ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে
হোস্টেলে থেকে স্কুলে পড়ে দিবাকর। হোস্টেলের তিনতলায় থাকেন সুপারিন্টেন্ডেন্ট কেশববাবু। স্কুলে তিনি ইতিহাসও পড়ান। ভারী কড়া মেজাজের লোক। রাত্রি এগারোটার পর আলো জ্বালিয়ে পড়া মুখস্থ করা কিংবা জমিয়ে আড্ডা মারা তিনি আদৌ পছন্দ করেন না। তাই ছেলেরা এসব বিষয়ে খুব হুশিয়ার থাকে।
আর না থেকেই বা উপায় কি?
রাত্রে মাঝে মাঝে খাওয়াদাওয়া সেরে তিনি একটা সিগারেট ধরিয়ে সামনের ছাতটায় এসে দাঁড়ান। এখান থেকে হোস্টেলের সব কয়টি ঘর পরিষ্কার দেখা যায়।
দরজা-জানলা বন্ধ করেও আলো জ্বালিয়ে রাখবার উপায় নেই। কারণ প্রত্যেকটি ঘরে একটি করে ভেন্টিলেটার আছে, সেখান দিয়ে ঘরের আলো দেখা যায়। তাই এগারোটা বাজবার ঘন্টা পড়লেই ছেলেরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আলো নিবিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ে।
পরীক্ষার সময় দিবাকর একদিন ধরা পড়ে গেল। অনেক রাত্রে আলো জ্বালিয়ে সে পড়া করছিল, এমন সময় বন্ধ দরজার ওপর কয়েকটা টোক পড়লো।
দিবাকর দরজা খুলে দিয়ে দেখে, সামনে দাঁড়িয়ে স্বয়ং কেশববাবু। ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল একধারে।
‘আলো জ্বেলে কী করছিলে?’
‘পড়ছি স্যার।’ ঘাড় চুলকে দিবাকর বললে।
‘রাত জাগলে শরীর খারাপ হয় তা জানো?’
দিবাকর চুপ করে রইল।
‘যাও শুয়ে ঘুমোও গে। আর কখনও এমন কাজ করো না।’ কেশববাবু ধীরে ধীরে চলে গেলেন।
রাত জেগে লেখাপড়া করা তিনি পছন্দ করেন না। বলেন, ‘সমস্ত নিয়মমত করা উচিত। শুধু পড়াশোনা নিয়ে থাকলে চলবে না। স্বাস্থ্যের দিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। মনের সঙ্গে শরীরের ভীষণ ভাব, একেবারে গলায়-গলায় বলতে পারো।’
যাই হোক সে-রাত্রের মত দিবাকরকে আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়তে হলো। কিন্তু ঘুম এল না। মনে মনে সে মতলব আঁটতে লাগলো। এখন থেকে রাত জেগে না পড়লে পরীক্ষায় সে সুবিধে করতে পারবে না কিছুতেই। ভাবতে ভাবতে চমৎকার একটা ফন্দি এল মাথায়।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা কার্ডবোর্ড কেটে ভেন্টিলেটারের ফাঁকটা সে বন্ধ করে দিলো। যাক্, বাঁচা গেল এবার। এখন সে একেবারে নিশ্চিন্ত। অনেক রাত অবধি পরীক্ষার পড়া সে পড়তে পারবে।
সেদিন অনেক রাত্রে, কত রাত ঠিক মনে নেই, ঘরের আলোটা টুপ্ করে নিবে গেল হঠাৎ।
এ কী হলো? কেশববাবু বোধহয় জানতে পেরেছেন কোনরকমে। ভয়ে সে কাঠ হয়ে ঘামতে লাগলো।
খস্ খস্ খস্ খস্। বাইরে বারান্দা দিয়ে এক-জোড়া পায়ের শব্দ যেন এদিকেই এগিয়ে আসছে। কেশববাবুর নয় তো? কে জানে। দিবাকর নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলো।
খস্ খস্ খস্ খস্। শব্দটা ধীরে ধীরে তার ঘরের সামনে দিয়ে চলে গেল বারান্দার ও প্রান্তে।
দিবাকর যেন একটা রহস্যের গন্ধ পেল। দরজা খুলে বেরিয়ে এল বারান্দায়। না, কেউ কোথাও নেই। গল্পে পড়া ঘুমন্ত একটা পুরীর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে হোস্টেলটাকে। আর কী ভীষণ অন্ধকার চারদিকে। নিজের হাতটাও ভালো করে দেখা যায় না। ঘরের মধ্যে ফিরে এল দিবাকর।
খস্ খস্ খস্ খস্। বোঝা গেল শব্দটা উল্টো দিক থেকে আসছে এবার। দিবাকর নিঃশব্দে দরজা খুলে আবার বেরিয়ে এল। কালো একটা বিড়াল ছুটে পালিয়ে গেল তাকে দেখে। অন্ধকারে চোখটাই তার নজরে পড়ে। অনেক দূরে কোথায় একটা কুকুরের একঘেয়ে কান্না শোনা যাচ্ছে। এ ধারে সতের নম্বর ঘরের সামনে কি একটা যেন দুলছে। বেড়ালটা সেখানে এসে একবার পিছনে ফিরে তাকালো। তারপর মিহিসুরে একটা ভেংচি কেটে দে ছুট্।
না, কেউ কোথাও নেই। আর কী আশ্চরর্য, ঠিক সেই মুহূর্তে দিবাকরের ঘরের আলোটা আবার জ্বলে উঠলো নিঃশব্দ অট্টহাসির মত!
আলোটা নিবিয়ে দিয়ে দিবাকর দরজার আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগলো। ভয় সে পেয়েছে ঠিকই, তাই বলে সাহসটা একেবারে হারায় নি। ঘটনার মধ্যে কোথায় যেন একটু রোমাঞ্চ আছে।
খস্ খস্ খস্ খস্। চলার শব্দটা আবার এগিয়ে আসছে এদিকে। দিবাকর এবার স্পস্ট দেখতে পেল, কালো কাপড়ে ঢাকা একটা ছায়ামূর্তি চুপিসাড়ে চলে যাচ্ছে তার দরজার সামনে দিয়ে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো সে। তারপর পিছন থেকে আকস্মাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লো সেই চলমান ছায়ামুর্তিটার উপর। তারপর যুযুৎসুর িএকটা প্যাঁচ খেয়ে নিজেই ছিট্কে পড়লো দুরে। দেয়ালে মাথা লেগে অজ্ঞান হয়ে গেল সে।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো, সে তার নিজের বিছানাতেই শুয়ে আছে আর দরজাটা খোলা-হাহা করছে। তবে কি গতরাত্রে সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল? কিন্তু মাথার পিছনে হাত দিতেই সে ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল। জায়গাটা এখনো ফুলে ঢোল হয়ে আছে।
দিন পেরিয়ে আবার রাত এল। সে-রাত আরো গভীর হলো। দিবাকর তার ঘরের খোলা জানলাটার সামনে এসে দাঁড়ায়। আকাশে জোনাকির মত তারা জ্বলছে অসংখ্য। চাঁদ ওঠে নি আজ। অমাবস্যা বোধ-হয়। রাস্তার পাশে অশ্বথ গাছটার পাতাগুলো হাওয়ায় দুলছে। সাপের মত পিচ্ছিল ঘুমন্ত পথ। পাশের বাড়ির একটা ছেলে পড়ে দিবাকরের সঙ্গে। তার ঘরে আলো জ্বলছে আর তার খানিকটা আভা এসে পড়েছে রাস্তার ওপর।
হোস্টেলের দরজাটা আব্ছা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। সামনের ছোট একটা উঠোনের পরেই কাঠের একটা দরজা। তার পাশে খাটিয়ায় শুয়ে থাকে দারোয়ান সিদ্ধি টেনে।
ঢং। কোথায় কোন্ ঘড়িতে সশব্দে একটা বাজলো। আর সেই সঙ্গে কালো কাপড়ে ঢাকা একটা মূর্তি হোস্টেলের দরজা টপ্কে লাফিয়ে পড়লো উঠোনে।
সঙ্গে সঙ্গে দিবাকর ঘর থেকে বেরিয়ে নেমে এল নীচে। নিস্তব্ধতায় চারদিক থম্থম্ করছে।
সিড়ি দিয়ে নেমে বাঁ দিকে স্নানের ঘর। দিবাকর সমস্ত দেখেতে পাচ্ছে। ভয়ে তার সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে আসছে যেন। এমন সময় কোথা থেকে একটা উইচিংড়ে উড়ে এসে বসলো তার নাকের ডগায়। আর একটু হলে সে হে’চে ফেলছিল আর কি।
সিঁড়ির পাশের দেয়ালে আলোর মেন সুইচ। ছায়ামূর্তি সেখানে এসে এক মুহুর্তের জন্য থামলো। খুট্ করে একটা শব্দ হলো অন্ধকারে। তারপর মূর্তিটা ঘুরে আবার উঠলে লাগলো দোতলায়।
আলো নিভে যাওয়ার রহস্যটা দিবাকরের কাছে বেশ স্পষ্ট হয়ে গেল এতক্ষণে। সিঁড়ির মুখে ছায়ামূর্তিটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে দিবাকর ওপরে উঠে এল।
খানিকটা আসতেই আবার দেখা গেল মূর্তিটাকে। চলার গতিতে যেমন দ্রুততা তেমনি সাবধানতা।
একটা দূরত্ব রেখে দিবাকর ওকে অনুসরণ করতে লাগলো। দোতলায় উঠে মূর্তিটা থেমে গেল একবার। চারদিকটা দেখে নিল, তারপর বারান্দা ধরে সোজা এগিয়ে চললো। একটু পরে আর তাকে দেখা গেল না।
দৃষ্টিটাকে তীক্ষ্ম করে দিবাকর তাকে আবিষ্কার করবার চেষ্টা করে। কিন্তু বৃথাই। গেল কোথায় সে? বারান্দার মধ্যে কোনো গুপ্ত দরজা আছে না কি? কিংবা এর সবটাই ভৌতিক।
কথাটা মনে হতেই দিবাকর হাসলো। বিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানের যুগে ‘ভুত’ মানতে সে রাজী নয়।
একটা অন্ধকার কোণ বেছে নিয়ে দিবাকর তার ফিরে আসার অপেক্ষা করতে থাকে। যে মেন সুইচটা সে এইমাত্র নিবিয়ে দিয়ে গেছে, সেটা জ্বালতেও আবার তাকে ফিরে আসতে হবে।
একটু পরে কোথায় একটা দরজার খিল খোলার শব্দ পাওয়া গেল। কেউ উঠলো বোধহয়। অন্ধকারের আবছা আলোতে ভেসে উঠলো যে ছেলেটির মুখ, তার নাম গণেশ চাকলাদার। স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র সে। আজ চার বছর ধরে সে একই ক্লাসে পড়ে আছে। ছেলেদের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে, ধৈর্য পরীক্ষায় সে রবার্ট ব্রুশকেও হার মানাবে।
দিবাকর আর অপেক্ষা করলো না। গণেশের পাশ কাটিয়ে ছায়ামূর্তিটা যে পথে মিলিয়ে গেছে, সেই পথে চলতে শুরু করলো। তারপর অন্ধকারে আর দেখা গেল না দিবাকরকে।
একটু পরে গণেশ ফিরে এল তার ঘরে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে দাঁড়াতেই অন্ধকার কোণ থেকে কে যেন কথা বলে উঠলো, ‘চিনতে পারো আমাকে?’
‘কে?’ ভয়ে গণেশের গলার স্বর যেন বুজে এসেছে। হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বাললো কোনরকমে।
‘আলোটা নিবিয়ে দাও গণেশদা। কেশববাবু জানতে পারলে তোমায় আর আস্ত রাখবেন না।’
‘ওরে হতভাগা, তুই এসে ঢুকেছিস্ এখানে?’ ধড়ে যেন প্রাণ আসে গণেশের, ‘তাই তো বলি-’
‘তার আগে আলোটা নিবিয়ে দাও গণেশদা।’ দিবাকরের গলায় অনুরোধের সুর।
আলো নিবে গেল। আর সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে গণেশ যেন নিজেই নিজেকে ভেংচি কাটলো, ‘আমার আবার ভয় কি? আলো জ্বেলে পড়ছি না তো’।
‘তার চেয়ে আরো সাংঘাতিক কাজ করেছ।’
‘কি করেছি?’ গণেশ এগিয়ে আসে।
দিবাকর বলতে লাগলো, ‘রাত একটার সময় হোস্টেলের দরজা টপকানো, সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় মেন সুইচ বন্ধ করে দেওয়া, ইত্যাদি আরো কত কি?’
‘সত্যি তোর বুদ্ধি আছে দিবাকর।’ গণেশ এবার হার মানলো, ‘দেখতে ক্যাবলা হলে কী হবে। হ্যাঁ, তোর সাহস আছে বটে। আচ্ছা, আমাকে তুই চিনলি কি করে? গোয়েন্দাগিরি করছিলি নাকি?’
‘তার আগে বলো, এই রাতে বাইরে তুমি কী করো?’
‘থিয়েটারের রিহার্সাল দিচ্ছি রে পাগলা। ক্লাবে সিরাজদ্দৌলা নাটক হবে। যাবি নাকি দেখেতে?’
‘ও!’ দিবাকরের তেমন উৎসাহ দেখা গেল না। এতবড় একটা কৃতিত্বে এমন উপেক্ষার ভাব ভালো লাগলো না গণেশের। ঝাঁঁঝালো গলায় বললে, ‘তোরা এসবের কী বুঝবি? থিয়েটার যে কত বড় একটা আর্ট, তার বুঝবি কি? লেখাপড়াই শিখবি কেবল। মানুষ হবি না। পড়েছিস্ নাটকখানা’
‘না। স্কুলের বই পড়েই সময় পাই নে।’
‘ঐ স্কুলের বইয়ের পোকা হয়েই থাক। কিস্সু হবে না তোদের।’ গণেশ রীতিমত বিরক্ত।
‘একটা কথা বলবো গণেশদা?’
‘কি?’ গলার স্বরটা একটু যেন নরম ঠেকলো।
‘কালরাত্রে যুযুৎসুর যে প্যাঁচটা কসিয়েছ আমার ওপর, সেটা শিখিয়ে দিতে হবে কিন্তু।’
‘কেন, চোরের ওপর বাটপারি করবি নাকি? আচ্ছা, কাল তোর খুব লেগেছিল, না রে?’
‘লেগেছিল বৈ কি।’ দিবাকর আহত জায়গাটায় একবার হাত বোলালো, ‘এখনো মাথাটা ফুলে আছে।’
‘দুঃখ করিস্ নে।’ গণেশ অন্ধকারে ওর পিঠে চাপড়ে দিলে, ‘পেটভরে একদিন খাইয়ে দেবো।’
‘ঠিক বলছো?’
‘হ্যাঁ রে পাগল, ঠিক বলছি। কিন্তু মনে রাখিস, এসব কথা কেউ যেন না জানতে পারে।’
‘ঠিক আছে। কিন্তু তোমারও মনে থাকবে তো?’
‘থাকবে থাকবে।’ অন্ধকারেও গণেশের সাদা দাঁত-গুলো ঝক্ঝক্ করে উঠলো, ‘এখন শুতে যা অনেক রাত হয়ে গেল।’

0 মন্তব্যসমূহ