কপালের কাটা দাগটা
না আমি না, আমাদের বাড়ির লোক - আমরা কেউ কখনও ভূত দেখিনি। অথচ বাড়িতে কখনও যদি ভূত-প্রসঙ্গ ওঠে, আমরা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সবাই কেমন আনমনা হয়ে যাই। তখন আমরা কেউ কারও সঙ্গে কথা বলি না যদিও, আমরা প্রত্যেকেই জানি, আমরা কী ভাবছি।
ঊর্মিলাদি ছিল আমাদের মামার বাড়ির কাজের লোক। কিন্তু একথা আমরা জেনেছি যথেষ্ট বড় হওয়ার পর। আমার মা-মাসিদের চেয়ে বয়সে বেশ খানিকটা বড় ছিল। এমনকী আমাদের বড়মামার চেয়েও। মায়ের মা’কে ‘পিসি’ বলে ডাকত। সেই সুবাদেই মায়েদের দিদি। আমরা সব ছোটরাও তাকে ‘উর্মিলাদি’ বলে ডাকতাম। কষ্টিপাথরের মতো কালো, গোলগাল চেহারা। মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা উর্মিলাদি, গরমের ছুটিতে আমরা সবাই যখন মামারবাড়ি যেতাম, আমাদের সব ক’টাকে কাছে বসিয়ে বাগানের আম ছেঁচে খাওয়াত। বড় হয়ে কত জায়গায় কতবার আম-ছেঁচা খেয়েছি, কিন্তু ওইরকম টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদের আম-ছেঁচা আর কখনও খাইনি।
ঊর্মিলাদি এসেছিল আমাদের দিদুর বাপের বাড়ির দেশ থেকে। কোনও এক বছর গাঁয়ে নাকি মড়ক হয়েছিল। সেই মড়কে স্বামী আর মেয়েকে হারিয়ে তিন বছরের একটা পুঁয়েপাওয়া বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দিদুর কাছে এসে পড়েছিল।
দিদু তাকে শুধু থাকতেই দেননি, তাকে বাড়ির একজন করে নিয়েছিলেন। ছেলেবেলায় দেখেছি, মামার বাড়ির আর সব কাজের লোকের উপর ঊর্মিলাদির কী চোটপাট।
মা-মাসি-মামাদেরও ছেড়ে কথা বলত না। শুধু বড়মামাকে দেখেছি ঊর্মিলাদিকে ধমকে কথা বলতে।
ঊর্মিলাদির ছেলে আমাদের চেয়ে একটু বড়ই ছিল। আমার বড়মামার ছেলে জ্যেতিদার বয়সি। এ বাড়িতে আসার পরই জ্যোতিদার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল তার। ওইটুকু রোগাভোগা, প্যাকাটির মতো শরীরটায় যেখানে পেরেছে ঊর্মিলাদি তাগা, তাবিজ, রাতচরা পাখির হাড় পরিয়ে রেখেছিল। কোনওটা নাকি নজর লাগার মাদুলি, কোনওটা আবার মন্দ বাতাসের তাবিজ। গলা থেকে কালো করে বাঁধা একটা রুপোর চাকতি লকলক করে ঝুলত। তাতে ‘রামনাম’ লেখা ছিল।
অন্য কাজের মেয়েরা দিদুকে আড়ালে একচোখা বলত। বাপের বাড়ির লোক বলে নাকি ঊর্মিলাদিকে স্পেশ্যাল খাতির! দিদুর কানে কথাটা উঠতে তিনি হেসেছিলেন, “নিশ্চয়ই আমি ঊর্মিলাকে স্পেশ্যাল খাতির করি, তবে তা আমার বাপের বাড়ির লোক বলে নয়, ওর স্বভাবচরিত্রের জন্য। বাকিগুলো তো সব ছিঁকছোঁক। আর ঊর্মিলা? এই যে এত ফুলফুরি, ফেলাছড়ানো খাবারদাবার, কেউ বলতে পারবে নিজের ছেলেকে কখনও লুকিয়ে কিছু খাইয়েছে?”
ঊর্মিলাদি ছেলেকে ডাকত ‘পচা’ বলে। নাম শুনে আমরা হাসাহাসি করতাম, “পচা আবার কারও নাম হয় নাকি? লোকে শুনে হাসে!”
আমাদের কথা শুনে ঊর্মিলাদি আমাদের কষে ধমক দিত, “হাসুক। শত্তুরে য্যাত হাসবে, আমার পচার পেরমাই বাড়বে।”
দিদুর কাছে শুনেছিলাম, কোনও ছেলের নাম পচা হলে যম নাকি ফিরেও দ্যাখে না।
আমাদের যখন ছ’-সাত বছর বয়স, পচার তখন কত হবে? নয়-দশ। কিন্তু দেখতে লাগত পাঁচ বছরের ছেলের মতো। কাঠি-কাঠি হাত পা, তায় আবার সর্বাঙ্গে তাগা-তাবিজ। কিন্তু দেখতে বাচ্চা হলে কী হবে, দুষ্টুমিতে ছিল আমাদের গুরুঠাকুর। ওই বয়সেই তরতর করে তালগাছ বেয়ে মাথায় চড়ে কাঁচা তালের কাঁদি কেটে মাটিতে ফেলত। গাছ থেকে নেমে নিজের হাতে তাল কেটে আমাদের যে কত কচি শাঁস খাইয়েছে! দিদু ওকে গাঁয়ের ইউ পি ইশকুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। বড়মামার ছেলে জ্যেতিদার সঙ্গে ন্যাকড়ার বইদপ্তর বগলে নিয়ে ইশকুলে যেত। তাতে কী রাগ বড়মামার! দিদুর মুখের উপর কিছু বলতে পারবেন না, বোনেদের কাছে গজরাত, “মায়ের কী আক্কেল দ্যাখ সদু, কাজরে লোকের ছেলের জন্য কাঁড়ি-কাঁড়ি পয়সা খরচা? তা ছাড়া এই যে জ্যোতির সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে, এসব কী কারবার? মানা যায় না আমাদের?”
ছেলে ইশকুলে যাচ্ছে দেখে ভারী খুশি ঊর্মিলাদি, “গরিবের ছেলে, উ কি আর জজ ম্যাজেস্টার হবে? পিসির দয়ায় যদি পেতে দু’কলম বিদ্যে ঢোকে, বেধবার বাপমরা ছেলে দুটো খুদ-কুঁড়ো খুঁটে খেতে পারবে।” পচা কিন্তু ইউপি ইশকুলের গণ্ডি পার হতে পারেনি।
পারবেই বা কী করে? নামমাত্র ইশকুলে যাওয়া। তাও মা আর দিদুর ভয়ে। পড়াশোনার সময় কোথায় ছিল তার? সারাদিন গুলতি হাতে মাঠেঘাটে ঘুরছে কিংবা বনজঙ্গলে ঢুঁড়ে কোনওদিন ধামা-ধামা ঘি-করলা, কোনওদিন খামআলু তুলে আনছে। তা ছাড়া জ্যোতিদার জন্যে ডান্ডাগুলি বানানো, তির-ধনুক তৈরি করা। পাখমারা বলে এক ধরনের বেদে তখন গাঁয়েগঞ্জে খুব দেখা যেত। তাদের কাজই ছিল পাখিধরা। তা সে যে-কোনও পাখিই হোক। তাদের সঙ্গে ভাব করে কত রকমের ফাঁদ তৈরি করতে শিখেছিল ওইটুকু বয়সে। প্রায়ই হাঁড়ি-ফাঁদ পেতে ডাহুক কী বনমোরগ ধরে আনত, আঠাকাঠি পেতে ধরত ঘুঘু, পায়রা, তিতির। বড়মামার কড়া মানা ছিল, নিজের ছেলে যেন পচার সঙ্গে না মেশে। রীত-স্বভাব খারাপ হয়ে যাবে। যদিও আমরা ভাইবোনেরা পচাকে মুখে কোনও খারাপ গালাগাল পর্যন্ত বলতে কখনও শুনিনি। বরং পচা ছিল আমাদের হিরো।
জ্যোতিদাকে কম মার খেতে হয়নি পচার সঙ্গে মেশার জন্য। বড়মামা যেন তক্কেতক্কে থাকতেন, কখন দু’জনকে হাতেনাতে ধরেন। ধরলেই দিদুকে দেখিয়ে জ্যোতিাদাকে বেদম ঠ্যাঙাতেন, বলতেন, “মামাবাড়ি পাঠিয়ে দোব তোকে। একটা ছেলে! এরা চায় না ছেলে আমার মানুষ হোক। যার-তার সঙ্গে মিশে-মিশে একটা ডাকাত হবে।”
তখনকার যুগে যেসব ছোটদের কিছু হবে না বলে বড়রা মনে করতেন, তাদের ধরেই নেওয়া হত, তারা ডাকাত হবে। বাড়িতে বা ইশকুলে যতটা সম্ভব দু’জন দু’জনকে এড়িয়ে গেলেও, তখনকার পাড়াগাঁয়ে যে’বন্ধুতে একপ্রাণ হয়ে গল্প করার মতো লুকনো জায়গা ঢের ছিল। বড়মামা ওত পেতে থেকেও ধরতে পারতেন না। আর জ্যোতিদা বস পরীক্ষাতেই ফার্স্ট হত বলে ওকে কিছু বলার বা পচাকে নিয়ে খোঁটা দেওয়ার মুখ থাকত না বড়মামার।
সেবার কার বিয়ে না মুখেভাত মনে নেই, মামাবাড়ি গিয়ে শুনি, পচা ঊর্মিলাদির হাতে খুন হতে-হতে বেঁচে গিয়েছে। কপালজোড়া ব্যান্ডেজ নিয়ে পচা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। ইশকুলের রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল, জ্যোতিদা বরাবরের মতো ফার্স্ট হয়েছে। আর পচা নাকি পরীক্ষাই দেয়নি। পরীক্ষা ক’দিন খেয়েদেয়ে তালপুকুরের আমবনে ঢুকে গেনিবুড়ির ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছটার খোঁদলে সারা দুপুরটা দিব্যি ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। খবরটা জানাজানি হতেই, ঊর্মিলাদি দা দিয়ে কী যেন কাটছিল, হাতের কাছে পচাকে পেয়েই বোঁ কের ছুড়ে মেরেছে। লাগবি তো লাগ ডান দিকের কপালে! কী ভাগ্যি, চোখটা বেঁচে গেছে! জ্যোতিদা বলেছিল, “মরেই যেত পচা, নেহাত ফেলুডাক্তার সেদিন বামুনপাড়ার কলে এসেছিলেন। প্যাটপ্যাট করে পাঁচ-পাঁচটা সেলাই আর এই অ্যাত্ত বড় সিরিঞ্জে ঠুসে-ঠুসে ইঞ্জেকশন। সে কী পাঁঠাকাটা রক্ত রে, টুনি, দেখলে ভিমরি যেতিস!”
ঊর্মিলাদি কেঁদেকেটে বাড়ি মাথায় করেছিল। না, পচা মরে যেতে পারে সেই ভয়ে নয়, “পেটের শত্তুর, মর মর! বেধবা মা নোকের ঘরে গতর খাটিয়ে পেটের মাড়ি জোগাড় কচ্চে, মায়ের দুখ্যুটা বুজলনি, এমন আপনদ!”
বড়মামা শুনিয়েছিলেন, “খুব হয়েছে! আর-একটু হলেই তো হাতে দড়ি পড়ত! ছেলে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে! বুকে যার ভয়ডর নেই, মিলিয়ে নিও আমার কথা! সে ছেলে ডাকাত হবে। এরকম বদসঙ্গে পড়ে বাড়ির আর সব ক’টাই না বিগড়ে যায়!”
দিদু খুব বকেছিলেন ঊর্মিলাদিকে, “মারিস না বাপু অমন করে! পাঁচটা নয়, দশটা নয়, একটা! তাকে আর হারাসনি। বিদ্যে কি সবার হয়? তার জন্য আগের জন্মের পুন্যি লাগে।”
ঊর্মিলাদি উত্তর দিয়েছিল, “আমি কি সারা জেবনটাই লোকের ঘরে খাটব! আজ তুমি আচ, আমার কুনও অভাব নাই, তুমি য্যাখুন না থাকবে?”
দিদু বলেছিলেন, “সেবস আমি ভেবে রেখেছি। কত্তা যে আমার নামে দশ বিঘে জমি লিখে দিয়ে গেছে, তার থেকে তোকে আমি দু’বিঘে দিয়ে যাব। মায়েপোয়ে খেতে-পরতে পাবি। আর তোরও তো এ সংসারে মাইনে বলে কিছু পাওনা আছে। সব জমিয়ে রাখছি, থোক দিয়ে যাব।”
জ্যেতিদাদা কাছে ছিল। দিদুকে অভয় দিয়েছিল জ্যোতিদাদা, “তুমি কিছু ভেবো না ঠাকুন। ঊর্মিলাদি আর পচাকে আমি দেখব।”
ঊর্মিলাদি নাকি ওইটুকু ছেলের কথা শুনে হেসে-কেঁদে অস্থির।
এমনিতে এককথার মানুষ দিদু তাঁর কথা রাখেননি। রাখতে পারেননি। তখনকার পাড়াগাঁয়ে স্ট্রোক কথাটা তেমন চালু ছিল না, লোকে বলত সন্ন্যাস রোগ। দিদুরও হয়েছিল। মাথায় রক্ত উঠে ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন দিদু। আর জ্ঞান ফেরেনি। নতুনপাড়া থেকে ফেলুডাক্তার এসে বলেছিলেন, “সেরিব্রাল।” যে-কোনও সময় মরে যেতে পারে জেনেও লোকে যে কেন লোককে কথা দেয়!
মাথার ঘা শুকিয়েছিল দিন পনেরোর মধ্যে। কপালের ডান দিকে দাগটা থেকে গিয়েছিল পচার। ঊর্মিলাদি মাঝে-মাঝে বলত পচাকে, “দাগটা থাকলে মানুষ হবি।”
কিন্তু মানুষ হওয়া আর কই হয়ে উঠল পচার? দিদুর কাজকর্ম চুকতেই বড়মামা ঊর্মিলাদিকে সকলের সামনে ডেকে বলেছিলেন, “আমি একলা রোজগেরে মানুষ। এত ছোট-ছোট ভাই। আমি ওসব উটকো লোক পুষতে পারব না। তোমরা এবার নিজেরটা দেখে নাও।”
কিছুদিন হল বড়মামা প্রাইমারি ইশকুলে চাকরি পেয়েছেন। দিদিমার অবর্তমানে তিনিই ফ্যামিলির হেড। মেজোমামা, ছোটমামা তখন কলেজে-ইশকুল। চাকরি পাওয়ার পর বড়মামা বাহিরগঞ্জ টাউন থেকে ভারিক্ক কালো ফ্রেমের চশমা পরে, এমনিতেই গম্ভীর, আরও গম্ভীর সেজেছেন। বরাবরই বড়মামা রাগী মানুষ। তায় ভাইদের চেয়ে বয়সে অনেকখানি বড়। ভাইরা কেউ দাদার মুখের উপর কথা বলতেন না। বড়মামার কথা শুনে কাকিয়ে উঠেছিল ঊর্মিলাদি, “আমার যাবার কুন চুলো আচে তোরাই বলে দে। পিসি বলেছিল, আমাকে বাস করার জন্যে ভিটে দেবে।”
জ্যোতিদা ফস করে বলে উঠেছিল, “আর চাষ করার জমি? ঠাকুন, জানো বাবা, ঊর্মিলাদিকে চাষের জমিও দেবেন বলেছিলেন। আমি নিজের কানে শুনেছি।”
বড়মামা ছেলের চুল ধরে গালে দু’থাপ্পড় মেরেছিলেন, “তোর কানে কামড়ে সাক্ষী রেখে মা বলেছিলেন? মা বলেছিলেন ভিটে দেবেন, আর আমি জানলাম না? কী ঊর্মিলাদি, জোতেকে বশ করে সাক্ষী দেওয়াচ্ছ? ভগবান এসে বললেও আমি মানব না, মায়ের ইচ্ছের যদি কিছু কাগজপত্তর থাকে দেখাও, এক্ষুনি ঘাড় কাত করে দিয়ে দিচ্ছি। না থাকে ফোটো।”
মার খেয়েও জ্যোতিদার লজ্জা হয়নি। ফের বলেছিল, “টাকুন বলেছিল ঠাকুনের কাছে ঊর্মিলাদির মাইনের টাকা জমা আছে। থোক দেবে।”
বড়মামা আর গায়ে হাত তোলেননি, হো হো করে হেসেছিলেন, “শুনলে তোমরা, জোতে কেমন মিথ্যুক হয়েছে? হবেই যে আগেই বলেছিলাম। কাজের লোকের ছেলের সঙ্গে মিশে-মিশে কী হয়েছে দ্যাখো! আমার মরা মায়ের নামেও মিথ্যে কথা বলতে ছাড়ে না।” বড়মামা এক রকম দুর-দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ঊর্মিলাদি আর পচাকে।
কিন্তু মামাদের পাড়ার লোকেরা শুধু ছি-ছি’ই করেনি, এজমালি চাঁদপুকুরের পড়ে ছিটেবেড়ার ঘর করে ওদের বসতে দিয়েছিল। কেউ খড়, কেউ বাঁশ, কেউ চাল-মুড়ি, যে যেমন পেরেছে দিয়ে সাহায্য করেছে। এমনকী বড়মামি যে তাঁর স্বামীর ভয়ে চব্বিশ ঘন্টাই জুজু, জ্যোতিদার হাত দিয়ে লুকিয়ে টাকাপয়সা, চাল, নুন মাঝে-মাঝে পাঠিয়ে দিতেন। জ্যোতিদাই বলত আমাদের। জ্যোতিদা আরও বলত, “আমার বাবা না রাগী! পচাকে দু’চোখে দেখতে পারেন না। আমি পচাকে বলেছি, বড় হই, তোদের আমি ঠিক ভিটে-জমি দিয়ে দোব।”
পচা জগৎ গাঙ্গুলির বাড়িতে গোরু-বাগালি করতে ঢুকেছিল, আর ঊর্মিলাদি লোকের বাড়ি-বাড়ি মুড়ি ভেজে, ঢেঁকিতে চাল ছেঁটে সংসার চালাত।
প্রাইমারি ইশকুলে বৃত্তি পেয়েছিল জ্যোতিদা। নতুন পাড়ার ইশকুলের মাস্টারমশাইরা বাড়িতে এসে বড়মামাকে ধরেছিলেন, ছেলে যেমন তাঁদের ইশকুলেই ভর্তি হয়। দিনকাল তখন এরকমই ছিল। পাড়াগাঁয়ের হাই স্কুলে ছাত্র ছিল কম, আর বৃত্তি পাওয়া ছেলেরা বাহিগঞ্জের বড় ইশকুলে পড়তে যেত। গাঁ থেকে সেও প্রায় দশ ক্রোশ রাস্তার ধাক্কা। বড়মামা যা কৃপণ, হয়তো ঘরের খেয়ে ম্যাট্রিক পাশ হবে তাই নতুন পাড়াতেই ভর্তি করতেন! কিন্তু জ্যেতিদা ধরা পড়ে গেল।
তখন পাড়াগাঁয়ে ফোটো তোলার অত চল হয়নি। রঘুবাটিতে শিবরাত্রির মেলা দেখতে গিয়েছিল ওরা দু’জনে। জ্যোতিদা আর পচা। মেলাতেই ফোটোর দোকানে দু’জনে একসঙ্গে ফোটো তুলিয়েছিল। গাঁয়ের কারওর চোখে পড়ে থাকবে, সে এসে বড়মামাকে লাগিয়ে দেয়। সিদ্ধান্ত নিতে তিলমাত্র আর দেরি করেননি বড়মামা। বাহিরগঞ্জের হস্টেলে রেখে এসেছিলেন ছেলেকে। পরের বছর ইশকুলের মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে পায়ে কী ফুটেছিল। ধনুষ্টঙ্কারে সকলের চোখের সামনে ধনুকের মতো যন্ত্রণায় বেঁকেচুরে জ্যোতিদা মরে গেল। বড়মামি মেলায় তোলা ফোটোটিকে বাঁধিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছিলেন। অবশ্যই বড়মামা শুধু জ্যোতিদার ফোটোটাই বাঁধিয়েছিলেন। পচা কেটে বাদ। ফলে জ্যোতিদার একটা হাত ফোটোতে ছিল না। সেটা ছিল পচার কাঁধে। জ্যোতিদা মরার পর ছ’মাসও হয়নি পচা পালিয়েছিল। আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। খোঁজ যখন পাওয়া গেল তখন ঊর্মিলাদি মরমর। কোত্থেকে একদিন হঠাৎ উদয় হয়েছিল পচা।
দিদু চলে যাওয়ার পর থেকেই মামাবাড়ির সঙ্গে আমাদের সকলের টানটাই কেমন আগলা হয়ে আসছিল দিনদিন। বড়মামা আমাদের খোঁজখবর রাখতেন না। মাও কেমন আর যাওয়ার গা করতেন না। তা ছাড়া বাবার ছিল বদলির চাকরি। রেলের ডাক্তার। আজ পাকুড় তো কাল চলো তল্পিতল্পা বেঁধে কৃষ্ণনগর। আমরাও বড় হয়েছি, কলেজ-ইশকুলে পড়ি। কিন্তু মামাবাড়ির জন্য আমাদের সকলেরই কখনও-কখনও মন খারাপ করত। বিশেষ করে কাঁচা আমের দিনের দুপুরগুলোয়। আমরা ভাইবোনেরা মিলে বাজার থেকে কাঁচা আম এনে কতবার ছেঁচে খেয়েছি। যা যা মশলা দিত ঊর্মিলাদি, সব মিশিয়ে দেখেছি। জিভে লেগে থাকা ঊর্মিলাদির হাতের কাঁচা-আম ছেঁচার সেই স্বাদ আমরা আনতে পারিনি। বড়মামার উপর রাগ হত খুব। কী মানুষ রে বাবা! নিজের মায়ের পেটের বোনদেরও দেখতে ইচ্ছে করে না? আমরা না হয় পর। অথচ মায়ের মুখেই শুনেছি, বোনদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবসাতেন বড়মামা। মানুষরা বড় হলেই কেন যে এমন বদলে যান!
মেজোমামা, ছোটমামা নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার পর, ফের আমাদের খোঁজখবর নেওয়া-দেওয়া শুরু হল। দু’জনের একজন মাঝে-মাঝে চলেও আসতেন আমাদের কাছে। মা’কে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেদ করতেন। মা যেতে চাইতেন না, “দেখছিস তো ছেলেমেয়েদের কলেজ আছে, ইশকুল আছে। ভাল ঠাকুরও নেই। আমি চলে গেলে ওদের কে রেঁধেবেড়ে খাওয়ায় বল দিকিনি! তোদের বিয়ের সময় ঠিক যাব। সবাই মিলে যাব।”
কোন মামার হাত দিয়ে মনে নেই, মা একবার ঊর্মিলাদির জন্য কত যেন টাকা পাঠিয়েছিলেন। ঊর্মিলাদি সারা গাঁয়ে কথাটা আনন্দে ঢাক পিটিয়ে বলে বেড়িয়েছিল। ফলে বড়মামা মায়ের উপর খুব চটে গিয়ে মা’কে লিখেছিলেন, “তুই বড়লোক হতে পারিস, কিন্তু বাড়ির পুরনো কাজের লোককে টাকা পাঠিয়ে গ্রামের সকলের সামনে আমাকে ছোট না করলেই তোর চলছিল না?’
মা বলেছিলেন, “কী শয়তান রে বড়দা, ভগবান এত বড় শাস্তি দিলেন, তবু চোখ খুলল না!”
তারপরেই একদিন ছোটমামার চিঠি আসে, “পারলে, দিদি, সবাইকে নিয়ে একবার ঘুরে যাও। ঊর্মিলাদি আর বাঁচবে না। বেশ কিছুদিন ধরে তোমাদের সকলকে খুব দেখতে চাইছে। বড়দার কাছে উঠতে হবে না, আমি আর মেজদা বড়দার সঙ্গে ভিন্ন হয়ে গেছি। সবচেয়ে ভাল খবর, পচা ফিরে এসেছে।”
বাবা মা’কে আসার জন্য জোর করেছিলেন, “যাও না, মানুষটা তোমাদের সংসারে সারা জীবনটা দিয়ে গেল। দ্যাখো না, শেষের সময়টা যদি কিছু করতে পার।”
মা বলেছিলেন, “ তা হলে সবাই যাই চলো। তুমি ডাক্তার। কাছে থাকলে সুবিধেই হবে।”
বাবার চাকরির বড় চাপ। যেতে পারেননি। আমরাই গিয়েছিলাম। মামাবাড়িতে পা দিয়েই আমারা সকলেই দৌড়েছিলাম চাঁদপুকুরের পাড়ে। ঊর্মিলাদির ছিটেবেড়ার আগড় দেওয়া ঘরে। ঊর্মিলাদি আমাদের চিনতে পারেনি।
বিছানায় বসে যে ঢ্যাঙাপানা ছেলেটি চামচে করে ঊর্মিলাদিকে কী যেন খাওয়াচ্ছিল, সে-ই নাকি পচা। আমাদের দেখে হাসল পচা। আমাকে আর বোনকে বলেছিল, “কদ্দিন পরে দ্যাকা লয়? টুনি, বিনু আমাকে চিনতে পারচু?” বড়মামি নকি পচাকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিলেন। জ্যোতিদা বেঁচে থাকলে এত বড়টিই তো হত এতদিনে!
মা বলেছিলেন, “কী পাষাণ প্রাণ রে তোর, পচা? মায়ের জন্য প্রাণ কাঁদেনি তোর?”
পচা জবাব দেয়নি, তার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল। “সেই যদি এলি, দু’বছর আগে এলেই পারতিস! অন্তত একটা পোস্টকার্ড লিখেও যদি জানাতিস বেঁচে আছিস, ঊর্মিলাদি এত কষ্ট পেত না। তুই এসেছিস বুঝতে পেরেছে ঊর্মিলাদি?”
পচা এমনভাবে ঘাড় নাড়ে যার মানে হ্যাঁ-না দুটোই হয়।
দিন পনেরো আগে এই জষ্টিমাাসের দুপুরে গাঁয়ে-গাঁয়ে ভিক্ষে করতে গিয়ে নাকে-মুখে রোদের ঝাপটা লেগে অজ্ঞান হয়ে মাঠপুকুরে পড়ে ছিল ঊর্মিলাদি। আর ভগবানের কী খেলা! সেদিনই পচা বাড়ি ফিরেছে। এখন মামাদের গাঁ পর্যন্ত বাস যায়। বাসস্ট্যান্ডে নেমে শর্টকাট হবে বলে মাঠের আল ধরে বাড়ি আসছিল পচা। পথে মাঠপুকুরে বটগাছটার তলায় দ্যাখে, তার মা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। পাঁজাকোলা করে বাড়ি এনে ডাক্তার-বদ্যি, এই পনেরোটা দিন কী সেবাটাই না করেছে মায়ের! মাঝে-মাঝে একটুআধটু জ্ঞান ফেরে ঊর্মিলাদির। ফ্যালফ্যাল করে সকলের মুখের দিকে তাকায়, তারপর আবার অজ্ঞান! বাবা যদি সঙ্গে আসতেন! বুড়ো ফেলুডাক্তারের উপর ভরসা হয় না আমাদের।
মামাদের মুখেই শুনলাম, পচা নকি বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্ধ্র চলে গিয়েছিল। সেখানেই এতদিন চিনির কলে কাজ করেছে। অনেকবার ঠিক করেছে পুজোয় আসবে, কিন্তু প্রত্যেকবারই এক-একটা উটকো ঝামেলা। এবার এসেছে জোর করে, মা’কে নিয়ে যাবে বলে। ছোটমামা বলেন, “এতদিনের মা’কে অবহেলা ছেলেটা পনেরো দিনেই পুষিয়ে দিয়েছে, বুঝলি! এক মিনিটের জন্য মায়ের কাছছাড়া হয়নি। আমরা বলেছিলাম আমাদের বাড়িতে খেতে। রাজি হয়নি। নিজেই নাকি দু’মুঠো ফুটিয়ে নেয়! কী যে খায় কে জানে! বাজারটাজারও তো যায় না দেখি। মায়ের কাছেই সেঁটে আছে। আর মা’কে কী ভালবাসা!”
আমাদের সঙ্গেও খুব একটা কথা বলত না পচা। আমরা ঘরে গেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসত শুধু। আমরা কথা বলেলে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আমাদের চুপ করতে বলত। ঊর্মিলাদি জেগে যাবে! বিনুর একটু বেশি-জানা স্বভাব, বলেছিল, “তুমি কী খাও পচাদা?”
পচা হেসে গলা নামিয়ে বলেছিল, “হাওয়া!”
আমরা হেসেছিলাম।
আমাদের পৌঁছবার দু’দিন পরেই ঊর্মিলাদি মারা গিয়েছিল। রাতেই মরেছিল, কী ভোরে, আমরা জানি না। রাতে পচা একলাই থাকত মা’কে নিয়ে। খুব ভোরে সদর দরজায় হাঁকডাক শুনে দরজা খুলে মেজোমামা জিজ্ঞেস করেন, “কে?”
একগাল হাসে আগন্তুক, “ই কী গো মামা, আমাকে চিনতে পারলেনি, আমি পচা গো। অন্ধ থেকে আসছি।”
মেজোমামার বুকটা কেঁপে উঠেছিল,
“তুমি.......তুই......পচা.........।”
“পরশুদিন স্বপ্ন দেকনু কে যেন আমাকে ঠেলা মেরে বলছে, ‘পচা ওট। বাড়ি যা।’ ”
ঊর্মিলাদি মারা যাচ্ছে।
“যাই, মা’কে ঘুম থেকে জাগাই। কী রকম ভেড়কে যাবে মা বলো দিকিনি।”
মেজোমামা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বাড়িতে এসে খবর দিয়েছিলেন। আমরা সকলেই হুড়মুড় করে পুকুরপাড়ে ছুটে যাই।
ঊর্মিলাদির ঘরের আগল হাট করে খোলা। ভিতরে ঢুকতেই মা’কে পচা বলে, “ও বড়দি, মা ক্যানে কতা বলচে নে বলো না?” পচার গলায় রামনাম লেখা তাবিজটা জামার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। “ও ছোটমামু, মা’কে ঠেলছি, জাগচে না ক্যানে? ও মা, ওটো না, মা!”
ছোটমামা পচার মাথায় হাত রাখেন।
পচা কেঁদে উঠে ঊর্মিলাদির মরা বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিনু ফিসফিস করে বলে, “দ্যাখ দিদি, সেই কাটা দাগটা! যে পচা ক’দিন ধরে সেবা করছিল তার কপালে তো দাগটা ছিল না!”
মেজোমামা বলেন, “তাবিজটা? তাবিজটাও ছিল না তো!”
এর পরই বড়মামা পাগল হয়ে যান। ভূত শুনলে আজও আমরা কেমন আনমনা হয়ে যাই!

0 মন্তব্যসমূহ