো আর ছেলেদের মত স্কুলে
পড়ে না! তাহলে তাদের শ্রেনী-বিভাগটা হবে কি করে?
এটা বুঝতে গেলে,
আলে কি-সেটা আগে জানা দরকার। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এবং আলোর আচার-আচরণ লক্ষ্য
করে এক সময় বিজ্ঞানীদের ধারণা হয়েছিল যে, আলো আসলে এক রকমের ঢেউ। আমরা জানি নদীতে বা সমুদ্রে যে ঢেউ ওঠে, সে ঢেউ
হল জলের ঢেউ। শব্দ যে বাতাসের ঢেউ, বৈজ্ঞানিকরা তাও জানতেন। কিন্তু প্রশ্ন হল আলো কোন
সমুদ্রের ঢেউ। পৃথিবীর মাত্র একশ্যে মাইল ওপরে বায়ু-সমুদ্র খুব পাতলা হয়ে ক্রমশঃ শূন্যে
বিলীন হয়ে গেছে। তাহলে কোন সমুদ্র পার হয়ে কোটি কোটি মাইল দূরের তারার আলো পৃথিবীতে
এসে পৌঁছাচ্ছে? বিজ্ঞানীরা কল্পনা করলেন, যাকে শূণ্য বলে মনে হয়, তা আসলে সত্যি সত্যিই
শূন্য হয়। তাঁরা বললেন, প্রকৃতপক্ষে এই বিশ্বব্রহ্মান্ডটা একটা অদ্ভূত সমুদ্রে ডুবে
আছে, আর আলো হচ্ছে এই সমুদ্রের ঢেউ। এই সমুদ্রের জল নেই, বাতাশও নেই, আছে ইথার নামে
এমন একটা জিনিস, যা ঐ বিরাট আকাশটার প্রতিটি আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে, ছড়িয়ে আছে সমস্ত
গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতিটি অনু-পরমাণুতে। বায়ুর তরঙ্গ আমাদের কানের পর্দায় এসে আঘাত করলে
আমরা শব্দ শুনতে পাই, আর ইথার-তরঙ্গ আমাদের চোখে এসে লাগলে আমরা দেখতে পাই। শব্দের
যেমন রকমফের আছে-কোনোটা সরু, কোনোটা মোটা, আলোরও তেমনি নানান রঙ আছে। লাল আলোর সঙ্গে
বেগুনী আলোর তফাৎ শুধু একটাই: লাল আলোর ঢেউ-গুলো বেগুনী আলোর ঢেউয়ের চেয়ে অনেক বড়।
নদীর ঢেউএর সঙ্গে সমুদ্রের ঢেউএর যা তফাৎ। আমরা যে আলো দেখতে পাই, বেগুনী আলোর ঢেউএর
দৈর্ঘ্য তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম। আসমানী আলোর তরঙ্গ তার চেয়ে একটু বড়। নীল আলোর তরঙ্গ
দৈর্ঘ্য আরো একটু বড়; এইভাবে ক্রমশঃ সবুজ, হলুদ, কমলা এবং লালের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য একটু
একটু করে বেড়ে গেছে।
এখন স্বভাবতঃই
তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগছে যে, এমন সব আলো থাকতে পারে কিনা, যাদের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য লাল
আলোর চেয়েও বেশি অথবা বেগুনী আলোর চেয়েও কম?
প্রশ্নটা খুব
সুন্দর। অনেকদিন আগে হার্শেল নামে একজন বৈজ্ঞানিকও এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজেছিলেন।
অনেক ভেবেচিন্তে তিনি শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষাটা আর কিছুই না; বর্ণালীর
সাতটা রঙ যে পর্দার ওপর পড়েছে, তার বিভিন্ন জায়গায় তিনি অনেকগুলো থার্মোমিটার আটকে
দিলেন এবং এর ফলে যা দেখা গেল তাতে তিনি বেশ অবাক হলেন। তিনি দেখলেন বর্ণালী যত লাল
আলোর দিকে এগোচ্ছে, উত্তাপও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে; আর সবচেয়ে আশ্চর্যর ব্যাপার হল; লাল
আলোর এলাকা যেখানে শেষ হয়েছে, তার পরেই উষ্ণতা সবচেয়ে বেশি। হার্শেল এই পরীক্ষার থেকে
সিদ্ধান্ত করলেন যে, বর্ণালীর লাল আলোর পরে রয়েছে অদৃশ্য তাপ-রশ্মির এলাকা। আর, লাল
আলোরও পরে যেহেতু এর অবস্থান, এটা সহজেই বোঝা গেল যে, তাপ-রশ্মির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য লাল
আলোর চেয়েও বেশি। এই জন্য এর নাম দেওয়া হল ইনফ্রা রেড রে বা লাল-উজানী আলো।
হার্শেলের পরীক্ষার
ফলাফল দেখে বিজ্ঞানীরা স্বভাবতঃই বর্ণালীর বেগুনী পারের এলাকা সম্পর্কেও খোঁজখবর নিতে
শুরু করলেন। অনুসন্ধানের ফলও কিছু-দিনের মধ্যেই পাওয়া গেল। উইলিয়াম রিটার নামে একজন
বৈজ্ঞানিক শেষ পর্যন্ত বেগুনী-পারের আলো বা আলট্রাভায়োলেট রশ্মির সন্ধান পেলেন। এই
আলো তাপ উৎপন্ন করে না; কিন্তু দেখা গেল, ক্যামেরায় এর ছবি তোলা যায়। বর্ণালীতে এর
অবস্থান দেখে এও বোঝা গেল যে এই আলোর তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য বেগুনী আলোর চেয়েও আরো ছোট।
এই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার
ফলে বিজ্ঞানীরা অনুমান করলেন যে, আলট্রা-ভায়োলেটের চেয়েও ছোট এবং ইনফ্রা রেড রে’র চেয়েও
বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো থাকা অসম্ভব নয়। পরবর্তীকালে উন্নত ধরনের যন্ত্রের সাহায্যে
এরকম সব আলোর সন্ধান সত্যিই পাওয়া গেছে। তোমরা নিশ্চয় এক্স-রে বা রঞ্জন রশ্মির নাম
শুনেছো; এই রশ্নি মানুষের শরীর ভেদ করে চলে যেতে পারে এবং সেই জন্য শরীরের মধ্যে কোন
হাড় ভেঙে গেলে বা জখম হলে, এই রশ্মির সাহায্যে ডাক্তারেরা ঐ হাড়ের ছবি তুলে নেন এবং
ছবি দেখে, রোগীর অবস্থা বুঝে উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা করেন। যাই হোক এই রঞ্জন রশ্মিও
একরকমের আলো, যার তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য বেগুনী পারের আলোর চেয়েও কম। রেডিয়াম, ইউরেনিয়াম ইত্যাদি
ধাতুকে তেজস্ক্রিয় ধাতু বলা হয়। কারণ এইসব ধাতু সব সময় অদৃশ্য তেজ বা আলো বিকিরণ করছে।
এই অতি শক্তিশালী আলোর তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য রঞ্জন রশ্মির চেয়েও ছোট এবং এর নাম গামা রশ্মি।
ওদিকে লাল উজানী
আলোর ওপারেও আলোর সন্ধান পাওয়া গেছে, যার নাম বেতার-তরঙ্গ। বেতার-তরঙ্গের দৈর্ঘ্য লাল
উজানী আলোর থেকেও বেশি এবং এই তরঙ্গ যে কোন বাধা অতিক্রম করে দূর দূরান্তরে চলে যেতে
পারে। বেতার-তরঙ্গের এই প্রেরক কেন্দ্র থেকে বেতার-তরঙ্গকে আকাশে ছুড়ে দেওয়া হয়, আর
মুহুর্তের মধ্যে সেই তরঙ্গ মানুষের কথাবার্তা, খবরাখবর পৌঁছে দেয় দেশ দেশান্তরে।
আচ্ছা তা যেন
হল। কিন্তু ঐ সাতরঙা বর্ণালীর কথা শুনে কি তোমাদের মনে হচ্ছে যে, রংধনুর ব্যাপারটাও
অনেকটা ঐরকমই কিছু একটা হবে? সত্যিই তাই। দুটো ব্যাপার অনেকটা এক রকমেরই বটে, তবে রংধনুর
বর্ণালীর উৎপত্তি ত্রিকোণ কাঁচ থেকে নয়, হাওয়ায় ভাসমান ছোট ছোট জলকণা থেকে। ছোট ছোট
জলকণার মধ্যে সূর্যের আলো ঢুকে, তারপর বিপরীত দিকের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে বেরিয়ে আসে;
কিন্তু ভেতরে ঢুকবার সময়, আর বাইরে বেরিয়ে আসার সময় বিভিন্ন রঙের দিক পরিবর্তনটা হয়
ভিন্ন ভিন্ন রকম। লাল রঙের দিক পরিবর্তন হয় সবচেয়ে কম, আর বেগুনী রঙের সবচেয়ে বেশি।
অন্যান্য রঙগুলো এই দুই রঙের মাঝামাঝি দিক বেছে নেয় এবং বর্ণালির ক্রম অনুসারে এই রঙগুলো
সাজানো থাকে।
এখন একটা দরকরী
কথা হল, সূর্যের আলো জলকণার ভেতরে একবার ধাক্কা খেয়ে বেরিয়ে আসার পর একটা দিক বিচ্যুতি
হয়, এবং বিজ্ঞানীরা অঙ্ক কষে দেখেছেন যে, সূর্য রশ্মির সাত রঙে ভেঙে যাওয়াটা আমাদের
কাছে স্পষ্ট হয় তখনই, যখন আপতিত সূর্যরশ্মি আর জলকণা থেকে বেরিয়ে আসা রশ্মির মধ্যে
একটা নির্দিষ্ট কোণ রচিত হয়। এই দরকারী কথাটা একবার জানা হয়ে গেলে, তারপর নেহাৎ সাদামাটা
জ্যামিতির জ্ঞান কাজে লাগিয়েই বোঝা যায় যে, এই সব জলকণা, যারা সূর্য রশ্মিকে ঐ নিদিষ্ট
কোণে আমাদের চোখের দিকে ফিরিয়ে দেয়, তারা আকাশের গায়ে একটা সাত রঙা বণালীর বৃত্ত রচনা
করে। আর এই হল রংধনু।
আলো সম্বন্ধে
তোমরা এতক্ষণ অনেক কিছুই শুনলে; কিন্তু এটাই শেষ কথা নয় – বরং গোড়ার কথা। আলো যে আসলে
এক ধরণের ঢেউ, এই মতবাদ অনেক পুরোনো কিন্তু এর পাশাপাশি আরেকটা মতবাদও টিকে ছিল, যাতে
আলোকে খুব ছোট ছোট কণিকার স্রোত বলে বর্ণনা করা হয়েছিল। মুস্কিলের কথাটা হচ্ছে এই যে,
দুটো মতবাদের কোনোটাকেই পুরোপুরি বাদ দেওয়া চলে না। কথাটা শুনে তোমাদের নিশ্চয়ই অবাক
লাগছে? আচ্ছা, আরেকটু বুঝিয়ে বলছি শোনো।
বিজ্ঞানীরা আলোর
ওপর নিত্য নতুন পরীক্ষা চালিয়ে আলো সম্বন্ধে যতই জানছিলেন, ততই অবাক হচ্ছিলেন; কেন
না আলোর কতগুলো আচরণ দেখে তাঁরা যখন ভাবলেন যে আলো আসলে ইথার তরঙ্গ ছাড়া অন্য কিছুই
হতে পারে না, ঠিক তখনই হয়ত আরেকটা পরীক্ষার ফলাফল তাদের সমস্ত ধারণাকে উল্টেপাল্টে
দিয়ে রায় দিল আলোক-কণিকাবাদের স্বপক্ষে। সহজ কথায়, আলোর আচরণের মাথামুন্ডু কিছুই বোঝা
যাচ্ছিল না; কখনো মনে হচ্ছিল আলো এক ঝাঁক কণিকার স্রোত, আবার কখনো মনে হচ্ছিল সে বুঝি
ইথার-সমুদ্রে দ্রুতগতি ঢেউ।
সে যাই হোক,
এদিকে একটা মুশকিল হল এই যে, অনেক খোঁজ খবর অনুসন্ধান করেও কিন্তু ইথারের কোন পাত্তাই
পাওয়া গেল না। কাজেই বৈজ্ঞানিকেরা স্বাভাবিক ভাবেই ইথারের অস্তিত্ব সম্বন্ধে ক্রমশঃই
সন্দিহান হয়ে উঠছিলেন; আর এমনি যখন অবস্থা, ঠিক তখনই ম্যাক্সওয়েল নামে একজন বিজ্ঞানী
অঙ্ক কষে এক অসাধারণ তথ্য আবিষ্কার করে ফেললেন। বিদ্যুৎ আর চৌম্বক-বিজ্ঞানের মূল নীতিগুলোকে
একত্রিত করে গাণিতিক পদ্ধতিতে তিনি দেখালেন যে, একটা বৈদ্যুতিক আধান বা ইলেকট্রিক চার্জ
যদি কাঁপতে থাকে তাহলে সে আলো বিকিরণ করবে। এর থেকে সবচেয়ে দরকারী যে কাথাটা জানা গেল
তা হচ্ছে এই যে, আলো আসলে মহাশূন্যের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া বিদ্যুৎ আর চৌম্বক প্রাবল্যের
ঢেউ; সুতরাং এর জন্য ইথারের মত কোন কিছুর অস্তিত্ব কল্পনা করে নেবার প্রয়োজন আর রইল
না। বিজ্ঞানীরাও ইথারের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু তরঙ্গবাদ আর
কণিকাবাদের দ্বন্দটা তবু থেকেই গেল।
যাই হোক দীর্ঘ
প্রতীক্ষার পর ম্যাক্সপ্লাঙ্ক অবশেষে পথ দেখালেন। তিনি যে তত্ত্বের প্রবর্তন করলেন,
তার নাম কোয়ান্টাম তত্ত্ব। আমাদের এই ছোট আলোচনার শেষে, এখন আমরা খুব সহজ করে এই তত্ত্বকে
বুঝবার চেষ্টা করবো। মজার কথা হল, এই মতবাদে আলোর তরঙ্গ-ধর্মকেও স্বীকার করা হয়েছে,
আবার কণিকাবাদকে বাতিল কার হয়নি; আসলে এই দুটো মতবাদকে জুড়ে দিয়েই তৈরি হয়েছে কোয়ান্টাম
তত্ত্ব। কোয়ান্টাম তত্ত্বের চোখ দিয়ে দেখলে আলোর ঢেউ তুলে চলাটা মিথ্যা নয়, কিন্তু
সে ঢেউ জলের ঢেউ-এর মত ছেদহীন ভাবে একটানা বয়ে চলে না। এই ঢেউ-এর স্বভাবই হল ছোট ছোট,
টুকরো টুকরো হয়ে বয়ে চলা। এক একটা টুকুরো যেন এক একটা তরঙ্গের প্যাকেট, যার বৈজ্ঞানিক
নাম কোয়ান্টাম। আলোকে এই রকমভাবে চিন্তা করলে একটা মস্ত সুবিধে হল এই যে, এক ঝাঁক কোয়ান্টামকে
এক ঝাঁক কণিকার স্রোত হিসেবেও ভাবা যায়, আবার তাকে তরঙ্গ হিসেবে ভাবলেও অসুবিধা নেই।
সুতরাং আলো যদি কখনো তরঙ্গের মত, আবার কখনো কণিকার মত আচরণ করে তাতেও অবাক হওয়ার কিছু
নেই।
তোমাদেরকে ছোট্ট
করেই বললাম আলোর কথা গুলো। কিন্তু তোমরা যখন বিজ্ঞানের আরো গভীরে যাবে তখন দেখবে কোথাও
অন্ধকার নেই; আলোর সম্বন্ধে তোমাদের ধারনাও সেদিন আলোর মতই স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

0 মন্তব্যসমূহ