পশুরা যখন সেলিব্রিটি
বছর ছত্রিশ আগের সেই দিনটার কথা পরিষ্কার মনে পড়ে ডেভিড করবেটের। সারা লন্ডন জুড়ে হইচই। দিনকয়েক আগে এক প্রদর্শনী থেকে চুরি গেছে জুলে রিমে ট্রফি, অথচ ৬৬-র বিশ্বকাপ কড়া নাড়ছে দোরগোড়ায়। হাজার চেষ্টা করেও পুলিশ খুঁজে পায়নি সেই ট্রফি। একদিন ‘টেম্স রিভর বার্জ’-এর কর্মী ডেভিড তাঁর দক্ষিণ লন্ডনের অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে বেরিয়েছিলেন টেলিফোন করতে। সঙ্গে তাঁর প্রিয় কুকুর পিকল্স। হঠাৎ ঝোপের আড়ালে একটা মোড়ক পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করতে থাকে কুকুরটি। মোড়কটি খুলতেই ডেভিডের চক্ষুস্থির! এই তো সেই হারিয়ে যাওয়া জুলে রিমে ট্রফি, যার খোঁজে হন্যে হয়ে গেছে লন্ডন পুলিশ। হারানো মানিক খুঁজে দিয়ে রাতরাতি হিরো হয়ে গেল পিকল্স। একের পর এক সংবর্ধনায় পিকল্স যখন ক্লান্ত তখনই এক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তার। তবে পিকল্সকে ভোলেনি ব্রিটিশ ফুটবল। ১৯৬৬-র বিশ্বকাপ জয়ী ইংল্যান্ড দলের কথা উঠলেই জিওফ হার্স্ট, ববি মুরদের সঙ্গে সমানভাবে উচ্চারিত হয় এই ‘ক্যানাইন’ ফুটবল-বন্ধুর নাম।
মনে করা হয়, মানুষই ঈশ্বরের মহত্তম সৃষ্টি। কিন্তু অনেক সময়েই মানুষের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছে তথাকথিত ‘মনুষ্যেতর’ জীবরা। শুধু টক্কর দেওয়াই নয়, পিকল্সের মতো কোথাও কোথাও হিউম্যান কাউন্টারপার্টকে ছাপিয়ে গেছে তারা। পিকল্সের কথা তো প্রথমেই বলা হল। এরকমই আর একজস হল লর্ড্স মাঠের সকলের প্রিয় ‘পিটার দ্য ক্যাট’। ১৯৬৪-র নভেম্বরে মারা যায় পিটার। পরের বছর উইজডেন ক্রিকেট অ্যালমানাকের পাতায় জায়গা করে নিয়েছিল পিটারের ‘ওবিচুয়ারি’। পিটারের মতোই সমান জনপ্রিয় এক নাম-না-জানা চড়ুই। ১৯৩৬-এর ৩ জুলাই লর্ড্সে জাহাঙ্গির খানের মারা বলের আঘাতে তার মৃত্যু হয়। এখনও এম সি সি ক্রিকেট মিউজিয়ামের অন্যতম সেরা আকর্ষণ তার স্টাফ করা দেহ। শুধু ক্রিকেটে নয়, টেনিস জগতেও উপস্থিত মানুষের ডানাওয়ালা বন্ধুরা। সাম্প্রাস, আগাসি বা হিঙ্গিসের মতো মহাতারকাদের উজ্জ্বল উপস্থিতি সত্ত্বেও ২০০০ সালের উইন্বলডনে সেন্টার কোর্ট আর ইংরেজি ট্যাবলয়েডের পাতায় সমানভাবে জায়গা করে নিয়েছিল হামিশ নামের বাজপাখিটি। খেলা চলার সময় দুষ্টু পায়রাদের কোর্টে আনাগোনা বন্ধ করতে হামিশকে হাজিরা দিতে হত উইম্বলডনে।
তবে যতই পাখিতের পাবলিসিটি করা হোক, বিখ্যাত হওয়ার দৌড়ে অন্যান্য প্রানীদের বেশ খানিকটা পিছনে ফেলে দিয়েছে কুকুররা। সিনেমায় অভিনয় করা হোক বা মডেলিং, কিংবা তার চেয়েও একধাপ এগিয়ে বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানির, ‘স্পোক্সঅ্যানিম্যাল,’ সবেতেই হাজির তারা। এ প্রসঙ্গে সবার আগে বলতে হয় ‘জার্মান শেফার্ড অব দ্য মিলেনিয়াম’ রিনটিনটিনের কথা। ১৯১৮ সালে লি ডানকান নামে এক মার্কিন সেনা অফিসার তাকে কুড়িয়ে পান ফ্রান্সের এক পরিত্যক্ত জার্মান ট্রেঞ্চে। ১৯২২ সালে আমেরিকায় আসার পর ন’বছর ধরে প্রায় তিরিশটি হলিউডের ফিল্মে ‘হিরো’ সেজেছিল রিনটিনটিন। কেরিয়ারের ‘পিক’-এ সপ্তাহে প্রায় ন’হাজার ডলার রোজগার ছিল তার। হিরো বসানো কলার, নিজের প্রোডাকশন ইউনিট, লিমুজিন, ড্রাইবার, শেফ বা পাঁচতারায় ভীষণভাবে অভ্যস্ত ছিল রিটিনটিন।
আদবকায়দার জীবনযাপনে খুব কাছাকাছি থাকবে ল্যাসি। আসল নাম প্যাল। ১৯৪১-এ হলিউডে প্রথমবারের স্ক্রিন টোস্টে ডাহা ফেল করেছিল প্যাল। কিন্তু আবার সুযোগ আসে। ‘ল্যাসি কাম হোম’ ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয় করে ‘ল্যাসি’ নামেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে কুকুরটি। এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। মার্কিন বায়ুসেনার একটি বি-১৭ বিমানের নাম দেওয়া হয় ‘ল্যাসি কাম হোম’। এর থেকেই বোঝা যাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কতটা জনপ্রিয় ছিল সে। ল্যাসির বংশধররাও প্রায় আটপুরুষ ধরে বিনোদন জগতের সঙ্গে যুক্ত।
অন্ধকার আঁস্তাকুড় থেকে কল্পনার রাজপ্রাসাদে উত্তরণ। নিপারকে নিয়ে কিছু বলতে গেলে এভাবেই শুরু করা উচিত। বম্বি ব্রুক নামে এক ভদ্রমহিলা একটি বেওয়ারিশ কুকুরদের খোঁয়াড় থেকে আবিষ্কার করেছিলেন দুধসাদা শরীর আর কুচকুচে কালো দুই কানের অধিকারী নিপারকে। ২০ টিরও বেশি বিজ্ঞাপনে অংশ নেওয়া নিপার ছিল আমেরিকার অ্যানিম্যাল মডেলদের মধ্যে ব্যস্ততম চরিত্র। ব্রুকের অ্যানিম্যাল রেককিউ সেন্টারের প্রায় পুরোটাই চলত নিপারের রোজগারে।
যে কোনও চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষ লিওকে একডাকে চেনেন। মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ারের সব ছবিই শুরু হয় লিওর গর্জনে। ১৯২৮ সালে ‘হোয়াইট শ্যাডোজ অব দ্য সাউথ সিজ’ ছবি শুরুর আগে প্রথমবার পরদায় আসে লিও। তারপর থেকেই সে ‘এম জি এম’ - এর ট্রেডমার্ক। ১৯৩৮-এ ফিলাডেলফিয়ার চিড়িয়াখানায় মারা যায় লিও। তার মৃত্যুর পর স্ল্যাট্স, জ্যাকি, ট্যানার-রা লিওর হয়ে প্রক্সি দিয়েছে। লিওর আর এক জাতভাই মার্জান বিখ্যাত হয়ে ওঠে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস হওয়ার পর। তালিবানি অত্যাচারে এক চোখ হারানো সিংহটিকে নিয়ে কম চিৎকার করেননি পশুপ্রেমীরা। তালিবানি সাম্রাজ্য পতনের পর সারা পৃথিবী থেকে মার্জানের জন্য সাহায্য আসতে থাকে। তবে তা উপভোগ করার জন্য বেশিদিন বেঁচে ছিল না সে।
সাহিত্য আর সেলুলয়েড, দু’য়ের দৌলতে অমর হয়ে আছে এলসা। এলসার মতোই বাস্তবের আর এক চরিত্রকে নিয়ে হারমান মেলভিল লিখেছিলেন ‘মবি ডিক’। মোচা ভিক নামে পরিচিত সাদা তিমিটি প্রায় ৩০ জন নাবিকের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল। পিঠে ১৯ টি হারপুন গাঁথা হিংস্র তিমি আর তিমি-শিকারি জাহাজের নাবিকের চাকরির অভিজ্ঞতা, এই দু’য়ের মিশেলে লেখা হয়েছিল বিখ্যাত সাহিত্য মবি ডিক। এলসার মতোই অমর মোটা ভিক।
‘ফ্রি উইলি’ দেখেছেন, অথচ ‘কিকো’কে চেনেন না, এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সিনেমার উইলিই আসলে কিকো। ১৯৮৫ তে মেক্সিকোর ‘রেইনো অ্যাডভেঞ্চুরা’ সাড়ে তিন লাখ ডলারে কিনে নেয় কিকোকে। ১৯৯২-এ ওয়ার্নার ব্রাদার্স-এর বিখ্যাত ছবি ফ্রি উইলি তৈরি হল কিকোকে নিয়েই। তার দেখাশোনার জন্য দু’বছর পর তৈরি হয় কিকো ফাউন্ডেশন।’ ৯৫-এ দ্বিতীয়বার ফ্রি উইলি সাজে সে।
আধুনিক বিজ্ঞানের সবচেয়ে বিতর্কিত শব্দ ‘ক্লোনিং’। ‘নেচার’ পত্রিকায় ৯৭-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর প্রথম ক্লোন্ড ভেড়া ডলির জন্মের কথা প্রকাশিত হওয়ার পর স্টিফেন হকিং থেকে বিল ক্লিনটন পর্যন্ত সকলেই নড়ে বসেছিলেন। স্কটল্যান্ডের রোজলিন ইনস্টিটিউটে বিজ্ঞানী ইয়ান উইলমুটের তত্ত্বাবধানে জন্মেছিল ডলি। এ বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি ফুসফুসের সংক্রমণে মৃত্যু হয়েছে তার। ১৯৫৭ সালে মহাকাশে পৃথিবী পরিক্রমার গৌরব অর্জন করলেও কুকুর লাইকা বেঁচেছিল মাত্র পাঁচদিন। অত্যাধিক উত্তাপে ক্যাপসুলের মধ্যেই মারা যায় সে। লাইকার পরেও অবশ্য বেশ কয়েকবার কুকুর পাঠানো হয়েছে মহাকাশে, কিন্তু তাদের কেউই লাইকা হয়ে উঠতে পারেনি। তুলনায় অনেক বেশি সফল হ্যাম আর ইনোস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই শিম্পাঞ্জি। এদের মধ্যে ইনোস দু’বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছে। ১৯৬১ তে মহাকাশে যায় সে। মহাকাশ ভ্রমণের পর বেশ কিছুদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ইনোসেরই দাপট ছিল।
শুধু চেহারার বৈশিষ্ট্যের জোরেই বিখ্যাত অনেক পশু। কয়েক বছর আগে নর্থ ক্যারোলিনার পার্কার পরিবারে মাত্র ২৫ সেন্টিমিটারের চি হুয়াহুয়া গোত্রের কুকুর ‘পিনাট্স’কে দেখতে যে ভিড়টা হত, সেটাই এখন হয় ব্যঙ্ককের এক বাড়িতে ১২ সেন্টিমিটারের ইয়র্কশারয়ার টেরিয়ার ‘বিগ বস’ - এর জন্য। ঠিক এরকমই দর্শনীয় স্কটল্যান্ডের ‘স্নোবি’। ১৯৯৭ সালে মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত তার দৈর্ঘ্য ছিল ৪১ ইঞ্চি। সবচেয়ে লম্বা বেড়াল হিসেবে এখনও তার নাম আছে গিনেসের পাতায়।
১৯০২ তে মিসিসিপিতে ভালুক শিকারে গিয়ে একটি অনাথ ভালুক বাচ্চাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। পরদিন ওয়াশিংটন পোস্টের পাতায় ঘটনাটি নিয়ে একটি কার্টুন প্রকাশিত হয়। কার্টুনের ভালুকটির অনুকরণে তৈরি হয় একটি পুতুল। রুজভেল্টের ডাকনাম অনুসারে তার নাম রাখা হয় ‘টেডি’। তবে টেডি বিয়ারের এই ব্যাখ্যা মানতে রাজি নন জার্মানরা। তাঁদের মতে, মার্গারেট স্টিফ নামে এক ভদ্রমহিলা স্থানীয় চিড়িয়াখানার ভালুকের ছবি দেখে প্রথম টেডি বানান। টেডির ইতিহাস যা-ই হোক না কেন, সে সুপার-সেলিব্রিটি। একথার সমর্থনেই বোধহয় এবছর একশোয় পা দিল সে।
0 মন্তব্যসমূহ