আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনা

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক ইবনে সিনার আসল নাম আবু আলী আল হুসাইন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা। তিনি সাধারণত ইবনে সিনা, বু-আলী সিনা এবং আবু আলী সিনা নামে পরিচিত। ল্যাটিন ভাষায় তার পরিচয় ‘আভিসিনা’ (Avicenna) নামে। তাকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজির জনকক হিসাবে গণ্য করা হয়। দার্শনিক আল-ফারাবি ছিলেন তার গুরু। যোগ্যতায় তিনি তার গুরুকে অতিক্রম করে যান। ৯৮০ সালে তুর্কিস্তানের বিখ্যাত শহর বুখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মায়ের নাম সিতারা বিবি। পিতা আবদুল্লাহ ছিলেন খোরাসানের শাসনকর্তা। জন্মের কিছুকাল পরই তিনি ইবনে সিনাকে বুখারায় নিয়ে আসেন এবং তার লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করেন। ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে লুকিয়ে ছিল অসামান্য মেধা ও প্রতিভা। মাত্র ১০ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্থ করে ফেলেন। তার ৩ জন গৃহশিক্ষক ছিলেন। তাদের মধ্যে ইসমাইল সুফি তাকে শিক্ষা দিতেন ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ শাস্ত্র ও তাফসীর। মাহমুদ মাসসাহ শিক্ষা দিতেন গণিতশাস্ত্র এবং বিখ্যাত দার্শনিক আল-নূতেলী শিক্ষা দিতেন দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি, টলেমির ‘আলমাগেস্ট’, ‘ওয়াহেরে মান্তেক’ প্রভৃতি। মাত্র ১৭ বছর বয়সে সব জ্ঞান তিনি আয়ত্ব করে ফেলেন। বিখ্যাত দার্শনিক আল-নূতেলীর নিকট এম কোন জ্ঞান আর অবশিষ্ট ছিল না যা তিনি ইবনে সিনাকে শিক্ষা দিতে পারতেন। তারপর তিনি তাকে নিজের ইচ্ছেমতো গবেষণা করার সুযোগ দেন।

ইবনে সিনার ‘কিতাব আল-শিফা’ (The Book of Healing) হলো দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ের ওপর লেখা একটি বিশ্বকোষ। তার ‘আল-কানুন ফি আল-তিব্ব’ (The canon of Medicine) মধ্যযুগের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। ১৬৫০ – এর দশকে বইটি ফ্রান্সের মাউন্টপিলার ও বেলজিয়ামের লাউভেইন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল। ইবনে সিনার ক্যানন অব মেডিসিনে গ্যালেন ও হিপোক্রেটসের নীতিমালার ভিত্তিতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা স্থান পেয়েছে।

ইবনে সিনা ইসলামের স্বর্ণযুগে ব্যাপক লেখালেখি করেছেন। তাকে এ যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এ সময় গ্রীক, রোমান ও ভারতীয় অনুবাদগুলো নিয়ে গবেষণা করা হতো। পবিত্র কোরআন ও হাদিসের গবেষণায় বিরাট অগ্রগতি সাধিত হয়। ইবনে সিনা ও তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা ফিকাহ ও ধর্মের গবেষণাকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যান। আল-রাজি ও আল-ফারাবি চিকিৎসা বিজ্ঞান ও দর্শনে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করায় ইবনে সিনার কাজ অনেক সহজ হয়ে যায়। বলখ, খাওয়ারিজম, গোরগাঁও, শহর-ই-রাই, ইস্মাহান ও হামাদানের লাইব্রেরিগুলোতে তার অবাধ যাতায়াত ছিল। তিনি তার সময়ের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের সঙ্গে দর্শন নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হতেন। খাওয়ারিজম ত্যাগ করার আগে তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবু রায়হান আল-বেরুনি, খ্যাতনামা গণিতজ্ঞ আবু নসর ইরাকি, দার্শনিক আবু সহল মাসীহ এবং প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী আবুল খাম্মারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

বিহ্বল মুহূর্তে তিনি অজু করতেন এবং মসজিদে গিয়ে নফল নামাজ আদায় করতেন। সেজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে বলতেন, ‘হে আল্লাহ তুমি আমার জ্ঞানের দরজা খুলে দাও। জ্ঞান লাভ ছাড়া পৃথিবীতে আমার আর কোনো কামনা নেই।’ তারপর ঘরে এসে আবার গবেষণা শুরু করতেন। ক্লান্তিতে যখন ঘুমিয়ে পড়তেন তখন অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো স্বপ্নের ন্যায় তার মনের মধ্যে উদ্ভাসিত হতো এবং তার জ্ঞানের দরজা যেন খুলে যেতো। হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেই সমস্যাগুলোর সমাধান পেয়ে যেতেন। এক পর্যায়ে তিনি চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কিত বই সংগ্রহ করে গবেষণা করতে শুরু করেন। কিশোর বয়সে তিনি এরিস্টোটলের ‘মেটাফিজিক্স’ (Metaphysics)-এ গভীরভাবে প্রভাবিত হন। দেড় বছর তিনি দর্শনের বইটি অধ্যয়ন করেন। এরিস্টোটলের দর্শন অধ্যয়ন করতে গিয়ে তিনি জটিলতার মুখোমুখি হন। ‘মেটাফিজিক্স’ তিনি ৪০ বার পাঠ করেন। এতবার পাঠ করায় বইটির অক্ষরগুলো তার স্মৃতিতে গেঁথে যায়। কিন্তু তিনি অর্থ বুঝতে পারছিলেন না। আল-ফারাবির ভাষ্য পাঠ করে তিনি অর্থ বুঝতে সক্ষম হন। একটি বুক স্টল থেকে তিন দিরহাম দিয়ে আল-ফারাবির ভাষ্য সংগ্রহ করেন। এরিস্টোটলের মেটাফিজিক্সের ওপর আল-ফারাবির ভাষ্য পাঠ করে তিনি এত মুগ্ধ হন যে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশে তৎক্ষণাৎ মসজিদে ছুটে গিয়ে নামাজ আদায় করেন এবং দীন দুঃখীদের দান খয়রাত করেন।

মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইবনে সিনা চিকিৎসা বিদ্যায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি শুধু চিকিৎসা বিষয়ক তত্ত্বগুলো শিখতেন তাই নয়, বিনা মূল্যে অসহায় রোগীদের চিকিৎসাও করতেন। দ্রুত তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তিনি চিকিৎসায় নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে থাকেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি একজন পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসকের মর্যাদা লাভ করেন। ইবনে সিনা বুঝতে পারেন যে, চিকিৎসা বিজ্ঞান গণিত অথবা অধিবিদ্যার মতো এত কঠিন নয়। তিনি এনাটমিতে বিশ্বাস করতেন না এবং অস্ত্রোপচার সম্পর্কে তার তেমন আগ্রহ ছিল না। তিনি রোগ নিরাময়ে ওষুধের ওপর গুরুত্ব দিতেন বেশি।


যৌবনকাল

ইবনে সিন যৌবনে খাওয়ারিজমের তাবারিস্তানের মামুনীয় আমির শামসুল মোয়ালি আবুল হাসান ইবনে ওয়াশমাগিরের ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন। ৯৯৭ সালে তিনি ইন্দ্রজালের সৃষ্টি করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। আমির কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার জন্য রাজদরবারের লাইব্রেরি উন্মুক্ত করে দেন। মাত্র অল্প কয়েকদিন তিনি অসীম ধৈর্য ও একাগ্রতার সঙ্গে লাইব্রেরির সব বই মুখস্থ করে ফেলেন। কিছুদিনের মধ্যেই অগ্নিকাণ্ডে লাইব্রেরি ভস্মীভূত হয়। লাইব্রেরিতে অগ্নিকাণ্ডের জন্য তার শত্রুরা তাকে অভিযুক্ত করে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিতশাস্ত্র, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদাতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র, কাব্য সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী হন। ২১ বছর বয়সে ‘আল-মজমুয়া’ নামে একটি বিশ্বকোষ রচনা করেন। এ বিশ্বকোষে গণিতশাস্ত্র ছাড়া প্রায় সব বিষয়াদি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ১০০১ সালে পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। এ সময় তার বয়স ছিল ২২ বছর। সামানীয় রাজবংশের পতন ঘটলে তার ওপর রাজনৈতিক দুর্যোগ নেমে আসে। নিরাপত্তা লাভে তিনি আধুনিক উজবেকিস্তানের উরগাঞ্চের পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। গুণী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষক হিসাবে পরিচিত উজবেকিস্তারেনর উজির ইবনে সিনাকে মাসে বৃত্তি প্রদান করতেন। এই বৃত্তি এত সামান্য ছিল যে, তিনি জীবিকার্জনে খোরাসান সীমান্তের নিশাপুর ও মার্ভ জেলার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হন। দাইলাম ও মধ্য পারস্যের শাসক কাবুস ছিলেন একজন পণ্ডিত ও কবি। ইবনে সিনা তার কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের আশা করছিলেন। কিন্তু তিনি এমন এক সময় তার কাছে আশ্রয় কামনা করছিলেন যখন তার নিজের অবস্থা ছিল টলটলায়মান। বিদ্রোহী সৈন্যরা তাকে অনাহারে রেখে হত্যা করে। এসময় ইবনে সিনা কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। অবশেষে কাম্পিয়ান সাগরের কাছে গোরগাঁয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি তার নিজের বাড়ির কাছে ইবনে সিনাকে একটি বাড়ি কিনে দেন। এই বাড়িতে তিনি যুক্তিবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর ভাষণ দিতেন। বন্ধুর পৃষ্ঠপোষকতায় ইবনে সিনা কয়েকটি বই লিখতে সক্ষম হন। হায়ারসানিয়ায় অবস্থানকালে তিনি তার বিশ্ববিখ্যাত বই ‘আল-কানুন ফি আল-তিব্ব’ লিখতে শুরু করেন।

একসময় ইবনে সিনা আধুনিক ইরানের রাজধানী তেহরানের উপকন্ঠে রাইয়ে বসবাস করতে থাকেন। শেষ বুয়েদীয় আমিরের ছেলে মজিদ আদদৌলা ছিলেন রাইয়ের নামমাত্র শাসক। তিনি তার মা সৈয়দা খাতুনের প্রতিনিধি হিসাবে শাসন করতেন। রাইয়ের ইবনে সিনা অন্তত ৩০ টি সংক্ষিপ্ত বই লেখা সম্পন্ন করেন। মজিদ আদদৌলা ও তার দ্বিতীয় পুত্র শামসুদৌলার মধ্যে সার্বক্ষণিক বিরোধ চলতে থাকায় ইবনে সিনা রাই ছাড়তে বাধ্য হন। কাজবিনে সংক্ষিপ্ত অবস্থানের পর তিনি দক্ষিণে হামাদান পৌঁছান। বুয়েদীয় আমির শামসুদৌলা নিজেকে হামাদানের শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ইবনে সিনা প্রথমে এক সম্ভ্রান্ত মহিলার চিকিৎসক হিসাবে তাকে তলব করেন। তাকে প্রচুর উপঢৌকন দিয়ে বাড়িতে ফেরত পাঠান। ইবনে সিনাকে উজিরের পদে অসীন করা হয়। সুস্থ হয়ে আমির তাকে রাজ্য ছেড়ে যাবার নির্দেশ দেন। এসময় ইবনে সিনা শেখ আহমদ ফাদেলের বাড়িতে ৪০ দিন আত্মগোপন করে থাকেন। আমির পুনরায় অসুস্থ হলে তাকে ডেকে পাঠান এবং তার পদ ফিরিয়ে দেন। জীবনের উত্থান পতনের দিনগুলোতে ইবনে সিনা তার জ্ঞান সাধনা চালিয়ে যান। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি ছাত্রদের কাছে ‘কানুন’ ও ‘সানাসিও’র অংশ বিশেষ ব্যাখ্যা করতেন। আমিরের মৃত্যু হলে ইবনে সিনা তার মন্ত্রী পদ হারান এবং এক ছাত্রের বাড়িতে আত্মগোপন করেন। সেখানে চর দুঃসময়ে তিনি তার কাজ চালিয়ে যান। চাকরিতে নিয়োগ লাভের প্রস্তাব দিয়ে তিনি ইস্পাহানের শাসক আবু ইয়াফার কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। আবু ইয়াফার কাছে চিঠি পাঠানোর কথা জানতে পেরে হামাদানের আমির তাকে একটি দুর্গে বন্দি করেন। এ নিয়ে হামাদান ও ইস্পাহানের শাসকদ্বয়ের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। ১০২৪ সালে ইস্পাহানের শাসক হামাদান দখল করেন এবং ভাড়াটিয়া তাজিক সৈন্যদের বিতাড়িত করেন। দুর্যোগ থেমে গেলে ইবনে সিনা হামাদানের আমিরের সঙ্গে ফিরে আসেন এবং তার লাইব্রেরি ওয়ার্ক চালিয়ে যেতে থাকেন। পরবর্তীতে সুফির বেশ ধারণ করে তার ভাই ও প্রিয় ছাত্র এবং দু’জন ক্রীতদাসকে সঙ্গে নিয়ে তিনি হামাদান থেকে পালিয়ে যান। দীর্ঘ বিপদ সংকুল পথ পাড়ি দিয়ে তারা ইস্পাহানে পৌঁছলে তাদেরকে বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়।

১০০৪ সালে ইবনে সিনা খাওয়ারিজমে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। খাওয়ারিজমের বাদশাহ মামুন বিন মাহমুদ ছিলেন ব্যক্তি জীবনে একজন কবি। ১০০৪-১০১০ সাল পর্যন্ত ইবনে সিনা খাওয়ারিজমে শান্তপূর্ণভাবে বসবাস করলেও তার এ সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে গজনীর সুলতান মাহমুদ তাকে আমন্ত্রন জানান। মাহমুদ জ্ঞানী ব্যক্তিদের খুব ভালোবাসতেন। তাদেরকে মনি মুক্তা উপহার দিতেন। ইবনে সিনাকে খুঁজে বের করতে সুলতান মাহমুদ তার ‍প্রধান শিল্পী আবু নাসেরের মাধ্যমে তার ৪০ টি প্রতিকৃতি তৈরি করে সমগ্র পারস্য ও এশিয়া মাইনরের রাজন্যবর্গের কাছে পাঠিয়ে দেন। তিনি দেশে বিদেশে লোক পাঠান। এছাড়া তিনি খাওয়ারিজমের বাদশাহ মামুন বিন মাহমুদকে পরোক্ষভাবে এ নির্দেশ দিয়ে একটি পত্র পাঠান যে, তিনি যেন তার দরবারের জ্ঞানী ব্যক্তিদের তার দরবারে পাঠিয়ে দেন। আসলে অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের সঙ্গে ইবনে সিনাকে পাওয়াই ছিল তার আসল উদ্দেশ্য।


ইবনে সিনার ধর্মীয় মাযহাব নিয়ে বিতর্ক

মহান দার্শনিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা ইসলামের কোন মাযহাবভুক্ত ছিলেন তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। মধ্যযুগের ঐতিহাসিক জহিরউদ্দিন আল-বায়হাকীর মতে, তিনি ছিলেন একটি গুপ্ত দার্শনিক সংস্থার সদস্য। অন্যদিকে শিয়া ফকিহ নূরুল্লাহ শুততারি ও ঐতিহাসিক সৈয়দ হোসেন নাসির উভয়ে দাবি করেছেন, ইবনে সিনা শিয়াদের দ্বাদশ ইমামে বিশ্বাসী ছিলেন। পরবর্তীতে দিমিত্রি গুস্তাস উভয়ের দাবি প্রত্যাখ্যান করে প্রমাণ করেছেন, ইবনে সিনা সুন্নি হানাফি মাযহাবভুক্ত মুসলমান ছিলেন্ ধর্মীয় তাত্ত্বিক হেনরি করবিন আরেকটি তত্ত্বে দাবি করেছেন, ইবনে সিনা তার পিতার মতো ইসমাঈলীয় সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন। ইবনে সিনার পারিবারিক পটভূমি নিয়েও অনুরূপ বিতর্ক বিদ্যমান। একটি পক্ষ দাবি করছে, ইবনে সিনার পরিবার ছিল সুন্নি সম্প্রদায়ের। আরেকটি পক্ষ দাবি করছে, তার পরিবার ছিল শিয়া।


ক্যানন অব মেডিসিন

ইবনে সিনার ‘আল-কানুন ফি আল-তিব্ব’ (Canon of Medicine)- এর একটি ল্যাটিন কপি যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পি. আই. নিক্সন মেডিকেল হিস্টরিক্যাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত। ইবনে সিনা প্রায় এক হাজার বই পুস্তক লিখে রেখে গেছেন।

তার কোনো কোনো বই মাত্র কয়েক পৃষ্ঠার। অন্যগুলো কয়েক খণ্ডে বিভক্ত। তবে ১৪ খণ্ডের ‘ক্যানন অব মেডিসিন’ তাকে ইতিহাসে জীবিত রেখেছে। অষ্টাদশ শতাব্দী নাগাদ বইটি মুসলিম ও ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য পুস্তক হিসাবে পড়ানো হতো। ছোঁয়াচে এবং যৌনক্রিয়া বাহিত রোগ উদ্ভাবন, সংক্রামক ব্যাধির বিস্তার রোধে কোয়ারান্টাইন চালু, পরীক্ষামূলক ওষুধ ব্যবহার, ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, স্নায়ু রোগের চিকিৎসা, ঝুঁকির উপাদান বিশ্লেষণ, লক্ষণ দেখে নির্দিষ্ট রোগ নির্ণয় এবং মাইক্রোঅর্গানিজমের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণার জন্য বইটি সুপরিচিত। ইবনে সিনা তার বইটিতে এ তত্ত্ব প্রচার করেন যে, বায়ু দূষণ হলো মহামারির কারণ। বইটিতে বিভিন্ন রোগের শ্রেণীবিন্যাস ও বিবরণ এবং রোগের সম্ভাব্য কারণ তুলে ধরা হয়েছে। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য বিজ্ঞান, সহজ ও জটিল ওষুধ এবং শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের কর্মকাণ্ড নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। ইবনে সিনাই প্রথম নির্ভূলভাবে চোখের গঠন এবং ছানির মতো চোখের বিভিন্ন অসুখের কতা উল্লেখ করেছেন। ক্যানন অব মেডিসিনে সুস্পষ্টরূপে বলা হয়, যক্ষা হলো একটি সংক্রামক ব্যাধি। ইউরোপীয়রা যক্ষাকে সংক্রামক ব্যাধি হিসাবে মেনে নিতে আপত্তি করেছিল। কিন্তু পরে ইবনে সিনার তত্ত্ব সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। বইটিতে বহুমূত্র রোগের লক্ষণ ও জটিলতাগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। মুখমণ্ডলের উভয় প্রকার প্যারালাইসিস নিয়েও গভীর আলোচনা করা হয়েছে।


মনস্তত্ত্ব

ইবনে সিনা স্নায়ু চিকিৎসার অগ্রপথিক ছিলেন। তিনিই প্রথম স্মৃতিভ্রষ্টতা, অনিদ্রা, মানসিক বিকার, দুঃস্বপ্ন, অবসাদ, চিত্তভ্রংশ, মৃগীরোগ, পক্ষাঘাত, স্ট্রোক ও ঘূর্ণিরোগসহ অসংখ্য স্নায়ুবিক দুর্বলতার বর্ণনা দেন। তিনি আবেগ সংশ্লিষ্ট অসুস্থতার জন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা প্রদান করতেন এবং অভ্যন্তরীণ অনুভূতিসহ নাড়ির স্পন্দন পরিবর্তনের একটি ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছিলেন। ইবনে সিনা নাড়ি পরীক্ষা এবং প্রদেশে, জেলা, শহর, রাজপথ ও লোকজনের নাম চিৎকার করে উচ্চারণ করে একজন গুরুতর মানসিক রোগীর চিকিৎসা করেছিলেন। বিশেষ নামগুলো উচ্চারণ করার সময় তিনি রেগীর নাড়ির স্পন্দনের প্রতি খেয়াল রাখছিলেন। ইবনে সিনা অনুমান করতে পেরেছিলেন যে, কোনো মেয়ের সঙ্গে রোগীর প্রেম ছিল। ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে তিনি মেয়েটির বাড়ি খুঁজে পান। ইবনে সিনা মেয়েটিকে বিয়ে করার জন্য রোগীকে পরামর্শ দেন। মেয়েটি বিয়ে করার পর রোগী সুস্থ হয়ে যায়।


ইউনানী চিকিৎসা

দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রীক পণ্ডিত গালেনের সময় থেকে ইউনানী চিকিৎসা বিদ্যা চালু হয়। তবে এ চিকিৎসা পদ্ধতির মৌলিক জ্ঞান উদ্ভাবন করেছিলেন হেকিম ইবনে সিনা। তিনি তার ক্যানন অব মেডিসিনে ইউনানী চিকিৎসার বর্ণনা দিয়েছেন। ভারত ও পাকিস্তানের মেডিকেল কলেজগুলোর পাঠ্যসূচিতে বইটি অন্তর্ভূক্ত। হেকিম ইবনে সিনার ইউনানী চিকিৎসা বিষয়ক বই নিয়ে গবেষণা চালাতে গিয়ে ভারতীয় হেকিম সৈয়দ জিল্লুর রহমান নিজেও বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। ইবনে সিনার ওপর তার লেখা বইগুলোর বিবরণ দেয়া হলো:

            (১) রিসালাহ জুদিয় অব ইবনে সিনা

            (২) আল-আদভিয়া আল-কালবিয় অব ইবনে সিনা

            (৩) ইলমুল আমরাজ অব ইবনে সিনা

            (৪) কানুন ইবনে সিনা আউর উসকে শারিহীন ওয়া মুত্রারাজমীন


সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা

আল-ফারাবির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে ইবনে সিনা বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চালান। গবেষণা চালাতে গিয়ে তিনি নির্যাস (মাহিয়াত) ও অস্তিত্বের (উজুদ) মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেন। তিনি যুক্তি দেন যে, বিদ্যমান বস্তুর নির্যাস থেকে কোন কিছু অস্তিত্ব লাভ করতে এবং বস্তুগুলো নিজেরা পরস্পর প্রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হতে পারে না। এছাড়া বস্তুগুলো বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের গতিশীলতায় কোন ভূমিকা রাখতে পারে না। কোনো কার্যকারণ থেকে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড অস্তিত্ব লাভ করেছে। হামাদানের কাছে ফারদাজান দুর্গে অন্তরীণ থাকার সময় ইবনে সিনা মানুষের আত্মসচেতনতা এবং আত্মার অবিনশ্বরতা প্রদর্শনে তার বিখ্যাত বই ‘ফ্লোটিং ম্যান’ লিখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তার ফ্লোটিং ম্যান চিন্তাধারার মাধ্যমে এ সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, আত্মা একটি সত্তা।

দর্শন

ইবনে সিনা ইসলামী দর্শনে বিশ্বাস করতেন। তিনি ইসলামী দর্শন বিশেষ করে যুক্তিবিদ্যা, নীতিশাস্ত্র ও অধিবিদ্যার ওপর ব্যাপক লেখালেখি করেছেন। এসব বিষয়ের ওপর লিখিত তার একটি বইয়ের ইংরেজি নাম হলো ‘লজিক’ এবং আরেকটি বইয়ের নাম ‘মেটাফিজিক্স’। আরবী ভাষায় তিনি অধিকাংশ বই লিখেছেন্ তার সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে আরবী ছিল বৈজ্ঞানিক ভাষা। ইবনে সিনা ফারসি ভাষায়ও কয়েকটি বই লিখেছেন। ফারসি ভাষায় তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম হলো ‘দানিশনামা-ই-আলা’ বা আলাউদদৌলার দর্শন। এরিস্টোটলের ওপর ইবনে সিনার ভাষ্য বিজ্ঞানীদের ভূল সংশোধনে সহায়ক হয়। বিজ্ঞানীরা ইজতিহাদের চেতনায় প্রাণবন্ত বিতর্কে লিপ্ত হতেন। এরিস্টোটলের মতবাদ এবং নব্য প্লেটোবাদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সফল হওয়ায় ইবনে সিনা দ্বাদশ শতাব্দীতে নেতৃস্থানীয় ইসলামী দার্শনিক হিসাবে অবির্ভূত হন। মধ্যযুগের ইউরোপে তার মতবাদ বিশেষ করে আত্মার প্রকৃতি এবং স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে তার মতবাদ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়। ফরাসি ধর্মযাজক উইলিয়াম ও জার্মান দার্শনিক এলবার্টাস ম্যাগনাস প্রভাবিত হওয়া সত্ত্বেও ১২১০ সালে ফ্রান্সে ইবনে সিনার মতবাদ নিষিদ্ধ করা হয়। তার অধিবিদ্যা ইতালীয় ধর্মযাজক টমাস একুইনাসের চিন্তাধারাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।


জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতিষশাস্ত্র

ইবনে সিনা দু’টি কারণে জ্যোতিষশাস্ত্র অধ্যয়নের বিরোধিতা করতেন। প্রথম কারণ ছিল জ্যোতিষীদের অনুসৃত পদ্ধতি। জ্যোতিষীরা অনুমান আন্দাজে ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। ভবিষ্যদ্বাণী সপক্ষে তারা কোনো প্রামাণ দিতে পারতেন না। দ্বিতীয় কারণ ছিল জ্যোতিষীদের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিনি জ্যোতিষশাস্ত্রের বিরোধিতায় তার যুক্তির পক্ষে পবিত্র কোরআনের উদ্বৃতি দিতেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনি এরিস্টোটলের মতবাদের বিরোধিতা করতেন। এরিস্টোটল বলেছিলেন, তারকাগুলো সূর্যের আলোয় আলোকিত। ইবনে সিনা দাবি করেছিলেন, নক্ষত্রগুলো নিজের আলোয় আলোকিত। তিনি আরো বিশ্বাস করতেন, গ্রহগুলোও নিজের আলোয় আলোকিত। ইবনে সিনা উল্লেখ করেছিলেন, তিনি ১০৩২ সালের ২৪ মে সূর্যের চারদিকে শুক্রকে প্রদক্ষিণ করতে দেখতে পেয়েছেন। তবে আধুনিক পণ্ডিতরা তার এ দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, ইবনে সিনা যেখান থেকে শুক্র গ্রহকে প্রদক্ষিণ করতে দেখতে পেয়েছেন তা ঐ সময় ঐ স্থান থেকে দেখা সম্ভব নয়। ইবনে সিনা ‘দ্য কম্পেনডিয়াম অব আলগামেস্ট’ শিরোনামে টলেমির আলগামেস্ট-এর একটি ভাষ্য লিখার পর এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে, শুক্র গ্রহ সূর্য থেকে পৃথিবীর অনেক বেশি কাছে। ১০৭০ সালে ইবনে সিনার ছাত্র আবু ওবায়েদ আল-জুজযানি দাবি করেন, তার শিক্ষক ক্লডিয়াস টলেমির একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান করেছেন।


রসায়ন

রসায়নশাস্ত্রে ইবনে সিনা প্রথম বাষ্পীয় পাতনের রাসায়নিক প্রক্রিয়ার বর্ণনা দেন। এ পদ্ধতি এলকোহল ও ঘন হাইড্রোলিক তরল পদার্থ উৎপাদনে ব্যবহৃত হতো। অ্যারোমেটিক থেরাপি তৈরিতে এলকোহলের ব্যবহার ছিল অপরিহার্য। তিনি রেফ্রিজারেটেড কয়েল (গৃহস্থালী কাজে ব্যবহার্য যন্ত্র) আবিষ্কার করেন। তার এ আবিষ্কার ছিল পাতন প্রযুক্তিতে একটি বিরাট অগ্রগতি। তিনি বাষ্পীয় পাতন প্রক্রিয়ায় এ প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। ঘন হাইড্রোলিক তরল পদার্থ উৎপাদনে রেফ্রিজারেটেড টিউবের (Refrigerated tube) প্রয়োজন হতো। একজন রসায়নবিদ হিসাবে ইবনে সিনা প্রথম আলকেমি সংক্রান্ত তত্ত্ব খণ্ডন করে চারটি বই লিখেন। তার বইগুলো ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। ইবনে সিনা তার গ্রন্থ ‘দ্য বুক অব মিনার‌্যালস’ – এ পদার্থের রূপান্তর ঘটিয়ে পরশমনি তৈরির (Transmulation of Substance) তত্ত্বের প্রতি অবিশ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মতামত দেন যে, অন্য কোনো ধাতুর রূপান্তর ঘটিয়ে সোনা কিংবা রূপা তৈরি করা সম্ভব নয়। তখনকার দিনে আলকেমিস্টরা ধাতুর রূপান্তরে বিশ্বাস করতেন। তাদের বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল এরিস্টোটলের একটি তত্ত্ব। এরিস্টোটল তার তত্ত্বে দাবি করেছিলেন, মাটি, পানি, বাতাস ও আগুন-এ চারটি উপাদান নিয়ে বস্তু গঠিত। স্বর্ণ হচ্ছে সব ধাতুর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট এবং রূপা হচ্ছে দ্বিতীয়। এসব উপাদানের সংমিশ্রণে একটি ধাতুকে অন্য ধাতুতে রূপান্তর করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় পঞ্চম ধাতু বা ‘এলিক্সার’ তৈরি করা যাবে। এলিক্সার তৈরি করা সম্ভব হলে মানুষ চির যৌবন লাভ করবে। কিন্তু ইবনে সিনা এরিস্টোটলের এ তত্ত্ব বিশ্বাস করতে পারেননি। আলেকেমির প্রতি অবিশ্বাস থেকে তিনি যেসব বই রচনা করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল ‘লাইবার এবোয়ালি এবিনসাইন দ্য এনিমা ইন আর্টি আলকিমিয়া।’ ভিনসেন্ট অব বিউভাইসের মতো মধ্যযুগের রসায়নবিদ ও আলকেমিস্টদের ওপর বইটির প্রভাব ছিল অসামান্য। ‘দ্য কংলেশনি ইট কংলিউটিনেশনি লাপিডিয়াম’ শিরোনামে ল্যাটিন ভাষায় প্রকাশিত অন্য আরেকটি বইয়ে ইবনে সিনা চার খণ্ডে বিভক্ত একটি অজৈব পদার্থ শ্রেণীকরণের প্রস্তাব করেন। তার এ প্রস্তাব ছিল এরিস্টোটলের দু’টি খণ্ড (অরিকটা ও ধাতু) এবং গালেনের তিন খণ্ডে (টারে, লাপিডেস ও ধাতু) বিভক্ত শ্রেণীকরণের তুলনায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি। ইবনে সিনার শ্রেণীকরণের চারটি অংশ ছিল লাপিডেস, ক্ষার, লবণ ও ধাতু।


প্রকৌশল

ইবনে সিনা তার বিশ্বকোষ ‘মায়ার আল-আকল’- এর (The measure of Mind) মেকানিক্স ও প্রকৌশল বিষয়ক অধ্যাগুলোতে সরল বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির বিশ্লেষণ দিয়েছেন এবং সরল যন্ত্র ও তাদের সমন্বয়গুলো শ্রেণীকরণে একটি সফল প্রচেষ্টা চালান। তিনি প্রথমেই কপিকল, ভারোত্তোলক, স্ক্রু, গোঁজ ও চরকি – এ পাঁচটি সরল যন্ত্রের উপকরণের ব্যাখ্যা ও বর্ণনা দেন। পরে তিনি এসব সরল যন্ত্রপাতির বিশ্লেষণ হাজির করেন। তিনিই প্রথম এমন একটি কৌশল বর্ণনা করেন যা ছিল গোঁজ ছাড়া অন্য সরল যন্ত্রগুলোর একটি সমন্বয়।


বিজ্ঞানের দর্শন

‘দ্য বুক অব হীলিং’ – আল-বুরহান অধ্যায়ে ইবনে সিনা বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অনুসন্ধানের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি এরিস্টোটলের ‘পোস্টারিয়র অ্যানালিটিক্স’ নিয়ে আলোচনার কয়েক জায়গায় তার দর্শন থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। ইবনে সিনা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে একটি প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রশ্নটি হচ্ছে, ‘একজন লোক কিভাবে বিজ্ঞানের প্রাথমিক নীতিমালা শিখতে পারবে?’ তিনি আরো জানতে চেয়েছেন, ‘কয়েকটি মৌলিক জিজ্ঞাসা ছাড়া একজন বিজ্ঞানী কিভাবে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অথবা একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যায় পৌঁছাতে পারবেন?’ তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, যদি কেউ আশ্রয় বাক্যগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক অনুধাবন করতে পারেন তাহলে তিনি নিশ্চিত গ্রহণযোগ্য একটি সমাধানে পৌঁছাতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ, যদি প্রথম আশ্রয় বাক্যে বলা হয়, ‘মানুষ মরণশীল’ এবং দ্বিতীয় বাক্যে বলা হয়, ‘সক্রেটিস একজন মানুষ’ তাহলে তৃতীয় বাক্যটি হবে ‘সক্রেটিস মরণশীল’। তারপর ইবনে সিনা প্রথম নীতিতে পৌঁছানোর জন্য আরো দু’টি পদ্ধতি যুক্ত করেন। প্রথম পদ্ধতিটি হচ্ছে এরিস্টোটলের আরোহ বা ইশতিকরা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে পরীক্ষা ও গবেষণা বা তাজবিরা পদ্ধতি। ইবনে সিনা এরিস্টোটলের আরোহ পদ্ধতির সমালোচনা করে বলেন, এ পদ্ধতিতে চূড়ান্ত ও সর্বজনীন সিদ্ধন্ত পৌঁছানো যায় না এবং কোনো কোনো আশ্রয় বাক্য ভুল সিদ্ধন্তের দিকে ঠেলে দেয়। এরিস্টোটলের আরোহ পদ্ধতির স্থলে তিনি বৈজ্ঞানকি অনুসদ্ধানের উপায় হিসাবে একটি পরীক্ষামূলক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন।


পদার্থ বিজ্ঞান

পদার্থ বিজ্ঞানে ইবনে সিনাকে গতি তত্ত্বের ধারণার জনক হিসাবে আখ্যা দেয় হয়। মেকানিক্সে তিনি তার দ্যা  ‍বুক অব হীলিংয়ে একটি বিস্তারিত গতি তত্ব উদ্ভাবন করেছেন। তাতে তিনি গতির প্রবণতা এবং উৎক্ষিপ্ত বস্তুর শক্তির মধ্যে একটি পার্থক্য করেছেন। তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, গতি হলো নিক্ষিপ্ত বস্তুতে নিক্ষেপকারীর স্থানান্তরিত আনতি বা ‘মায়াল’। তিনি গতির প্রবণতাকে একটি স্থায়ী শক্তি হিসাবে বিবেচনা করেছেন। বায়ুর বাধার মতো বাইরের কয়েকটি শক্তি এ স্থায়ী শক্তির ক্ষয় সাধন করে। ইবনে সিনা বুঝাতে চেয়েছেন, ধাবমান শক্তি সমান হলে বস্তুগুলো তাদের আনুপাতিক ওজন অনুযায়ী অগ্রসর হবে। তিনি জন ফিলিপোনসের বিরোধিতা করে মত প্রকাশ করেনে, গতিশীল বস্তুর পথে কোনো বাধা না এলে প্রক্ষিপ্ত বস্তুটি অনন্তকাল চলতে থাকবে। ইবনে সিনার এ গতি তত্ত্ব বর্তমানে নিউটনের প্রথম সূত্র হিসাবে পরিচিত জড় তত্ত্বের একটি স্মারক। তার মায়াল তত্ত্বে একটি সচল দেহের গতি ও ওজনের মধ্যকার সংখ্যাগত সম্পর্ক নির্ধারণের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। ফরাসি ধর্মযাজক জ্যাঁ বুরিদান তার ‘থিওরি অব ইম্পেটাস’ – এ ইবনে সিনার গতি তত্ত্বকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান।


আবিষ্কার

ইবনে সিনা শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন তাই নয়, তিনি ছিলেন একজন আবিষ্কারক। বাষ্পীভবনের মাধ্যমে তিনি অতি প্রয়োজনীয় একটি তৈল আবিষ্কার করেছিলেন। তার আবিষ্কৃত তৈল এরোমেথিরাপি, পানীয় ও প্রসাধন শিল্পে ব্যবহার করা হতো। পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণায় তিনি প্রথম  একটি এয়ার থার্মোমিটার ব্যবহার করেছিলেন।


লেগ্যাসি

চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ডিভাইন কমেডি’তে (Divine Comedy) কল্পনার অনন্ত লোকে বিশ্ববরেণ্য কবি দান্তে আলিগেরির সঙ্গে রোমান কবি ভার্জিল, মুসলিম দার্শনিক ইবনে রুশদ, অন্ধ গ্রীক মহাকবি হোমার, রোমান কবি হোরেস, রোমান কবি ওভিড, রোমান কবি লিউকান, দার্শনিক সক্রেটিস, দার্শনিক প্লেটো ও সুলতান সালাহউদ্দিনের মতো ইতিহাসের বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। দান্তের সঙ্গে সাক্ষাৎকারীদের মধ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উভয়ে ইবনে সিনাকে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ‘দ্য হিস্টরি অব সায়েন্স’র গ্রন্থকার বেলজীয় রসায়বিদ জর্জ সারটন তাকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম চিন্তানায়ক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন এবং তাকে ইসলামের সবচেয়ে খ্যাতনামা বিজ্ঞানী এবং সকল জাতি, সকল দেশ ও সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকার করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে চিকিৎসা বিজ্ঞানে তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।

ইবনে সিনা প্রাচীন গ্রীক বিজ্ঞানী হিপোক্রিটাস ও গ্যালেন এবং প্রাচীন ভারতীয় গণিতজ্ঞ সুশ্রুতা ও প্রাচীন ভারতীয় আয়ুবেদীয় চিকিৎসক চরাকার দর্শনে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। আল-রাজি, আবু আল-কাসিম, ইবনুল নাফিস ও আল ইবাদির পাশাপাশি ইবনে সিনাকেও ইসলামের প্রাথমিক যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁয় অমূল্য অবদান রাখায় তাকে পাশ্চাত্যের চিকিৎসা বিজ্ঞানে একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি হিসাবে শ্রদ্ধা করা হয়। ইবনে সিনাকে পদার্থবিজ্ঞানের গতিবিদ্যার মৌলিক ধারণার জনক হিসাবে গণ্য করা হয়। ইরানে তাকে একজন জাতীয় বীরের মর্যাদা দেয়া হয় এবং প্রায়ই তাকে পারস্যের শ্রেষ্ঠতম সন্তান হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। বর্তমান ইরানে তার বহু প্রতিকৃতি ও ভাস্কর্য বিদ্যমান। উজবেকিস্তানের রাজধানী বুখারায় জাদুঘরের বাইরে চিকিৎসকদের চিকিৎসক হিসাবে পরিচিত এ মহান ব্যক্তির জীবনী ও কর্ম সম্বলিত একটি সুদৃশ্য প্রতিকৃতি টানানো রয়েছে। একইভাবে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের আভিসিনা মেডিকেল ফ্যাকাল্টির হলে তার একটি প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে। বিজ্ঞানে বহুমুখী প্রতিভা ইবনে সিনার অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে ১৯৭০ সালে তার নামে চাঁদের একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয়েছে। ৩৯ দশমিক শূন্য ৭ এস এবং ৯৭ দশমিক শূন্য ২ ডাব্লিউ অক্ষাংশে এ গহ্বরের ব্যাস ৭৪ দশমিক শূন্য পাঁচ কিলোমিটার। হামাদানের বু আলী সিনা বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় ইবনে সিনা একাডেমি অব মেডিয়ীভাল মেডিসিন এন্ড সায়েন্সেস, করাচিতে ইবনে সিনা মেডিকেল স্কুল, তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইবনে সিনা ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিন এবং ফিলিপাইনের মারাভি সিটিতে ইবনে সিনা ইন্টিগ্রেটেড মেডিকেল স্কুল এবং ঢাকায় ইবনে সিনা মেডিকেল সেন্টার তার স্মৃতি বহন করছে। ১৯৮০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিভিন্ন স্মারক ডাক টিকিট ইস্যু এবং তার একটি আবক্ষ প্রতিকৃতি স্থাপনের মধ্য দিয়ে ইবনে সিনার সহস্র জন্মবার্ষিকী পালন করে। বুখারা থেকে ২৫ কিলোমিটার উত্তরে তার জন্মস্থান আফসানার কিষলাকে তার নামে একটি প্রশিক্ষণ কলেজের নামকরণ করা হয়। মেডিকেল স্টাফের এ কলেজের মাঠে নির্মিত একটি জাদুঘর তার জীবন, যুগ ও কর্মের প্রতি উৎসর্গ করা হয়। ২০০৮ সালে মার্চে ঘোষণা করা হয় যে, বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা কর্মীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নয়া ডাইরেক্টরিতে ইবনে সিনার নাম ব্যবহার করা হবে।


চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইবনে সিনার গুরুত্ব

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ইবনে সিনার গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য বিজ্ঞানের ইতিহাসের জনক অধ্যাপক জি. সারটনের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করাই যথেষ্ট। অধ্যাপক সারটন ‘ইন্ট্রডাকশন টু দ্য হিস্টরি অব সায়েন্স’ – এ লিখেছেন, ‘One of the most famous exponents of Muslim universalism and an eminent figure in Islamic learning was Ibn Sina, known in the west as Avicenna. For a thousand years he has retained his original renown as one of the greatest thinkers and medical scholars in history. His most important medical works are Qanun (Canon) and a treatise on Cardiac drugs. The `Qanun Fi-al-Tibb’is an immense encyclopedia of medicine. It contains some of the most illuminating thoughts pertaining to the distinction of mediastinitis from pleurisy’; contagious nature of phthisis; distribution of diseases by water and soil; careful description of skin troubles. of sexual diseases and perversions; of nervous ailments.

অর্থাৎ ‘পাশ্চাত্যে আভিসিনা হিসাবে পরিচিত ইবনে সিনা হলেন মুসলিম বিশ্বজনীনতার সবচেয়ে সুপরিচিত পথপ্রদর্শক এবং ইসলামী জ্ঞান জগতের একজন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। একজন শ্রেষ্ঠতম চিন্তাবিদ এবং ইতিহাসে একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী হিসাবে তিনি হাজার বছর তার মৌলিক খ্যাতি অক্ষুন্ন রেখেছেন। কানুন (ক্যানন) এবং হৃদযন্ত্রের ওষুদের ওপর একটি গ্রন্থ হলো তার চিকিৎসা বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্ম। কানুন ফি আল-তিব্ব চিকিৎসা বিষয়ক একটি বিশ্বকোষ। তাতে রয়েছে ঝিল্লির প্রদাহ থেকে সংক্রামক ব্যাধিকে পৃথক করার কয়েকটি উজ্জ্বল চিন্তা, ফুসফুসের যক্ষার ছোঁয়াচে প্রকৃতি, পানি ও মাটির ভিত্তিতে রোগের শ্রেনীকরণ, চর্মরোগের সতর্ক বিবরণ, যৌন রোগ ও যৌন বিকৃতি এবং স্নায়ুবিক দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা।’


রচনাবলী

ইবনে সিনার রচনাবলী পরবর্তীকালে ধর্ম, দর্শন, গণিত, জ্যেতির্বিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান ও সঙ্গীতসহ বহু ক্ষেতে মুসলিম চিন্তাবিদদের প্রভাবিত করেছে। ব্যাপক বিষয়েল ওপর তার বইয়ের সংখ্যা প্রায় সহস্রাধিক। এসব বইয়ের মধ্যে ২৪০ টির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। তার যেসব বই পাওয়া গেছে সেগুলোর মধ্যে ১৫০ টি হচ্ছে দর্শনের ওপর লিখিত এবং ৪০ টি হচ্ছে চিকিৎসা বিষয়ক। তার বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে আরো রয়েছে দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বিষয়ের আলোচনা সম্বলিত ‘দ্য বুক অব হীলিং’ এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিশ্বকোষ ‘দ্য ক্যানন অব মেডিসিন’। ইবনে সিনা আলকেমির ওপর অন্তত একটি বই লিখলেও তার নামে আরো কয়েকটি বই দেখা যায়। মাইকেল স্কট পশুপাখির ওপর তার একটি বই অনুবাদ করেছেন। দলজিক’, ‘মেটাফিজিক্স’. ‘ফিজিক্স’ ও ‘দ্য কাইলো’তে এরিস্টোটলের মতবাদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। তবে তিনি ‘মেটাফিজিক্স’ – এ নিউপ্লেটোবাদ নামে পরিচিত এরিস্টোটলের মতবাদ থেকে পুরোপুরি পিছু হটেন। আরব দার্শনিকরা আভাস দিয়েছেন যে, ইবনে সিনা এরিস্টোটলের মতবাদকে মুসলিম দর্শনের সঙ্গে মানানসই করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। ১৪৯৩, ১৪৯৫ ও ১৫৪৬ সালে ভেনিসে ইবনে সিনার ‘লজিক’ ও ‘মেটাফিজিক্স’ ব্যাপকভাবে পুনর্মুদ্রিত হয়। চিকিৎসা বিষয়ক তার কয়েকটি প্রবন্ধকে কাব্যিক রূপ দেয়া হয়েছে। বোডলিয়ন লাইব্রেরিতে তার ‘কিতাব আল-শিফা’র একটি বড় অংশ সংরক্ষিত। ১৪৯০ সালে পাভিয়ায় বইটির অংশবিশেষ দি আমিনা’য় ‘লাইবার সেক্সটাস ন্যাচরালিয়াম’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। মোহাম্মদ শাহরাস্তানি ইবনে সিনার দর্শনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে একটি দীর্ঘ বই লিখেছেন। বিশ্লেষণাত্বক বইটি কয়েক জায়গায় পুনর্মুদ্রণ করা হয়। ‘হিকমত আল-মাশরিক্কিয়া’ ল্যাটিন ভাষায় ‘ফিলসোফিয়া ওরিয়েন্টালস’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। রজার ব্যাকন বইটির কথা উল্লেখ করেছেন। বইটির বেশির ভাগ হারিয়ে গেছে।


অন্যান্য বই

(১) সিরাত আল – শায়েখ আল – রইস (দ্য লাইফ অব ইবনে সিনা)

(২) আল – ইশারাত ওয়াল – তানবিহাত (রিমার্কস এন্ড এডমোনিশন্স)

(৩) রিসালাহ ফি সার আল – কাদার (অ্যাসে অ দ্য সিক্রেট অব ডেস্টিনি)

(৪) দানিশনামা – ই – আলা -ই (দ্য বুক অব সায়েন্টিফিক নলেজ)

(৫) কিতাব আল – নাজাত (দ্য বুক অব স্যালভেশন)

(৬) হায় ইবনে ইয়াকধান (এ পার্সিয়ান মিথ)

(৭) দ্য মিনারালিবাস


মৃত্যু

ইবনে সিনা জীবনের শেষ ১০/১২ টি বছর আবু জাফর আলাউদ্দিনের সেবায় কাটান। তিনি তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক, গণপাঠাগার ও বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। তার অনেক অভিযানে তিনি সঙ্গী হয়েছিলেন। এ সময় তিনি সাহিত্য কর্ম ও দর্শন নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করেন। হামাদানের সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানকালে তিনি কঠিন শূল বেদনায় আক্রান্ত হন। ওষুধ সেবন করায় তিনি রক্ষা পান। তবে তিনি এত দূর্বল হয়ে পড়েন যে, কদাচিৎ সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন। অনুরূপ অভিযানে তিনি আবার একই রোগে আক্রান্ত হন। অতি কষ্টে তিনি হামাদানে ফিরে আসেন। রোগের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে তিনি পথ্য গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেন। বন্ধু বান্ধবরা তাকে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন। তিনি সবার পরামর্শ উপেক্ষা করে বললেন, ‘আমি সংকীর্ণ দীর্ঘ জীবনের চেয়ে সংক্ষিপ্ত জীবনকে পছন্দ করি বেশি।’ মৃত্যুশয্যায় অনুশোচনা তাকে গ্রাস করে। ইবনে সিনা দারিদ্রদের মাঝে তার ধন সম্পত্তি বিলিয়ে দেন। ক্রীতদাসদের মুক্তি দেন। শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে প্রতি তিনদিনে তিনি একবার করে কোরআন পাঠ শেষ করতেন। ১০৩৭ সালে রমজান মাসে ইরানের হামাদানে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে এ ক্ষণজন্মা চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইন্তেকাল করেন। হামাদানে তাকে সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর পর আব্বাসীয় খলিফা আল-কাইম তার যাবতীয় গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলেন।