কুসুমডাঙার আমগাছ
মিশিরজি ‘জয় বজরংবলি’ বলে একটা হুংকার ছাড়ল বটে, কিন্তু কেমন যেন ড্যাম্প-খাওয়া গলা। বর্ষাকালের বাইরে রাখা দেশলাই বাক্সের মতো নেতিয়ে পড়া। অথচ কুসুমডাঙায় মিশিরজির হুংকার হল গে শেষ কথা। কারও বাপের সাধ্যি নেই তার উপর রা কাড়ে। তা সে গোরু চুরির কেস বলো, আর ভূতপ্রেতের উপদ্রব বলো। এই মিশিরজি না থাকলে কুসুমডাঙার লোক কবেই ফৌত হয়ে যেত। একা হাতে, মানে ওই আওয়াজ দিয়ে সব সামলেসুমলে রেখেছে। তা এত বড় একটা গাঁ-গেরাম, সব কি আর পারা যায়! ছোটখাটো উপদ্রব লেগেই আছে। সেসব কুসুমডাঙার লোকজনের গাসওয়া হয়ে গেছে। ভগীরথের বাড়ির লাউ সতু বিশ্বাস খাবে, কিংবা উঠোনে এক কোণে বেঁধে রাখা পুরুষ্ট পাঁঠা এই আছে এই নেই - এ কোনও বড় কথা নয়। ওটুকু হাতের কাজ দেখাতে না পারলে আর কুসুমডাঙায় থাকা কেন! গাঁয়ের ইজ্জত বলেও তো একটা কথা আছে! এই তো গতবার শীতে পঞ্চায়েত অফিসের পাশের মাঠে কলকাতার ম্যাজিশিয়ান এল। জাদুকর পি বি সরখেল। হ্যান্ডবিলে, ফেস্টুনে ছয়লাপ। ম্যাজিশিয়ানের পুরো নাম কী হতে পারে, সে নিয়ে অনন্ত দাসের সঙ্গে কুমুদ প্রামাণিকের ঝগড়া শেষ পর্যন্ত হাতাতাতিতে গড়াল। মিশিরজির কন্ঠক্ষেপে ঝগড়া থামে।
তা সে সরখেলি ম্যাজিক দেখতে কুসুমডাঙা ভেঙে পড়ল। টুকটাক তাসের ম্যাজিক, টুপির ভিতর থেকে পায়রা, এসব হাবিজাবি খেলা দেখানোর পর দর্শকদের ভিতর থেকে একজনকে ম্যাজিশিয়ান স্টেজে ডাকল। কেউ আর এগোয় না। শেষ সামনের সারিতে বসে থাকা গোলাকে মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ছানার কারিগর তরক ঘোষকে ম্যাজিশিয়ান আঙুল দিয়ে ইশারা করল। তারেক আবার মুন্ডু ঘুরিয়ে পিছনে দেখল। লাভ হল না। সবাই ঠেলেঠুলে তাকেই পাঠিয়ে দিল। তারক কিছুক্ষণ পাবলিকের দিকে তাকিয়ে বোকার হাসি হেসে স্টেজে উঠে পড়ল। তার হাতের ঘড়ি খুলে নিয়ে সকলের চোখের সামনে টপ করে গিলে ফেলল ম্যাজিশিয়ান। তারপর পুরো একগ্লাস জল খেল। তারক ঘোষ আবার সকলের দিকে তাকিয়ে দাঁত ছড়িয়ে হাসল। একবার ম্যাজিশিয়ারেন দিকে তাকিয়ে বলল, “শ্বশুরমশাই দিয়েছিল!”
ম্যাজিশিয়ান তারকের মুন্ডুটা টেনে এনে তার ভুড়ির উপর চেপে ধরে বলল, “শুনতে পাচ্ছেন? একটু পরে আর শোনা যাবে না। বিলকুল হজম হয়ে যাবে। একবার আসানসোলে বাহান্নটা বল্টু খেয়েছিলাম। পুরো হজম হতে বাহান্ন মিনিট সময় লেগেছিল। বিশ্বাস হয় না? এই যে ম্যাগনেট, আমার বডিতে লাগিয়ে ছেড়ে দিন, ঝুলে থাকবে। ওখানকার কিছু মাফিয়া দলে নিতে চেয়েছিল। যাইনি। আমি তো আসলে শিল্পী। কলাকার।”
তারক ঘোষ পরে বলল যে, মা মনসার দিব্যি, সে পষ্ট লোকটার পেটে ঘড়ির ডাক শুনছে। ঠিক টিক টিক নয়, কেমন যেন ঘমঘম আওয়াজ হচ্ছিল। কিন্তু ঝামেলা শুরু হল একটু পরেই। বিশাল একটা ঢেকুর তুলে সেই জাদুকর ভানুমতীর নামে একটা ছড়া কেটে ঘড়ি বের করে আনল স্টেজের একেবারে কোণে রাখা একটা ইস্টিলের বাক্সের তালা খুলে। খুব একটা হাততালি পড়ল না। কুচোকাঁচারা একটু তালি মারল শুধু।
তারক ঘোষ তার জায়গায় এসে বসল। একটু পরেই দেখা গেল ম্যাজিশিয়ান কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। ভেলভেটের লম্বা জামা, মাথায় শলমা চুমকি বসানো তাজ, সব খুলে ফেলে আতিপাতি করে কী যেন খোঁজে। পুরনো লোকজন আগেই সন্দেহ করেছিল, এবার কনফার্ম হয়। শাবাশ তারক। কুসুমডাঙার ইজ্জত রেখেছে বটে! তারা ম্যাজিশিয়ানের ল্যাজে-গোবরে অবস্থা দেখে আপন মনেই বলে, ‘বলিহারি তারক, মোক্ষম তুরুম ঠুকে দিয়েছিস তুই!’
জাদুরারজ চক্রবর্তী (ভোপাল), পি বি সরখেল (সিনিয়র) ‘অনির্বার্য কারণবশত অদ্য শো বন্ধ থাকিবে’ ঘোষণা করলে মহাগন্ডগোল শুরু হয়ে গেল। মিশিরজি কেস ধরে ফেলেছিল। স্টেজে উঠে একখানা বাজখাঁই আওয়াজ ছেড়ে প্রথমে হট্টগোল থামায় এবং অ-মাইক গলায় জানিয়ে দেয়, শো চালু থাকবে। তারপর নেমে এসে তারক ঘোষকে বাইরে অন্ধকারে ছাতিমতলায় নিয়ে আর-একটা সিংহনাদ ছাড়ে। তখন তারকও গলা ছাড়ল।
“আমার শ্বশুরমশাই-এর দেওয়া ঘড়ি! কাচের উপর দাগ ফেলে দিল কেন?”
“ঠিক আছে। কিন্তু তুমি শো বন্ধ করতে পার না। মিথ্যা কোথা বলছিস কাহে। এ রিস্টবাচ শ্বশুর দিল, কি তু চড়কমেলায় জোগাড় করলি, সোবই জানে।”
“আর এটাকে ও শিল্প বলে কোন সাহসে। কলাকার? কলার শিল্পী। এই নেন। শিল্প অন্য জিনিস।”
পকেট থেকে ম্যাজিশিয়ানের যাবতীয় কলকব্জা, সিন্দুক, বাক্সের মাস্টার-কি বের করে মিশিরজির হাতে ফেরত দিল তারক ঘোষ। তারপর ম্যাজিক চালু হল বটে, কিন্তু তেমন জমল না। কেমন যেন ভয়ে-ভয়ে তাড়াহুড়ো করে সরখেলমশাই খেলা শেষ করল।
তো এই হল কুসুমডাঙা। এ গাঁয়েই লোক অন্য গাঁয়ের হাটে গেলে লোকজন চোখে-চোখ রাখে। ধুতি চাইলে গামছা দেখায়। একবার কুসুমডাঙায় বেদের দল তাঁবু ফেলেছিল। দিন তিনেক বাদেই ওরা বাধ্য হয় তাঁবু গুটিয়ে ফেলতে। গাঁয়ের কাচ্চাবাচ্চা বুড়োধাড়িদের দিনরাত ভিড় লেগে থাকত ওদের তাঁবুর আনাচেকানাচে। ঘটি-বাটি, তাবিজ-কবচ, মায় ওদের একটা লোমওয়ালা বাঘা কুত্তা বেমালুম গায়েব হয়ে গেল। এ আশ্চর্য ভোজবাজি দেখে ওরা লজ্জায়, ঘেন্নায় তিনদিনের মাথায় তাঁবু গুটিয়ে নীল দিগন্তে উধাও হয়ে গেল। হেডমাস্টারের ছোট ছেলে কলকাতা থেকে ফিরে এসে ঘটনা শুনে বলল যে, “শিওর, এ ঘটনা নিয়েই একটা ইংরেজি সিনেমা হয়েছে।”
ইদানীং মিশিরজির বাজার একটু মন্দা চলছিল। কুসুমডাঙা সেই আগের কুসুমডাঙা নেই। বেশ একটা গঞ্জ-গঞ্জ ভাব এসেছে। সোনামণির খালের উপর পাকা কালভার্ট হয়ে গেল। দীনবন্ধু সাহা সারের দোকান দিয়েছে। অম্বুজা সেন সিমেন্ট দিয়ে মনসাতলা বাঁধিয়ে দিল। জাগ্রত সংঘের কালী পুজোয় লাইটিং-এ পদ্মের পাপড়ি খোলে, বন্ধ হয়। কুমুদ প্রামাণিক পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারিতে পাঁচ হাাজার টাকা পেয়েছে। মিশিরজির রবরবা কেমন যেন ন্যাতপেতে হয়ে পড়েছিল। উঠতি বয়সের ছেলেরা তো গ্রাহ্যিই করে না।
শুধু উঠতিরাই বা হবে কেন! পুরনো দু’-চারজনও মনে-মনে এতকাল তার মুন্ডুপাত করে এসেছে। হতে পারে মিশিরজি ধার্মিক লোক। কথায়-কথায় তুলসীদাসী বচন ঝাড়ে, এমনকী, রবি ঠাকুরের ছড়াও দু’-একসময় বলতে শোনা গেছে। তা হলে কী হয়, আদতে সে কুসুমডাঙার লোকই না। মহানন্দা ঘাটের ইজারা নিয়ে এখানে ঠাঁই গাড়ল। ব্যস, যেন শিকড় চরিয়ে দিল কুসুমডাঙায়। নতুন ব্র্রিজ হল, ঘাট উঠে গেল, মিশিরজি উঠল না। শুরু হল তার হোমিওপ্যাথি আর সমাজসেবা। “চোরি করা পাপা আছে, ভগমান উপর থিক্যে সব কুছ দেখতে আছে। মানুষকে সেবা কোরলে পুন হোয়। চন্ডীদাস শুনো, সোবার উপরে মানুষ সচ্ হায়, তাহার উপ্রে নাই।” দিনরাত এসব হাবিজাবি বলে কুসুমডাঙার মানুষের পিত্তিনাড়ি একেবারে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
সত্য বিশ্বাস পাক্কা ছ’মাস জেলে ঘানি টেনেছে এই মিসিরজির জন্য। একবার যদি মিশিরজি মুখ ফুটে পুলিশের কাছে বলত যে, সে রাতে সতুকে লেপতোশক মাথায় নিয়ে যেতে দ্যাখেনি, তবে আর কেস দাঁড়ায় না। ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠিরের মতো পুলিশকে বলে দিল, “হ্যাঁ, সোতুই হোবে। আপাহিজ আদমি, আন্ধারমেও পষ্ট বুঝা যায়। মাথায় সামান ছিল।”
সতু অনেক চোখের ইশারাটিসারা করে মিশিরজিকে সামলানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার তখন অন্য রকম আনন্দ। এবার সতুকে সংশোধন করা যাবে, এই খুশিতে তখন সতু, সতু না হলেও সতু।
তবে কাজটা সতু বিশ্বাস ভাল করেনি। হতে পারে দূর সম্পর্কের শ্যালক। তারই জিনিসপত্র তুই ঝেড়ে দিবি! শ্যালকবাবু তার বোনের বিয়ের জন্য নতুন লেপতোশক আর মশারি কিনে পরদিন ভোরে জিনিসপত্র গরুর গাড়িতে চাপিয়ে আরও ভিতরে, তা প্রায় সাত-আট মাইল দূরে বড় শিমুলতলিতে ফিরে যাবে। রাতটা জামাইবাবুর বাড়িতে থাকবে বলে সেই নতুন বিছানা পেতে, মশারি টাঙিয়ে শুয়ে ছিল। এ গাঁয়ের বদনাম সে বিলক্ষণ জানত। মনে হয়, সেজন্যই নতুন জিনিসের উপর গ্যাঁট হয়ে শুয়ে পড়েছিল। ভোরের দিকে অন্ধকার-অন্ধকার থাকতেই একবার প্রাঃতকৃত্য সারতে বদনা নিয়ে মাঠে গিয়েছিল। ফিরে এসে ঘুমচোখে ফল্স মশারি তুলে ধপাস করে শুইয়ে দ্যাখে, ভূমিশয্যা। সতু যে প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে এ কাজ করেছে, তা নয়। শ্যালকবাবু উঠে বাইরে গেলে সেই অন্ধকারে তার শরীর কেমন যেন আনচান করে উঠল। জ্বর-জ্বর ভাব। দুটো চোঁয়া ঢেকুর উঠল। বার-তিথি-টাইম হিসেব কষে দেখল, একদম খাপে-খাপে মিলে যাচ্ছে। তবে আর দেরি কিসের! গুরুদেব ভুজঙ্গ ঢালির নাম স্বরণ করে সতু অ্যাকশন করে ফেলেছিল। শ্যালকবাবু ছাড় দেয়নি। সতুর নামেই নালিশ ঠুকেছে। আর মিশিরজি যে তাকে ওই শেষ রাতে দেখতে পেয়েছিল, তা কে জানে! বাঁ পা টা একটু টেনে হাঁটে সতু। তাতেই আরও চিত্তির। ভগবান যাকে মারে, সবদিক দিয়েই মারে।
গাঁয়ে সতুর মতো আরও দু’-চারজন ছিল, যারা মিশিরজির এখনকার হেনস্থায় যারপরনাই সুখ পায়। তার গলার ব্যাটারি ডাউন এবং বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা পি সি ও বুথ, আর একটা এগ রোলের দোকান হওয়ার পর পাবলিক এখন আর তাকে বিশেষ পাত্তা দেয় না। এর মাঝে একদিন সন্ধেরত্তিরে মনসাতলায় আমগাছের মগডাল ভেঙে সতু সোজা মাটিতে পড়ল। ভুঁই-এর টানে পাকা আপেল পর্যন্ত মাটিতে নেমে আসে, আর শরীরের মধ্যে মাথা হল গে ভারী বস্তু, সেটাই আগে মাটিতে পড়ল। ঘাড় মটকে সতু সঙ্গে-সঙ্গে মরে গেল। তারপর শুরু হল আসল খেল!
সতু সেদিন দুপুরে ভরা হাটের ভিতরে এদিক-সেদিক ঘুরতে-ঘুরতে সময়মতো একমুঠো কদমা, একটা পাকা পেঁপে, একটা গামছা সরিয়েছে। চটপট মনসাতলায় গিয়ে সেসব সামগ্রী বড় আমগাছের হাতদশেক উপরে মোটা ডালের ফাটা গর্তে লুকিয়ে রেখেছে । বিকেলের দিকে আর-এক খেপ মারার জন্য ফিরে এসে দেখল, হাট কেমন মরা-মরা। উপরন্তু কিছু উটকো লোকজনকে হাটের মাঝে ঘোরাঘুরি করতে দেখে তার কেমন ধন্দ লাগল। এরা মোটেই হাটুরে লোকজন নয়। সতু ভালমানুষের মতো সরে পড়ল।
ঠিক সাঁঝের ঝোঁকে ঘুরপথে মনসাতলায় পৌঁছল সতু। বিকেল একটু গড়ালে মনসাতলার ত্রিসীমানায় কেউ আসে না। এই আমগাছ যেন কুসুমডাঙার দুঃখী মানুষজনের মৃত্যুর মৌরসি পাট্টা হয়ে গেছে। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হলেই দু’জন দু’জনকে চোখে-চোখে রাখে। ‘যাচ্ছি আমি মনসাতলায়।’ বললেই ঝগড়া আপসে মিটে যায়।
সতুর এতে বেশ সুবিধে হয়েছে। সটকানো জিনিস প্রায় সময়ই এ-গাছের উপর সে লুকিয়ে রেখেছে। আজ কিন্তু বিকেলের পর থেকেই তার মন বড় কু গাইছিল। হাটে এত ভিনদেশি মানুষজনের আনাগোনা, তার উপর হরিরামের দোকান থেকে যখন একটুর জন্য এক শিশি তরল আলতা তার হাত ফস্কে গেল, তখনই সে বুঝেছিল স্কন্ধে তার বারঠাকুরের নজর পড়েছে। কিছু একটা না ঘটে যায় না।
সুয্যি তখন অস্ত গেছে। গাঁয়ের কোনও ডাকাবুকোর এমন সাহস নেই যে, এখন মনসাতলায় আসে! সন্ধের পর মনসাতলায় আমগাছের তলা দিয়ে যাবে, এমন কথা কেউ ভুলেও ভাবে না। টিপিস-টিপিস করে জোনাকিগুলো জ্বলছে-নিভছে। একটা ছুঁচো দৌড়ে গেল। গোবদা লেজ ঝুলিয়ে একটা শিয়াল ছুঁচোটাকে দেখল। আমগাছের তে-ডালায় বসে এসব দৃশ্য দেখতে সতুর যে কী আনন্দ হয়! বিধাতা কত জীব পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে। যে যার মতো করে-কম্মে খাচ্ছে। আহা, বেঁচে থাক তোরা।
পেঁপে না কদমা, কোনটা আগে খাওয়া উচিত, এ-নিয়ে সতু মনস্থির করতে পারছিল না। তখন হঠাৎ সতু দেখল, জনাসাতেকের একটা দল চাপা আওয়াজে কথা বলতে-বলতে এদিকেই আসছে। সতু মুহূর্তের মধ্যে গিরগিটির মতো গাছের ডালের সঙ্গে মিশে রইল। সতু বিশ্বাস অন্ধকারে খারাপ দ্যাখে না। গুনে দেখল, সাতজন। উপর থেকে কান খাড়া করে ওদের কথাবার্তা শুনতে লাগল সে।
সর্বনাশ। এরা তো সেই কালুর দল। এক-এক করে রামদা, সড়কি, মশাল সব বেরোচ্ছে। সর্দার সিগারেট ধরাল। বাকি চারজন বিড়ি, একজন খইনি। বৃন্দাবন সাহার কাল মেয়ের বিয়ে। আজ তার সর্বস্ব লুট করবে কালুর দল। সব শুনতে পাচ্ছিল সতু।
“সর্দার, খবর ঠিক তো? তোমার বিরিঞ্চি ভুল খবর দিলে কিন্তু সব গন্ডগোল হয়ে যাবে!”
“তুই থাম তো। বিরিঞ্চি আমাগের নিজির লোক। এক বছর ধরে ও বাড়িতে রইছে। সব খুঁটিনাটি ডেলি রিপোর্ট করিছে। কর্তার আমাশা আছে। গিন্নি দোক্তা খায়। যে মেয়ের বিয়ে সে রাত্তিরবেলা রুটি খায়। চত্তির মাসে কুয়োর জল থাকে না।”
“সর্দার, বেরোতে তো এখনও অনেক দেরি। কেমন যেন খিদে-খিদে পাচ্ছে। প্রসাদী সন্দেশগুলো এখন খেয়ে নিলেই হত!”
“চোপ। হাটে বসে একগাদা জিলেপি আর শিঙাড়া খাইছিস। আবার খিদে!”
“উঁ, সাতবাসি শিঙাড়া।”
“যা, আমগাছটায় উঠে দ্যাখ। জষ্টি মাস, তোর জন্য টুসটুসে পাকা আম ঝুলে রয়েছে!”
এখন সতু দেখল ভারী বিপদ। সত্যি যদি পাকা আমের খোঁজে গাছে ওঠে, তবে তার হয়ে গেল! তখন তার মাথায় যুগান্তকারী বু্দ্ধি বিদ্যুতের মতো ঝিলিক মেরে উঠল। হাত বাড়িয়ে নিঃশ্বব্দে গোটাসাতেক পাকা আম ছিঁড়ে নিল। তারপর এক-এক করে সাতটা আম টুপ-টুপ করে নীচে ফেলে দিল।
এ গাছের আম পেকে মাটিতে পড়ে পচে যায়। কেউ কুড়োতেও আসে না। এ গাছের আম খাওয়াার কথা কুসুমডাঙার কোনও মানুষ ভুলেও ভাবে না। তা যে শুধু ভয়ে, তা নয়। আতঙ্কও আছে। উন্মাদ হয়ে যাওয়ার চান্সও আছে। একবার নাকি একটা কাক ভুল করে টসটসে পাকা হলুদ আমে ঠোকর দিয়েছিল। সেটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম পাগল কাক। কয়েকদিন নাকি কা-কা না বলে যা-যা বলে লোকজনকে গলার ভিতরটা দেখাতো। মিশিরজি বলেছিল, “কৌয়াদেরও টনসিল থাকে। সায়দ টনসিলে ঘা আছে।”
এদিকে সামান্য হওয়া উঠেছিল। আমগুলো মাটিতে পড়তেই ওরা প্রথমে একটু থমকে গেলেও পরে আর অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করেনি। মায়ের আশীর্বাদ মনে করে কুড়িয়ে এনে সকলেই প্রায় এক সঙ্গে মুখে দিয়েছে। বিশেষত হাওয়া দিচ্ছিল, পাকা আম খসে পড়তে পারে। প্রথমে আর্তনাদ করে উঠল স্বয়ং কালু।
“বাবা রে, গিছি রে!”
তখন সেই আমতলায় একটা ভয়ংকর হইচই শুরু হয়ে গেল। সাত ডাকাতের মরণ-আর্তনাদ, সঙ্গে উন্মাদ-নৃত্য। গাছের উপর থেকে এসব দেখে আনন্দে সতুর স্থান-কাল বিস্মরণ হয়ে গেল। একটা নরম ডালে পা পড়তেই মটাস এবং ধপাস। ঘাড় মটকে সতু বিশ্বাস সঙ্গে-সঙ্গে মরে গেল।
এদিকে মনসাতলায় গন্ডগোল শুনে লোকজন প্রথমে এককাট্টা হয়। শেষে একটু-একটু করে এগোতে-এগোতে শেষমেশ দ্যাখে রামদা, সড়কি, ভোজালি, মশাল। চার ডাকাত অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তিনজনের মুখে গ্যাজলা, চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যায়, আতঙ্কে দিশেহারা। এক পাশে সতু মরে পড়ে আছে। সবাই বুঝতে পারল, সতু একা হাতে এই সাত ডাকাতের সঙ্গে লড়াই করে কুসুমডাঙাকে বাঁচানোর জন্য জীবন বিসর্জন দিয়েছে।
মট করে ডাল ভাঙতেই সতু প্রথমে কিছুক্ষণ বায়ুবন্ধনের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সবই ফস্কে যাচ্ছিল তার হাত থেকে। শেষ পর্যন্ত ধপাস করে নীচে পড়ল। আত্মাটা বেরিয়ে একবার এ ডালে, একবার ও ডালে ঘোরাঘুরি করে শেষতক সড়াৎ করে তে-ডালের ফোকরে ঢুকে পড়ল। এসব সেই পুরনো দিনের কথা। গাঁয়ের সমস্ত লোকজন পরে জানতে পেরেছিল, সতু বিশ্বাস একা হাতে একদল ডাকাতকে কী এক অজানা অস্ত্রে ঘায়েল করে নিজে প্রাণ দিয়েছে। যতদিন গেছে, সতুর নামে একটা গল্প বাজারে চালু হয়েছে। রাতারাতি সতু চোর, বিপ্লবী সত্যেন বিশ্বাস হয়ে পড়ল। যত দিন যায়, ততই তার নাম চারদিকে ছড়াতে থাকে। সতু স্মৃতি পাঠাগার, সত্যেন লটারি সেন্টার, শহিদ সত্যেন নিবিড় মৎস্যচাষ প্রকল্প, সতু বিশ্বাস স্মৃতি হোমিও ক্লিনিক। শেষে কুসুমডাঙায় ছোট-বড় মিলিয়ে সাতচল্লিশটি শিশু-কিশোরের নাম ‘সতু’ হয়ে পড়লে পঞ্চায়েত থেকে উপরে প্রস্তাব পাঠানো হয় যে, ‘অতঃপর কুসুমডাঙার নাম সতু বিশ্বাস নগর রাখা হউক।’ নতুন বাসরুট চালু হল। পিচঢালা সড়ক। সতু বিশ্বাস সরণি।
এক-একটা অনুষ্ঠান হয়, তার আহ্লাদে ডগমগ হয়ে সতু এক বস্তা গুড়, এক বয়াম বাতাসা, এক ঠোঙা তিলের নাড়ু উড়িয়ে আনে। কুসুমডাঙা এখন আর শিয়াল-ডাকা গ্রাম নেই। কাপড়ের দোকান, বাসনের দোকান দশকর্ম ভাণ্ডার, রাইস মিল, পাটগোলাা, ইস্তক একজন ডাক্তারবাবু চেম্বার খুলেছেন। চারপাশ দেখেশুনে সতুর মনে বড় ফুর্তি আসে। গুড়ের বস্তায় পিঁপড়ে ধরেছে। আহা, খাচ্ছে খাক। তার তো প্রকৃৃতপক্ষে খাওয়া বলে কিছু নেই। ওই মিষ্টদ্রব্যের গন্ধ যা আসে, তাতেই আত্মা ভরে যায়। মরণের পর এই তো আসল জীবন।
হাটবাজার থেকে মাঝে-মাঝে জিনিসপত্তর উধাও হয়ে যাওয়া সবাই মোটামুটি মেনে নিয়েছে। যে লোকটা মরণের পরেও ভানুমতীর খেল দেখিয়ে যাচ্ছে, যে লোকটা নিজের জীবন দিয়ে ডাকাতের হাত থেকে কুসুমডাঙাকে রক্ষা করেছে, যে লোকটা গ্রামের সনাতন ঐতিহ্য তথা পরম্পরাকে যারা ভাঙতে চেয়েছিল, তাদের যথাযোগ্য শাস্তি দিয়ে চলেছে, তার আত্মার শান্তির জন্য দু’টো কদমা, কী এক তিজেল ঝোলাগুড় তো সামান্য ব্যাপার। গঞ্জের সমস্ত ব্যাপারিরা এক হয়ে সত্যেনত্মা সন্তুষ্টি কমিটি গঠন করেছে। নিয়মিত চাঁদা জমা পড়ে। ওড়ানো জিনিস বাবদ এই ফান্ড থেকেই সাবসিডি দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গ ভূতোৎপাটন মঞ্চ থেকে সম্পাদক আবির ঘোষ এসেছিল কুসুমডাঙার লোকজনকে বোঝাতে। পাবলিক তাকে গ্রামেই ঢুকতে দেয়নি। ‘ও আমাদের ভূত, আমরা বুঝে নেব,’ বলে তাকে চা খাইয়ে ফেরত ট্রেনে তুলে দিয়েছে।
শিরশিরে একটা হাওয়া উঠল। কয়েকটা শুকনো আমলকী পাতা সতুর সূক্ষ্ম শরীর ভেদ করে উড়তে-উড়তে মনসাতলা পার হয়ে গেল। একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল সতুর। এত সুখের মাঝেও একটা দুঃখ পিঁপড়ের মতো তার আত্মা কামড়ে ঝুলে আছে। হারামজাদা মিশিরজি নাকি কুসুমডাঙায় ইসকুল খুলেছে। গরিব ছেলেমেয়েদের আদর্শ শিক্ষা দিয়ে কুসুমডাঙাকে নাকি আদর্শ গ্রাম বানাবে। ইল্লি। লোকটার শয়তানি আর গেল না। কোন রাইস মিলের মারোয়াড়ি মালিক নাকি অনেক টাকা দিয়েছে। ঘরবাড়ি, লোহার আলমারি, চক-ডাস্টার। দিব্যি রমরমিয়ে নাকি ইশকুল চালু হয়ে গেছে। হেডমাস্টার রামনারায়ণ মিশ্র। হুঁ, হাতিঘোড়া গেল তল, মশা বোলতা কিত্না পানি। দেখাচ্ছি দাঁড়া।
ঠিক রাত ন’টা সাতচল্লিশ মিনিট। সতুর বাঁ দিক দিয়ে হুতোম প্যাঁচাটা উড়াল দিলে সতু বুঝল সময় হয়েছে। বাতাসে আত্মাটা ভাসিয়ে দিয়ে নেচে-নেচে মিশিরজির স্কুলের সামনে পৌঁছল। অফিস ঘরের দরজায় বড়-বড় দু’টো তালা। তাতে সতুর এখন আর কিছু আসে-যায় না। দরজার পাল্লা আর মেঝের মাঝখানে যে একচুল ফাঁক রয়েছে, সেখান দিয়ে দিব্যি সে গলে গেল। চেয়ারের পিছনে একটা নতুন আলমারি। চাবি গলানোর ফুটো দিয়ে সতু অক্লেশ ঢুকে পড়ল। তখনই অন্ধকারে প্রায় সব দেখতে পেত, এখন তো ঘুরঘুট্টি অন্ধকারেই ভাল দ্যাখে।
আলমারির সমস্ত কাগজপত্র ছিঁড়ে কুটিকুটি করে মিশিরজির চেয়ারের উপর একপোঁচ অদৃশ্য আলকাতরা লেপে দিল সতু। দেওয়ারলঘড়ির কাঁটা দু’টো উলটো দিকে ঘুরিয়ে দিল। এখন থেকে একটার পরে বারোটা বাজবে। শেষে রামানারায়ণ মিশ্র নামটা কেটে ‘চাম ছাড়ায়ন বিশ্রী’ লিখেটিখে ফিরে এল।
⥮২⥯
সে রাতে সত্যিই সতু বিশ্বাসের মেজাজ ভাল ছিল না। আদর্শ শিক্ষানিকেতন ভাঙচুর করেও তাঁর আত্মা ঠান্ডা হচ্ছিল না। আমগাছের মধ্যিখানে তে-ডালের উপর বসে সতুর আত্মাটা রাগে দুঃখে নীল-নীল আভা দিচ্ছিল। লাড্ডুর গন্ধে চারদিক ম-ম। এমন সময় সতু দেখতে পেল, মিশিরজি হনহন করে এদিকেই আসছে। দেখেই তার অনেক দিনের পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। এ লোকটাই সাধুগিরি দেখিয়ে তাকে জেলের ঘানি টানিয়েছিল। এ লোকটাই কুসুমডাঙার লোকজনের অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছিল। শেষ বয়সে এসে আবার আদিখ্যেতা করে বিনে পয়সার ইশকুল খুলেছে। ছেলেমেয়েদের চরিত্র গঠন শেখাবে! হুঁ, বাপ-পিতেমা যে ধারায় জীবন কাটাল, সেই ধর্ম ত্যাগ করাই তো মহাপাপ। এই যে কুসুমডাঙা এখন এত বড় গঞ্জ, তবু ভুল করেও কেউ জামাকাপড় বাইরে শুকোতে দেয় না। কুসুমডাঙার ছেলে বাইরের গাঁয়ে বিয়ে করতে গেলে বরযাত্রীপিছু মেয়ের বাপ একজন লোক বহাল রাখে। এ কি কম গৌরবের কথা! আর কোথাকার যুধিষ্ঠির এসে যুগযুগান্তের নিয়মকানুন পালটে দেবে। ধম্মে সবে না রে মিশির!
মিশিরজি ধার্মিক লোক। ডাকাবুকোও বটে। হুংকার ছেড়ে একসময় কুসুমডাঙা বশে রেখেছে। দু’বেলা পুজোআচ্চা করে ঘরের বাইরে পা ফ্যালে। সতুচোর ক্রমে-ক্রমে শহিদ সতু হয়ে ওঠার ব্যাপারে তার ঘোরতর আপত্তি ছিল। কিন্তু হুজুগের ঠ্যালায় তার আপত্তি ধোপে টেকেনি। সতুর নামে এখানে-ওখানে কুচ্চো গাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পাবলিক দেখা গেল সব শহিদ সতুর পক্ষে। বিশেষ করে কড়া সিমেন্ট দিয়ে অম্বুজা আমতলা বাঁধিয়ে দেওয়ার পর নিজেই উদ্যোগ নিয়ে শহর থেকে রিপোর্টার ধরে এনেছিল। ‘গ্রামরক্ষায় সতু বিশ্বাসেরর আত্মবলিদান’ হেডিং দিয়ে খবর বেরিয়েছিল। মাঝে-মাঝে শহর থেকে এডুকেশনাল টুর। ছবি তোলে। সিমেন্টের চাঙড় খসিয়ে নিয়ে যায়। নিচু ডালের আমপাতা ছিঁড়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে থাকে। এখানে মিশিরজির কিছুই করার থাকে না।
মিশিরজি ধার্মিক মানুষ। গলায় জোর আছে। শরীরেও বেশ ভালই স্বাস্থ্যের আয়োজন। কিন্তু দু’টো দোষে বেচারা মার খেয়ে গেল। এক তো তার একা হাতে কুসুমডাঙা বাঁচাও আন্দোলন, দুই, ভূত-পিরেত-পিচাস-বরমদেও, এসব কিছুই সে মানে না। এসব নাকি মনের দুর্বলতা। সবল চিত্তের ধার্মিক মানুষের এসব বিশ্বাস করা উচিত নয়। আদমির মৌত হলে সে হয় স্বর্গে, না হয় নরকে যাবে। ব্যস, সোজা হিসেব। এর বাইরে আর যা কিছু, সব নাকি ছেলে-ডরানো কহানি। এসব কিছু এখন তার মনে পড়ে যাচ্ছিল।
আজ আমতলায় এসেই মিশিরজির কেমন যেন মনে হল। তুলসীদাসী রামায়ণেল বাইরেও কী যেন একটা মনে হচ্ছে। আমগাছটা যথাস্থানে আছে, ভাঙাচোরা শহিদবেদিও অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তবু কী যেন একটা অবাঞ্ছিত শব্দ কিড়ে-মাকড়ের মতো কবীরের দোঁহায় ঢুকে পড়ছে। আরও কাছাকাছি আসতেই মিশিরজির নাকের ডগা ফুলে উঠল। বাতাসে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক গন্ধ। ভাল করে বাতাস টানল মিশিরজি। ঘিয়ে ভাজা লাড্ডুর গন্ধে আমতলা ভারী। শরীরে কেমন যেন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। গুনগুন করে দু’লাইন দোঁহা আউুড়ে একটু এগোতেই কড়া পাকের সন্দেশের গন্ধ। মিশিরজি চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম পৃষ্ঠা মনে করার চেষ্টা করে দেখল, সবই ঠিকঠাক মনে আছে। তবে গন্ধ কেন?
মিশিরজিকে দেখার পর থেকেই সতুর আত্মার সেই দুখি-দুখি নীল আভাটা কেটে গিয়ে একটা ক্রূর হলুদ আভা ফুটতে শুরু করেছিল। সে দেখল, লোকটা আমতলায় এসেই নাক তুলে বাতাসে কী যেন শোঁকার চেষ্টা করছে। মাঝে-মাঝে বিড়বিড় করে নিশ্চয়ই মন্ত্র আওড়াচ্ছে।
আমতলায় এসে দাঁড়াতেই মিশিরজি দেখল, শহিদ বেদির পিছন থেকে কে যেন উঁকিঝুঁকি মারছে। অন্ধকারে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না।
“কওন? কে আছে?”
“আমি, মিশিরজি! গরিব মানুষ।”
মিশিরজির পকেটে বেশ কিছু টাকাপয়সা ছিল স্কুল কমিটির। স্কুলের আলমারিতে না রেখে আজই ভেবেছেন বাড়িতে নিয়ে যাবেন। এ লোকটা, কে জানে, গুন্ডা, লুটেরাও হতে পারে। তবে তার হাতে রয়েছে বরাবরের মতো সেই বিখ্যাত অনেক পুরনো আমলের শক্তপোক্ত ছাতা। এক বাড়িতে এসব ফালতু আদমি চুরচুর হয়ে যাবে। আবার বলা যায় না, সত্যিকারের গরিব ইনসানও হতে পারে। রাতবিরেতে সাহায্য চাওয়া শুরু করেছে।
“ও, ফির রাত্রিবেলা লুকোচুরি খেললে পাপ হোয়। সামনে আও।”
মিশিরজির হিন্দি অথবা বাংলা কুসুমডাঙার লোকের গাসওয়া। সতু কিছু মনে করল না।
“মিশিরজি, আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল, অনেক কিছু জানার ছিল।”
“বতাও।”
“কুসুমডাঙা কেমন জায়গা বলে মনে হয়?”
“এইটা কুনহ ডাঙাই না। বিলকুল পানি। সব বরবাদি আদমি। চোরচোট্টার মুলুক। আগে মালুম হোলে তোর টুটা নৌকায় চড়হ্তাম না।”
সতুর পক্ষে এতক্ষণ শরীর ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ছিল। মিশিরজির শেষ কথাটি শুনে খি-খি করে হাসতে গিয়ে দেখল, শরীরটা বায়ুভূত হয়ে যাচ্ছে। হাত-পা-মুন্ডু সব যেন প্যাঁচ খুলে বেরিয়ে যাবে। স্তন্ভন কৌশলে সতু বায়ুভবন বন্ধ করল।
এক মুহূর্তের জন্য মিশিরজির ধোঁকা লেগে গিয়েছিল। চোখের সামনেই লোকটা যেন কেমন ধোঁয়া-ধোঁয়া হয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল মিশিরজি। পকেটে অত নগদ টাকা রয়েছে! এই লোকটা হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হয়ে একবার দৃশ্য হচ্ছে, আবার অদৃশ্য হচ্ছে, অন্ধকারে চেনাও যাচ্ছে না। কিন্তু গলাটা যেন কেমন শোনা-শোনা মনে হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে এখন। “কহত কবীর শুনো ভাই মাধো.......”
“আপনি বুঝি মনে করেন পৃথিবীর সব কিছু আপনার নিয়মে চলবে! হিসেবের বাইরে কিছু হওয়ার জো নেই বুঝি! প্রত্যেকটা গ্রামের একটা নিজস্ব, কী বলে, শিল্পসংস্কৃতির ধারা আছে। সেই ধারা পালটানোর আপনি কে!”
“আরে মুরখ্, দুনিয়া চলতে সে হিসাব বরাবর। চালাইতে সে পরমাত্মা। রবিন্দর ঠাকুর পঢ়। লিখা আছে- হামি যোখোন ছিলেন আন্ধা। সন্সারে হামরা আন্ধার মতো চলতে আছি। ইশ্শোয়ার পথ দিখাইতেসে।”
“এই সংসারের বাইরে আর কোনও সংসার কি থাকতে পারে না? আপনার রবীন্দ্রনাথ বলেন, আর ইন্দ্রা গাঁধী বলেন, সবখানে কি সবার কথা খাটে! এই ধরেন, আশপাশে কোথাও ভিয়েন বসেনি, তবু কী সুন্দর মিষ্টি আশ্টার গন্ধ। পাচ্ছেন না? তারপর ধরেন, এক্ষুনি আপনার হাতে একটা চুয়ান্ন বছরের পুরনো ছাতা ছিল। কই, সে ছাতা কি আর আপনার হাতে আছে?”
মিশিরজি দেখল, সত্যি তার হাতে সেই বিখ্যাত ছাতা নেই। এ ছাতা খোলার সময় আর বন্ধ করার সময় বেশ তালে-তালে চার-পাঁচ রকমের অদ্ভুত আওয়াজ হয়। রাস্তার কুকুরগুলো পর্যন্ত সন্দেহের চোখে তাকায়। একবার বেগুনি গেঞ্জি আর লাল হাফপ্যান্ট পরা কয়েকটি ছেলে এসে তার কাছে ছাতাটা ধার চেয়েছিল। পরে ডেলি রেটে ভাড়ার কথাও বলেছিল। মিশিরজি রাজি হয়নি। বাংলা ব্যান্ড খুলবে, একবার বন্ধ করবে। পেমেন্টে ভাল। কিন্তু বেগুনি গেঞ্জি আর লাল হাফপ্যান্টের ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত মিশিরজি পিছিয়ে আসে।
সেই ছাতা যদি চোখের নিমেষে হাওয়া হয়ে যায়, তবে কার না রাগ হয়! এ লোক সুবিধের বলে মনে হচ্ছে না।
“দো মিনিটের ভিতে ছাতা ফিরত না পাইলে অনেক খারাপ পাবে।”
“খারাপ হবে! ছাতা? কিসের ছাতা? আচ্ছা মিশিরজি, ভূতপ্রেত, অপদেবতা - এসব বলে নাকি কিছু নেই?”
“উসব থোড়াই আছে । ফালতু কথা। জয় বজরংবলি।” “জয় ভুজঙ্গ ঢালি।” সতু পালটা দিল, “কী হলে মানবেন?”
মিশিরজির হঠাৎ কেমন যেন জেদ চেপে গেল।
এতদিন ধরে নিয়মনিষ্ঠা ভরে সৎকাজ করে এসেছে, পুজোআচ্চা করেছে, তার কোনও শক্তি নেই। কিসের বরমদেও, কিসের বা পিচাশ! যৌবনকালের তেজ যেন ফিরে এল। চ্যালেঞ্জ যখন করছে এই ফালতু লোকটা, দেখা যাক।
“আখুন ফাগুন মাহিনা। তুমি আম খিলাও। তবে বুঝব কত ধানে কিতনা চাওল আছে। হঃ হামাকে ভূতপিরেত শিখলাচ্ছে।”
হঠাৎ মিশিরজির সামনে থেকে সতু বিশ্বাস বিলকুল উবে গেল। পর মুহূর্তে সামনে হাজির, “এই যে আপনার আম!”
মিশিরজি যন্ত্রের মতো সামনে হাত বাড়িয়ে দিল। তার হাতে একটা আম ধরিয়ে দিল সতু। অন্ধকারে রং বোঝা যায় না, কিন্তু আদতে দারভাঙ্গার মানুষ মিশিরজি হাতে নিয়েই বুঝল, একদম গাছপাকা। কার্বাইডের ক-ও নেই।
“নিন, মুখে দিন। না হলে আবার হয়তো বলবেন মাটির কিংবা পেলাসটিকের।”
মিশিরজি তখন ভয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কুয়োয় ঝাঁপ দিতে তৈরি। দেওয়ালেল পিঠ ঠেকে গেছে। এখন সামনে ছাড়া পথ নেই। গলাটা এত চেনা লাগে কেন। একটু যেন পা টেনে হাঁটছিল। কে ও?
মিশিরজি মনে-মনে েএকবার আউড়ে নিল, “ঝরাপাতা গো হামি তুমহারি দলে.....” বলেই এক কামড় দিল ডান হাতের আমে। রসটা জিভে লাগতে যতক্ষণ। তারপর সেই আমতলায় যেন একটা দক্ষযজ্ঞ বেধে গেল। এক দিকে মিশিরজির কানফাটানো পরিত্রাহি চিৎকার, অন্য দিকে সতুর মিশিরজিকে ঘিরে ঘুরে-ঘুরে নাচ। সঙ্গে দু’জনেরই সমানে মুখ চলছে।
“মর গিয়া রে, জ্বল গয়া। হামার ইশকুল। হায় রাম, হায় রাম, জান লে লিয়া খাট্টা আম। থোড়া জল, একটু পানি দিবেন কেউ। ভগবান তেরা ভালা করে........”
ওদিকে সতু খানিকটা রবীন্দ্রনৃত্যের ভঙ্গিতে হাওয়ায় শরীর ভাসিয়ে মনের সুখে গাইছে, “আমতলাতে হচ্ছে নাচন, নাচে মিশির তালে-তালে।”
“মুঝে জহর পিলা দিয়া রে, হামি জেনেশুনে বিষ করলাম পান.......”
সতুর গান আর মিশিরজির অদ্ভুত নাচ দেখে আশপাশের গাছ থেকে, বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে, পুরনো ইটের পাঁজা থেকে সড়াৎ-সড়াৎ করে দর্শকবৃন্দ আসছিল। তারা খুব উৎসাহ দিচ্ছিল। আসলে বহুদিন কোনও ভাল গানবাজনার আসর হচ্ছিল না। এখন বেশ জমে গেল। শেষে সতু বিশ্বাস মিশিরজির সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
“ভূত আছে সত্যি কি না?”
“সচ্।”
“ইশকুল তুলে দিবি। এই নে ছাতা। লুকিয়ে রাখবি। সরকার জানতে পারলে জব্দ করে নেবে। এই দ্যাখ, আমার মুখটা ভাল করে দেখে নে!”
“তুই? সতু? জিন্দা?”
সমস্ত আমতলা জুড়ে একটা হাসির হর্রা উঠল। মিশিরজি দেখল, সতুর শরীর ভেঙে যাচ্ছে। হাত-পা-মুন্ডু যেন প্যাঁচ খুলে বেরিয়ে আসছে। চারপাশে অজস্র কালো-কালো ছায়া, হাসির গমকে গলে-গলে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে!

0 মন্তব্যসমূহ