নারায়ণগঞ্জে দু’রাত
ক’ দিন আগে থেকেই প্ল্যান-প্রোগ্রাম চলছিল যে, দু’-চারদিনের ছুটিছাটা ম্যানেজ করে যদি কাছে পিঠে কোথও ঘুরে আসা যায়। বাবাই একটু জঙ্গলপ্রিয়। ওর ইচ্ছে ছিল ডুয়ার্সের দিকে কোথাও একটা যদি বনবাংলো-টাংলো বুক করা যায়, তা হলে ক’টা দিন নিরিবিলিতে গল্পগুজব করে আর নদী-জঙ্গল দেখে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। আমি আবার একটু পাহাড়ঘেঁষা। কাজেই বাবাইয়ের জঙ্গলের ব্যাপারটা মাথায় রেখেই আর-একটু এগিয়ে বললাম, “তার চেয়ে চল বরং লাভা-লোলেগাঁও ঘুরে আসি। ওখানে জঙ্গলও পাবি আবার পাহাড়ের ভিউগুলোও মিস হবে না। আমার প্রস্তাবে বাবাইয়ের খুব একটা আপত্তি ছিল না, কিন্তু বাধ সাধল কৌশিক। ডুয়ার্স, লাভা দুটো প্রস্তাবই খারিজ করে দিয়ে ও বলল, “অত দূর হবে না।”
আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, “হবে না কেন?”
বাবাই বলল, “শর্ট টাইমে রিজার্ভেশনের ঝামেলার ব্যাপারটা ভাবিস যদি, তা হলে বলছি, অসুবিধে নেই কোনও। আগের দিন তৎকাল টিকিট কিনে নেব। একটু খরচ বেশি হবে, এই যা!”
আমিও বললাম, “ট্রেন না হলে রকেটবাসও তো আছে।”
কৌশিক বলল, “হবে না।”
অসহিঞ্চু হয়ে আমি বললাম, “তখন থেকে তো হবে না, হবে না করছিস। কেন হবে না, সেই কারণটা তো বলবি।”
“আসলে ওসব জায়গায় যেতে হলে অন্তত সাত-আট দিন হাতে রাখতে হয়। আমার যা অবস্থা এখন, তাতে অফিস অতদিন টানা ছুটি কিছুতেই দেবে না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল কৌশিক।
“তা হলে?” আমি ওর দিকে তাকিয়ে বলি।
“অন্য জায়গার কথা ভাবতে হবে। আর-একটু কাছাকাছি,” কৌশিক বলল।
“কাছাকছি মানে তো সেই শান্তিনিকেতন কিংবা মুকুটমণিপুর,” বাবাই বিরক্ত গলায় বলে।
“তা কেন, কেওনঝড় চল,” আমি বলি, বাবাইকে সামাল দিতে।
“চল বললেই তো আর যাওয়া যায় না, বিস্তর ঝামেলা এখন ওদিকে। অযথা রিক্স নেওয়ার কোনও মানে হয় না,” একটু উদাসীন গলায় বলে কৌশিক।
“তা হলে তই-ই একটা জায়গা সাজেস্ট কর,” বাবাই রেগেমেগে বলে।
“বলছিস?” সোজা হয়ে বসে কৌশিক।
“বলছি,” বাবাই খাপ্পা।
“তা হলে চল, দিন তিনেকের জন্য নারায়ণগঞ্জ ঘুরে আসি!” এমনভাবে নারায়ণগঞ্জ কথাটা বলল কৌশিক, যেন প্যারিস উচ্চারণ করছে।
“নারায়ণগঞ্জ, সেটা আবার কোথায়?” আমি আর বাবাই দু’জনেই জিজ্ঞেস করে উঠি অবাক হয়ে।
“নারায়ণগঞ্জ একটা ভারী মিষ্টি গ্রামের নাম। একেবারে নিরিবিলি। লোকজনের বাস খুব বেশি নেই। মেলা গাছপালা, ঝোপ-জঙ্গল আছে চারপাশে। একটা ছোট্ট নদীও আছে আঁকাবাঁকা সাপের মতো। আর সেই নদীর ধারেই আছে একটা মস্ত পুরনো বাড়ি। প্রায় ফাঁকা,” যেন রূপকথার কোনও এক গল্প শোনাচ্ছে, এমনভাবে বলে যেতে লাগল কৌশিক।
বাবই বলল, “এত তুই জানলি কী করে? তুই কি আগে কখনও গেছিস ওখানে?”
“না।”
“তা হলে?”
“সুপ্রিয়র কাছে শুনেছি।”
“সুপ্রিয়টা আবার কে?”
“আমার কলিগ।”
“সে-ই বা জানল কী করে?”
“বাড়িটা ওদেরই। ওর ঠাকুরদা বানিয়েছিলেন সেকালে। এখন পড়ে আছে। শুধু এক বুড়ো কেয়ারটেকার আছে দেখাশোনার জন্য। আর আছেন সুপ্রিয়র এক জ্যাঠামশাই, নাম অনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়।”
“উনি অত বড় বাড়িতে একা থাকেন?” একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করি আমি।
“হ্যাঁ,” উত্তর দেয় কৌশিক।
“ওঁর পরিবার?”
“নেই।”
“নেই মানে? উনি কি বিয়ে-থা করেননি?”
“করেছিলেন। কিন্তু বিয়ের সাত বছরের মাথায় ওঁর স্ত্রী আর চার বছরের মেয়ে কীভাবে যেন মারা যায়!”
“কীভাবে মানে?”
“জানি না। আসলে কেউই জানে না। এটা একটা রহস্য। এ-রহস্যের আজও কোনও কিনারা হয়নি। অবনীবাবু নিজেও বিস্তর চেষ্টা করেছিলেন।”
“তারপর?”
“কোনও সমাধান খুঁজে না পেয়ে স্ত্রী আর মেয়ের স্মৃতি আগলে ওই বাড়িতেই থেকে গেছেন তিনি। ওখান থেকে কেউ সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি তাঁকে। তাঁর বিশ্বাস, তিনি তাঁর মেয়ে, বউকে নিয়েই থাকেন ওই বাড়িতে। এখনও!”
বলিস কীরে, এ যে রীতিমতো ভুতুড়ে কাণ্ড,” আমি একটু ভয়ে-ভয়েই বলি।
“বলতে পারিস,” কৌশিক নিরুদ্বিগ্ন গলাতেই উত্তর দেয়।
“তুই কি এইসব আষাঢ়ে গল্প বিশ্বাস করে ফেলেছিস নাকি যে, সত্যিই বাড়িটায় ওসব ব্যাপারস্যাপার আছে?” বাবাই তাচ্ছিল্যের সুরে জিজ্ঞেস করে কৌশিককে।
“আমি বিশ্বাস করি কি না করি সেটা তো কোনও প্রশ্ন না, অবনীবাবু যে ব্যাপারটা বিশ্বাস করেন সে কতাটা তোদের শুনিয়ে রাখলাম শুধু!” ঠান্ডা গলায় বলে কৌশিক।
“কেন শোনালি?” সন্দিগ্ধ গলায় বাবাই জিজ্ঞেস করে,
“এসব শুনেটুনেও তোরা যদি যেতে চাস, আমি তো আর জোর করে তোদের নিয়ে যেতে পারি না।”
“তুই ভাবলি কী করে যে আমরা ভয় পাব?” চোখ পাকিয়ে বলে বাবাই।
“পেতেও তো পারিস,” হাসে কৌশিক।
“কাভি নেহি।”
“ওখানে যাওয়া তা হলে পাক্কা?”
“আলবাত।”
“কথা বলি তা হলে সুপ্রিয়র সঙ্গে?”
“একশোবার।”
আমার কোনও মতামত না নিয়েই কৌশিককে কথা দিয়ে দিল সবাই।
আমি আর কী করব? অগত্যা গন্তব্য নারায়ণগঞ্জ।
⥮২⥯
সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কৌশিকটা বিটকেল আর ডানপিটে। নানারকম সদ্যিপনায় বরাবর সিদ্ধহস্ত ও। আর বাবাইটাও যেন কয়েনের উলটো পিঠ। পৃথিবীতে যে আদৌ ভয় পাওয়ার মতো কোনও বিষয় আছে, ওকে দেখলে কিছুতেই তা বোঝার উপায় নেই। এমনিতে চেহারাটাও ওর বড়সড়। শক্তিও গায়ে প্রচুর। তবে এই অজুহাতে যে-কোনও ভয়ভীতির কথাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার ওর যে বিশ্রী স্বভাব, সেটা আমি আবার কিছুতেই মেনে নিতে পারি না। ছেলেবেলা থেকেই চেহারায় রোগাভোগা আমি। ভয়ভীতিও আমার হাড়মজ্জায়। ভূতপ্রেতের অস্তিত্ব অস্বীকার করার মতো মনের জোরও আমার ছিল না কোনওদিন। অতএব নারায়ণগঞ্জের ওই বিচ্ছিরি ভুতুরে বাড়িতে অ্যাডভেঞ্চার করতে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না আমার। বেশি ধানাইপানাই না করে কৌশিক আর বাবাইকে বলেওছিলাম আমি কথাটা। কিন্তু আমার আপত্তি ধোপে টেকেনি। দু’জনেই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে আমার কথা। উলটে খানিক ঠাট্টা-তামাশা আর উপহাস জুটেছে আমার কপালে, আমার এই অহেতুক ভিতু স্বভাবের জন্য। আমি কথা বাড়াইনি আর। যারা অবুঝ, তাদের বোঝানো শিবের বাবারও অসাধ্য।
অবশ্য, নারায়ণগঞ্জে এসে পৌঁছানোর পর ওদের ওপর আর একটুও রাগ, অভিমান নেই আমার। গ্রামটা সত্যিই যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো সুন্দর। আর যে বাড়িটায় এসে উঠেছি আমরা, সেটা তো প্রায় ছোটখাটো রাজপ্রাসাদ একটা। যদিও সেই বাড়ির জলুস ফিকে হয়ে গেছে এখন। পলস্তারা খসে পড়েছে দেওয়ালের, ছাদের গায়ে-গায়ে আটকে আছে লম্বা-লম্বা ঝুল। তবুও এ-বাড়িতে ঢুকলে বোঝা যায় যে, আগে কেমন জমকালো ছিল বাড়িটা। কেয়ারটেকার হরিপ্রসাদ যে ঘরটাতে থাকতে দিল আমাদের, সাফসুতরো করে বিছানা পেতে, সে ঘরটি পেল্লায় বড়। ঘরটি একেবারে পুব দিকে, সিঁড়ির ঠিক ডান পাশে। পুবের দেওয়ালে লোহার গারদে দেওয়া মস্ত জানলা। জানলার ওপাশে নদী। আপনমনে তিরতির করে বয়ে চলেছে জল। নারায়ণগঞ্জে বিজলিবতির বন্দোবস্ত নেই বলে আমরা একটু নাক সিঁটকেছিলাম। ভেবেছিলাম, এই গরমে পাখার হাওয়া ছাড়া থাকব কীভাবে? কিন্তু দরজা খুলে আমাদের ঘরে ঢুকেয়ে দিয়ে হরিদা যেই দক্ষিণের জানলা দুটো খুলে দিল, সঙ্গে-সঙ্গে এত হাওয়া একসঙ্গে ঘরের মধ্যে লাফিয়ে এল যে, আমাদের আর বৈদ্যুতিক পাখার কথা মনেই পড়ল না।
অবনীবাবুর সঙ্গে দেখা হল আমাদের দুপুরের খাওয়াদাওয়া এবং বিশ্রামের পর, একেবারে বিকেলবেলা। ওঁর ঘরটি দোতলায়। আমাদের ঘরের ঠিক মাথার উপর। উনি নিজের ঘর থেকে বাইরে বেরোন না। শারীরিক সামর্থ্যও নেই তাঁর। হরিদাই তাঁর দেখভাল করে সমস্তদিন। তারপর সন্ধে হতে না-হতেই ভবানীববুকে খাইয়েদাইয়ে নীচে নেমে আসে তার নিজের ঘরে।
আজও অবনীবাবুকে খাইয়েদাইয়ে আমাদের সঙ্গে নিয়েই নীচে নেমে এল হরিদা। বলল, “আপনারা গল্পটপ্প করুন খানিক। আমি ততক্ষণ খাবারদাবারের ব্যবস্থা করি।”
তেলের লন্ঠন জ্বলছে ঘরে। আবছা আলোয় থমথম করছে ঘর। জানলার বাইরে অন্ধকার গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। জোনাকি উড়ছে। ঝিঁঝি ডাকছে একটানা।
কৌশিক বাবাইয়ের কাঁধে চাপড় মারল, “কীরে, তোর বনবাংলোর চেয়ে কিছু খারাপ হল? সত্যি করে বল দিকিনি।”
“ফ্যান্টাস্টিক।” হাসে বাবাই। তারপর বলে, “সত্যি, এই পরিবেশে যেন একটা ভূতটুত না থাকলে মানায় না!”
বাবাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই জানলার ওপার থেকে ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা করে বিশ্রী একটা আওয়াজ করে উঠল কে যেন!
ছাঁত করে উঠল আমার বুকের ভিতরটা। চমকে উঠে লাফিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম আমি।
কৌশিক খপ করে একটা হাত ধরে ফেলল আমার। হেসে বলল, “ভয় পেয়ে গেলি জিতু?”
“আওয়াজটা কী বল তো?” কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করি আমি।
“ভূত নয়, ওটা নেহাতই একটা পাখি খোকাবাবু,” বাবাই ব্যঙ্গ করে বলে আমায়।
“পাখি?” সন্দেহের সুরে আমি বলি।
“হ্যাঁ, প্যাঁচা।” আমাকে আশ্বস্ত করে বাবাই।
“প্যাঁচার ডাকেই যদি ভিমরি খাস তা হলে সত্যি-সত্যিই ভুতুড়ে কিছু ঘটলে তো অক্কা যাবি রে জিতু,” বলে হেসে বিছানার উপর একেবারে গড়িয়ে পড়ে কৌশিক।
নিজের উপর খুব রাগ হয় আমার। সত্যিই আমি বড় অল্পে ভয় পেয়ে যাই। কৌশিক, বাবাইরা ঠিকই বলে বোধ হয় যে, আমার হার্টে নিশ্চিত কোনও গলতি রয়ে গেছে জন্ম থেকেই।
⥮৩⥯
কী একটা অদ্ভুত অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙে গেল আমার। রাতে শুতে যাওয়ার সময় তেলের লন্ঠনটা নিভিয়ে শুয়েছিলাম আমরা। চোখ মেলতেই স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, আলোটা জ্বলছে। এত রাতে আলো জ্বালল কে? ধড়মড় করে উঠে বসলাম আমি। আর কী আশ্চর্য, উঠে বসে দেখলাম, বাবাই আর কৌশিক স্থানুর মতো বসে আছে ওদের বিছানায়। লন্ঠনের আবছা আলোয় কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওদের রাত কত দেখার জন্য মাথার বালিশের পাশ থেকে আমার হাতঘড়িটা বের করলাম। রেডিয়াম লাগানো হাতঘড়ি জানাল তিনটে বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। আমি হতভম্বের মতো জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?” কৌশিক, বাবাই দু’জনেই যেন আমার কন্ঠস্বরে চমকে উঠল। তারপর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকল আমাকে। আমি ওদের কাছে গিয়ে বসতেই চাপা গলায় বাবাই বলল, “কান খাড়া কর। চেষ্টা করে দ্যাখ একটা শব্দ শুনতে পাস কি না।”
আমি একটু চেষ্টা করতেই একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলাম। ঝুম, ঝুম, ঝুম, ঝুম। কে যেন পায়ে নূপুর পরে সিঁড়ি দিয়ে উপর দিকে উঠছে আস্তে-আস্তে।
“ওই যে, ওই যে,” উত্তেজিত গলায় বলি আমি।
“শুনেছি,” একটু কাঁপা-কাঁপা গলায় বলে কৌশিক।
“আওয়াজটা কিসের বল তো?” বাবাই জিজ্ঞেস করে। ওর গলাতেও যেন একটু হালকা উত্তেজনার ছোঁয়া।
“কে যেন হাঁটছে।”
“আমাদেরও তাই মনে হচ্ছে।”
“আওয়াজটা কখন থেকে শুনছিস তোরা?”
“অনেকক্ষণ থেকে। কে যেন আমাদেরই জানলার পাশ দিয়ে হেঁটে উঠোনে উঠে বারান্দা টপকে সিঁড়ি পর্যন্ত এল, আস্তে-আস্তে হাঁটতে-হাঁটতে।”
“কে হাঁটছে, দেখতে পেলি কাউকে?”
“নাঃ।”
“তা হলে কি যা শুনে এসেছি সেই কথাটাই সত্যি নাকি?” ভয়ে ভয়ে বলি আমি।
“হয়তো। তবে আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়,” কৌশিক গম্ভীর গলায় বলে।
“এখনও?” আমি ঠাট্টা করে বলি।
“এখনও,” কৌশিক আরও দৃঢ় গলায় বলে।
“তা হলে চল, বাইরে বেরিয়ে দেখি একবার ঘটনাটা ঠিক কী?” বাবাই উঠে দাঁড়িয়ে বলে কৌশিককে।
“বলিস কী, মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি তোদের?” আমি বলি, “এ অবস্থায় বাইরে বেরোবি কোথায়?”
“তুই তাহলে বোস ঘরে, আমি দেখে আসছি,” বলে উঠে পড়ল কৌশিক।
কৌশিককে উঠতে দেখে আমিও দাঁড়িয়ে পড়লাম একলাফে। এই ঘরের মধ্যে একা-একা থাকার কোনও মানেই হয় না। কাজেই দরজা খুলে আমিও বেরিয়ে পড়লাম ওদের সঙ্গে। বারান্দা, সিঁড়ি কোথাও কোনও পায়ের শব্দ পাওয়া গেল না আর। দেখতেও পাওয়া গেল না কাউকে।
হরিপ্রসাদের ঘরের সামনে গিয়ে দেখা গেল দরজা বন্ধ। ঘরের মধ্যে থেকে তার নাক ডাকার আওয়াজ আসছে। কৌশিক দরজায় ধাক্কা মেরে ডাক দিল, “হরিদা, হরিদা।”
খানিকক্ষণ ডাকাডাকির পর হরিদা দরজা খুলল। আমাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভারী অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনারা এত রাতে?”
“এখান দিয়ে একটু আগে কাউকে হেঁটে যেতে শুনেছ হরিদা?” বাবাই জিজ্ঞেস করল উত্তেজিত কন্ঠে।
একবার আপাদমস্তক দেখে নিল আমাদের হরিদা। তারপর কঠিন এবং ঠান্ডা গলায় বলে উঠল, “ও আওয়াজ গত তিরিশ বছর ধরে শুনে আসছি দাদারা। ও নিয়ে মাথা ঘামাই না আমি। তোমরাও ঘামিও না। চুপচাপ শুয়ে পড়ো ঘরে গিয়ে। ভোর হতে এখনও দেরি আছে খানিক।”
ঘরে আমরা ফিরলাম বটে। কিন্তু ঘুম হল না একটুও। বিছানার উপর এপাশ-ওপাশ করতে-করতে একসময় পুবের জানলার ওদিককার আকাশ লাল হয়ে উঠল। তারপর ছাই-ছাই অন্ধকার সরিয়ে সে র্যের আলো ফুটতে শুরু করল ধীরে-ধীরে।
ট্রেনের জানলায় মাথা রেখে চুপচাপ বসে আছে কৌশিক। বাবাই মাথাটাকে এলিয়ে দিয়েছে পিছনের দেওয়ালে। আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছি বাইরের নীল আকাশের দিকে, যে আকাশ অনন্ত, অসীম। মৃত্যুর পরেও ওই আকাশেই হারিয়ে যেতে হয়? নাকি সকলকেই ফিরে-ফিরে আসতে হয় আপনজনের টানে, পূর্ব জীবন ঘিরে থাকা যাবতীয় চিহ্ন ও স্মৃতির টানে। কে জানে এ প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর কী! কৌশিক বা বাবাই এখন কী ভাবছে জানি না, তবে এই সত্যিটুকু বোধ হয় আর ওদের স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, শুধু গায়ের জোর আর গোঁয়ার্তুমি দিয়ে এই পৃথিবীর হাজারও রহস্যকে, দীর্ঘলালিত ভয় আর বিশ্বাসকে এক লহমায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নারায়ণগঞ্জে প্রথম রাতের আতঙ্ক কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে-সঙ্গেই আমি ওদের ফিরে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তখন আমার কথা শুনলে এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার ঝড় আমাদের সামলাতে হত না। কিন্তু এ বোধ হয় দৈবেরই লিখন। ঈশ্বর স্বয়ং বুঝি চেয়েছিলেন যে, ওদের দর্প চূর্ণ হোক। তাই ওদের এই বুদ্ধিভ্রম। আমার কোনও কথা, কোনও যুক্তিকেই আমল না দিয়ে শুধুমাত্র জেদ করে থেকে গেল ওরা এই মৃত্যুপুরীতে আরও একটা দিন!
দিনেরবেলাটা ভালই কাটল আমাদের ঘুরে বেড়িয়ে, গল্পগুজবে। খাওয়াদাওয়ারও খামতি ছিল না কোনও। আর হরিদার রান্নার হাতটাও চমৎকার। তবে একটা ব্যাপার দুপুর থেকেই কেমন যেন খটকা লেগেছিল আমাদের মনে। হরিদা যেন বড় বেশি গম্ভীর আজ! খটকাটা চরমে উঠল যখন সন্ধে হতে না-হতেই খাবারদাবার নিয়ে আমাদের ঘরে ঢুকল হরিদা।
আমরা অবাক হয়ে বললাম, “এত তাড়াতাড়ি রাতের খাবার কেন হরিদা? তুমি কি যাবে কোথাও?”
“না,” গম্ভীর গলায় উত্তর দিল হরিদা।
“তা হলে?”
“আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে দরজা দিয়ে শুয়ে পড়ো একদম।”
“কেন?”
“কারণ আছে।”
“কী কারণ?”
“ওঃ বলছি তো আছে একটা কারণ আছে!”
“আমাদের বলতেই হবে, না হলে খাব না আমরা এখন। সবাই মিলে ছাদে উঠে বসে থাকব।”
“কোথায়?” যেন আগুন খেলে গেল হরিদার চোখে।
“ছাদে,” খুব শান্ত গলায় বলল কৌশিক।
“খবরদার,” চিৎকার করে উঠল হরিদা, “সিঁড়ির আশপাশেও যাবে না আজ কেউ তোমরা।”
“কেন?”
“আমি বলব না।”
“তা হলে আমরা যাব।”
“আজকের দিনে ওঁরা বাবুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আজই ওঁরা চলে গিয়েছিলেন কিনা, বাবুকে ছেড়ে দিয়ে।”
“কারা?”
“বাবুর স্ত্রী আর তুলি দিদিমণি।”
“তুলি দিদিমণি?”
“বাবুর মেয়ে। ও মাঝে-মাঝেই এখানে আসে। ছোটাছুটি করে, খেলে বেড়ায়। কালও এসেছিল। আপনারা তো নিজের কানে শুনেছেন।”
“ওটা তোমার কারসাজি, বানানো।”
“না, না, না,” বলতে-বলতে ঘর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে গেল হরিপ্রসাদ, খাবারের জায়গাগুলো ঘরের মধ্যে রেখে দিয়ে।
রাত যত বাড়তে লাগল আমাদের উৎকন্ঠা আর উত্তেজনার পারদও চড়তে লাগল ক্রমাগত। বাবাই আর কৌশিকের উত্তেজনার মাত্রাটা যেন কিছুটা বেশিই। নিজেদের সঙ্গেই বোধ হয় কী একটা লড়াই চলছে ওদের মনে। ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার। বাইরে অন্ধকার আরও গাঢ়, আরও জমাট। মাঝে-মাঝে দমকা হাওয়ায় লন্ঠনের আলো কেঁপে-কেঁপে উঠছে। আর সেই কাঁপনে ঘরের দেওয়ালে আমাদের তিনজনের আবছা ছায়াও কেঁপে-কেঁপে উঠছে এমনভাবে যে, নিজেরাই যেন আচমকা শিউরে-শিউরে উঠছি মাঝে-মাঝে। এভাবে অপেক্ষায় আর উৎকন্ঠায় পার হয়ে গেল দু’-তিন প্রহর। ক্রমশ ঘুম নামতে চাইল চোখের পাতায়। আমরাও ভাবছি বিছানায় গা এলিয়ে দেব কিনা, এমন সময় রাতের নিথর নীরবতাকে খানখান করে ভেঙে দিয়ে সমস্বরে চিৎকার করে কেঁদে উঠল তিন-চারটে কুকুর। সে চিৎকার এমনই তীব্র আর এমনই ভয়ানক যে, আমরা তিনজনই ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালাম বিছানা থেকে নেমে। আর তারপরই কুকুরের সেই তীব্র ভয়ংকর কান্নার রোল বাতাসে মিলিয়ে যেতে না-যেতেই শুরু হল সেই অপার্থিব পদধ্বনি। মৃদু অথচ স্পষ্ট। ঝুম, ঝুম, ঝুম, ঝুম। আমাদের দরজা পেরিয়ে বারান্দায় দু’-একবার হাল্কা পদচারণার পর সেই শব্দ ক্রমশ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকল উপরে। আরও উপরে।
মুহূর্তে কেমন যেন থমথমে হয়ে উঠল সমগ্র প্রকৃতি। হাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়ে গুমোট হয়ে উঠল ঘরের মধ্যেটাও। এমনকী, বাইরে তিরতির করে বয়ে চলা নদীটাও যেন ভয়ে গুটিয়ে নিল তার জলস্রোত। সমগ্র চরাচরে ওই একটানা ঝুম-ঝুম আওয়াজ ছাড়া যেন শব্দ নেই আর।
নিজের ব্যাগ খুলে একটা টর্চ হাতে নিয়ে চকিতে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে পড়ল কৌশিক। পিছন-পিছন আমি আর বাবাই।
সিঁড়ির উপর টর্চের আলো ফেলল কৌশিক। কেউ নেই সেখানে। অথচ সেই ঝুম-ঝুম আওয়াজের কোনও বিরতি নেই। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকি আমরা। দোতলায় উঠে অবনীবাবুর ঘরের দিকেও চোখ বোলাই একবার। ঘর বন্ধ। কোনও শব্দ নেই বন্ধ ঘরের ওপারে। অবনীবাবু কি ঘুমোচ্ছেন? কত কিছু ঘটে যাচ্ছে এখানে, তার কিছুই কি আঁচ করতে পারছেন না তিনি? বাবাই হঠাৎ একটা আলতো চাপ দেয় আমার কাধেঁ। আমি দাঁড়াই। শব্দ শুনি। সেই নূপুরপরা পা দু’খানা এখন খেলে বেড়াচ্ছে ছাদের উপর। আমরা ছাদের কাছাকাছি পৌঁছাতেই একটা মেয়েলি কন্ঠস্বর ছিটকে এল উপর থেকে, “তুলি, তুলি শিগগিরি এসো।”
আমরা ছাদের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজা ভেজানো। খিল দেওয়া নেই তাতে। একটা দরজা ফাঁক করে আমরা চোখ রাখলাম ছাদে। তখন চাঁদ উঠেছে আকাশে। জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে ছাদ। আর সেই জ্যেৎস্নায় স্পষ্ট দেখলাম আমরা একটা ছোট্ট মেয়েকে। পায়ে তার মল। পরনে লাল টুকটুকে ফ্রক। সে খেলছে, ছুটে বেড়াচ্ছে ছাদের এ-প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। হঠাৎ আর-একজন মহিলা মেয়েটিকে সামনে এসে দাঁড়িয়ে ধমক লাগালেন তাঁকে, “তুলি, দুষ্টুমি নয়, বাবা বকবেন।”
“কোথায় বাবা?” বলে খিলখিল করে হেসে উঠল তুলি।
“এই তো আমি এসে গেছি মামণি,” বলে যে লোকটি তুলির সামনে এসে দাঁড়ালেন, তাঁকে দেখে আমরা তিনজনই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। ইনি তো অবনীবাবু! অথচ এ কী করে সম্ভব! তিনি যে প্রায় চলচ্ছক্তিরহিত রোগজীর্ণ মানুষ। তুলি ছুটছে। ঝুমঝুম করে বাজছে তার পায়ের নূপুর। অবনীবাবুও ছুটছেন, তার দিকে দু’হাত বড়িয়ে দিয়ে। ছুটতে-ছুটতে তুলি এখন ছাদের কিনারে। অবনীবাবু দাঁড়াচ্ছেন না। কী সর্বনাশ, পড়ে যাবেন যে উনি ছাদের আলসে পেরিয়ে। সব ভুলে চিৎকার করে উঠলাম আমরা িএকসঙ্গে, “অবনীজেঠু।”
মুহূর্তে থেমে গেল দৌড়। তুলিকে বুকে চেপে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলেন অবনীবাবু। আর সেই মহিলা হা, হা, হা, হা করে হাসতে-হাসতে মুখ ফেরালেন আমাদের দিকে। ওঃ কী বীভৎস সেই দৃষ্টি! কী ভীষণ কুৎসিত পচা-গলা আগুনে ঝলসানো সেই মুখাবয়ব। প্রচণ্ড ভয়ে চিৎকার করতে-করতে দুদ্দাড় করে নীচে নেমে আমরা অবনীবাবুর ঘরের সামনে দাঁড়াই। দম নিই বুক ভরে। বাবাই টোকা মারে দরজায়। দরজা খুলে যায় খটাং করে আওয়াাজ তুলে পাল্লায়। ঘরের মধ্যে ঢুকে আরও ঘাবড়ে যাই আমরা। পুবের আকাশ থেকে ছিটকে আসা হাল্কা গোলাপি আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মস্ত খাটে বিছানার সঙ্গে মিশে গিয়ে শুয়ে আছেন অবনীজেঠু। চোখ বোজা। মুখের ভাব প্রশান্ত। এমনকী, ঠোঁটের কোণে একটা হাল্কা হাসির ছোঁয়াও লেগে রয়েছে যেন। দিশেহারা হয়ে চিৎকার করতে থাকি আমরা, “হরিদা, হরিদা।” হাঁকাহাঁকিতে একটু পরেই দৌড়ে আসে হরিপ্রসাদ। আমাদের হাত ধরে এনে বসায় নীচের ঘরে। ভিতরের আলো আর-একটু উজ্জ্বল হতেই মধুডাক্তারকে ডেকে আনে হরিদা। মধুডাক্তার ভাল করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রায় দেন, অবনীজেঠুর মৃত্যু হয়েছে অন্তত ছ’সাত ঘন্টা আগে।
ব্যাগ গুছিয়ে চলে আসার সময় হরিদা সামনে এসে দাঁড়ায়। বিনয়ের সঙ্গে বলে, “সুপ্রিয়কে খবরটা দেবেন।”
আমরা বলি, “নিশ্চয়ই।”
হরিদা আরও বলে, “সময়সুযোগ পেলে আসবেন আবার - আমি তো রইলুম!”
হরিদার বলা সবক’টা কথাই কানে গিয়েছিল। কিন্তু এ-কথার কোনও উত্তর দেওয়া হয়নি আমাদের কারও...........!

0 মন্তব্যসমূহ