বিপ্লবী নায়ক প্রমোদ দাশগুপ্ত
স্নেহের বন্ধুগণ, জীবনধারণের পক্ষে জল ও বাতাসের প্রয়োজনীয়তা কতখানি, তা বলার দরকার পড়ে না। অথচ তাদের বিদ্যামানতা বা উপস্থিতি নিয়ে কিন্তু আমরা আদৌ মাথা ঘামাই নে। তারা আছে ও থাকবে, এটা যেন এক স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার। কিন্তু হঠাৎ যদি কোনটার অভাব ঘটে, তাহলে পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে, ভাবতে পার? মুহূর্তে শুরু হবে হাহাকার।
ঠিক তেমনি আমাদের মধ্যে সময় সময় দুর্লভ প্রতিভা ও শক্তির অধিকারী এমন এক-একজন ব্যক্তির আগমন ঘটে, সমাজ ও দেশের প্রকৃত কল্যান ও অগ্রগতির দিক থেকে যাঁদের উপস্থিতি সবার পক্ষে এক পরম স্বস্তির ব্যাপার। তাঁরা আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন, এটা যেন জল-বাতাসের মতোই স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু হঠাৎ একদিন যখন পার্থিব নিয়মে তাঁদের তিরোধান বা মৃত্যু ঘটে, তখন সকলের অবস্থা হয় মারাত্মক- যেন বজ্রাহত। পরমাত্মীয়-বিয়োগব্যাথায় অসহায় বিবশ মন শুধুই হাহাকার করতে থাকে।
ঠিক এমনি এক অবস্থা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম ১৯৮২ সালের ২৯ শে নভেম্বর বিকেল থেকে, যখন হঠাৎ প্রচারিত হলো যে, বিপ্লবী জননায়ক প্রমোদ দাশগুপ্ত আর নেই, সুদূর চীনের রাজধানী বেইজিং বা পিকিংয়ে শেষনঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
ভয়ঙ্কর এই দুঃসংবাদটি যখন সারা দেশে, বিশেষ করে কলকাতায় তথা পশ্চিমবাংলায় ছড়িয়ে পড়লো, তখন অসংখ্য অগুনিত মানুষের ওপর তার যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল, তা ভাষায় ব্যক্ত করার নয়। বিনামেঘে বজ্রাঘাতে ব্যক্তিবিশেষ বা কিছু ব্যক্তির যে অবস্থা হয়, ঠিক তেমনি আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত এই নিদারুণ খবরে শহরে গ্রামে গঞ্জে সর্বত্র শ্রমজীবী মানুষ যেন হঠাৎ বোবা হয়ে যায়।
মন বিকল, চিন্তাশক্তি অসাড়, সবার চোখমুখের অসহায় দিশেহারা ভাব, সবহারানোর নিরুপায় ব্যাথা-সে দৃশ্য বুঝি কোনদিনই ভুলবার নয়।
তারপর কি ঘটেছে, তোমরা অনেক স্বচক্ষে দেখেছ বা খবরের কাগজে পড়েছ। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কস-বাদী)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদর দপ্তর থেকে কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় এলাকায় এলাকায়, মহানগরীর সীমানা ছাড়িয়ে জেলায় জেলায় গ্রামে গঞ্জে শহরে আর খবরের কাগজের পাতায় পাতায় দিনের পর দিন প্রিয় জন-নায়কের বিয়োগ শোকোচ্ছসের যে স্বতঃস্ফুর্ত অভিব্যক্তি দেখা গেছে, তার কোন পূর্ব নজির আছে বলে জানা নেই।
তারপর ৫ ই ডিসেম্বর সকালে পিকিং থেকে চীনা এলাকা জনসমূদ্রে পরিণত হয়েছে। এবং সে সমুদ্র নিস্তব্ধ নির্বাক। বিমান থেকে যাত্রীরা সবাই নেমে এলেন একে একে, নামলেন না শুধু একজন, শ্রমজীবী মানুষের প্রাণপুরুষ অপ্রতিদ্ধন্দী জননায়ক প্রমোদ দাশগুপ্ত, বিমান থেকে নেমে এল তাঁর কফিনে মোড়া নিথর নিষ্প্রাণ মৃতদেহ। স্তব্ধ মৌন সুবিশাল জনতার হৃদয়নিংড়ানো অশ্রুভেজা আকুল দীর্ঘশ্বাসে বাতাস তখন ভারী হয়ে উঠেছেঃ সব শেষ! আর কোন দিনই ফিরবেন না উনি। অসমাপ্ত কাজ ফেলে রেখে না বলে কয়ে চলে গেলেন চিরকালের মতো।
বিমানবন্দর থেকে প্রমোদ দাশগুপ্তের মৃতদেহ প্রথমে আনা হয় আলিমুদ্দিন স্ট্রীটের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য কমিটির দপ্তরে, সেখান থেকে অপরহ্নে মৃতদেহ নিয়ে শুরু হয় শেষ শোকযাত্রা কেওড়াতলা শ্মশানের দিকে। এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সর্ববয়সের সর্বভাষার সর্বধর্মের ও সর্বস্তরের রুদ্ধবাক, জনসাধারণ যেভাবে তাদের বিপ্লবী নায়ককে জানিয়েছে শুধু শ্রদ্ধা আর শ্রদ্ধা আর আকুল প্রণতি, তার বিবরণ দিতে যাওয়া বৃথা পণ্ডশ্রমমাত্র। অব্যক্ত ব্যাথায় ও শোকে মুহ্যমান কলকাতা মহানগরী সেদিন বুঝি বোবা কান্নায় কেঁপেছে থরথর করে।
তারপর এল ৭ ই ডিসেম্বর। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে প্রয়াত প্রমোদ দাশগুপ্তের স্মরণসভায় সেদিন যে দৃশ্য দেখা গেল, তা অভূতপূর্ব। কাছের ও দূর-দূরান্তের অগণিত মানুষের স্রোতে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড যে সেদিন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল, এটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। অস্বাভাবিক ও অকল্পনীয় ব্যাপার হলো, সে শোকসভা পরিণত হয়েছিল দলমতনির্বিশেষে সপক্ষ বিপক্ষ সর্ব দল ও মমুনষের এক মাহসম্মিলনে। বাম, মধ্য ও দক্ষিণ কোন দলই প্রয়াত নেতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পিছিয়ে ছিল না। এ জাতীয় ঘটনা শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, ভারতেও এর আগে ঘটেছে বলে মনে পড়ে না-স্মরণকালের মধ্যে তো নয়ই।
সে সভায় প্রত্যেক দল থেকে নেতার পর নেতা উঠে যে ভাষায় প্রায়ত প্রমোদ দাশগুপ্তের স্মৃতির প্রতি আকুন্ঠ শ্রদ্ধা জানালেন, সে সবের সার কথা হলো- তাঁর মতো সর্বত্যাগী বিপ্লবী দেশপ্রেমিক, সুদক্ষ সংগঠক, দূরদর্শী নির্ভীক রাজনীতিক, সংবেদনশীল নিরহঙ্কার জননায়ক, শোষিতের একনিষ্ঠ বন্ধু, এবং শোষণমুক্ত নতুন সমাজগঠনের আদর্শে অবিচল নিবেদিতপ্রাণ নায়ক বিরল এবং তাঁর মৃত্যুতে বাম ও গণতান্ত্রিক ঐক্য-আন্দোলনের যে প্রচন্ড ক্ষতি হলো ও যে স্থান শূন্য হলো, তা সহজে পূরণ হবার নয়।
বন্ধু এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। প্রয়াত জননায়ক প্রমোদ দাশগুপ্ত যে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, সেটা হলো মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। এমনও হতে পারে যে, আমরা কেউ কেউ হয়তো তাঁর এই মতাদর্শে বিশ্বাসী নই বা তার সঙ্গে পুরোপুরি একমত নই। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। যাঁরা মহৎ, তাঁরা যে মতাদর্শেরই মানুষ হোন না কেন মহৎই থেকে যান এবং তাঁরা সর্বজনের নমস্য। শুধু দেখা দরকার, তাঁরা যে মতাদর্শে বিশ্বাসী, তা দেশের ও সমাজের অধিকাংশ মানুষের প্রকৃত মঙ্গল ও অগ্রগতির পক্ষে সহায়ক কিনা এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত কিনা।
উপরন্তু সবচেয়ে যা উল্লেখযোগ্য এবং যা থেকে আমরা নিজেরাই বিশেষভাবে লাভবান হতে পারি তা হলো-প্রমোদ দাশগুপ্তের মতো দুর্লভ ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের মানুষদের জীবনী পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, অতি সামান্য বা সাধারণ অবস্থা থেকে, একেবারে নিচু তলা থেকে একের পর এক ধাপ পার হয়ে তিনি যে উপরে উঠে এসেছেন, শেষ পর্যন্ত লাভ করেছেন ‘জনগণ-মন-অধিনায়ক’র বিরল সম্মান এবং নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দুস্তর বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে শ্রমজীবী জনসাধারণের বৃহত্তম অংশকে যে বামপন্থী রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও শিক্ষিত করে সুশৃঙ্খল সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন, তা কি করে সম্ভব হলো। তাঁকে তো কেউ নিচে থেকে উপরে টেনে তোলে নি, বা উপর থেকে তো কেউ তাঁকে দেশের মানুষের ঘাড়ে নেতা হিসাবে চাপিয়েও দেয় নি, কিংবা এ ধরনের শক্তিশালী সুবিশাল অদৃষ্পপূর্ব সংগঠনও তো আপনাআপনি গড়ে উঠতে পারে না, তাহলে কোথায় এ রহস্যের উৎস? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে প্রয়াত নেতার কার্যাবলী ও জীবনচর্যার মধ্যে যার ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাঁর সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
প্রমোদ দাসগুপ্তের জীবনী পর্যালোচনা করলে প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক বিপ্লবী কিশোরের ছবি- পরাদীন দেশের মুক্তিকামী এক অশান্ত কিশোর, অন্তরে জ্বলছে যাঁর দেশপ্রেমের অনির্বাণ বহ্নিশিখা। তারই তাড়নায় সেই কৈশোরেই শুরু হয় তাঁর দুর্গম বন্ধুর পথ-পরিক্রমা।
বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কু’য়োরপুর গ্রামে ১৯১০ সালের ১৩ই জুলাই প্রমোদ দাশগুপ্তের জন্ম। বাবা মতিলাল দাশগুপ্ত ছিলেন চিকিৎসক, সরকারী চাকুরে। তাঁর তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে প্রমোদ দাশগুপ্তই ছিলেন একজন আদর্শবাদী দেশপ্রেমিক ও সংস্কারমুক্ত জনসেবক। তাঁর বিশেষ প্রভাব পড়ে প্রমোদ দাশগুপ্তের শৈশব জীবনে এবং মনে উপ্ত হয় দেশপ্রেমের বীজ যা পরবর্তীকালের অনুকূল পরিবেশে পরিণত হয় সুবিশাল মহীরুহে। সেই শৈশবেই ঠাকুরদার কাছে তিনি শেখেন উদ্দীপনাময় সব স্বদেশী গান এবং তাঁর প্রেরণায় ও তত্ত্বাবধানে শুরু করেন নিয়মিত শরীরচর্চা ও সাঁতারকাটা, সেই সঙ্গে গান ও অভিনয়েও অংগ্রহণ করতে থাকেন নিয়মিত। তাছাড়া খেলাধুলোর দিকে, বিশেষতঃ ফুটবল খেলার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল প্রচন্ড। এমনিভাবে ঠাকুরদার নিবিড় স্নেহে ও সাহচে র্যে বালক প্রমোদ দাশগুপ্তের শরীর ও মন বিকাশিত হয়ে উঠতে থাকে ক্রমশঃই।
কু’য়োরপুর গ্রামের স্কুলেই তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু। কিন্তু বাবার বদলির চাকরি এবং মায়েরও রুগ্ন স্বাস্থ্য। তার ফলে নতুন জায়গায় এস সংসারের অনেক কাজই করতে হয় বালক প্রমোদ দাশগুুপ্তকে। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে ছোট-ছোট ভাইবোনদের তেল মাখিয়ে স্নান করিয়ে খােইয়ে-দাইয়ে তবে তিনি যেতে পারেন ইস্কুলে।
পরাধীন ভারতবর্ষে তখন ব্রিটিশ প্রভুত্বের বিষম দাপট। প্রমোদ দাশগুপ্তের বাল্যকালেই স্বাধীনতার জন্য দেশজুড়ে শুরু হয় প্রবল অসহযোগ আন্দোলন। বাড়িতেও পড়ে তার বিরাট প্রভাব। পরিবারের সবাই চারকা কাটেন। এমনকি সরকারী চাকুরে ডাঃ মতিলাল দাশগুপ্তও বাদ যান না, খন্দরও পরেন তিনি। স্কুলের ছাত্র প্রমোদ দাশগুপ্তও চরকা কাটেন আর যোগদান করতে থাকেন সভাসমিতিতে।
১৯২৫ সালে বাবা বরিশালে বদলি হলে তিনি বরিশাল জেলা স্কুলে ভর্তি হন। এই সময় বরিশালের জনপ্রিয় নেতা শরৎ ঘোষের বিশেষ প্রভাব পড়ে তাঁর উপর। শরৎ ঘোষের বক্তৃতা ও সহজসরল অনাড়ম্বর জীবন তাঁকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে। শৈশবে অনাবিল দেশপ্রেমের যে বীজ তাঁর মনে উপ্ত হয়েছিল, বাড়ির স্বদেশী আবহাওয়ায় ও দেশের বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক পরিবেশে তা অঙ্কুরিত হয়ে অতি দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। দেশকে স্বাধীন করার দুর্জয় আকাঙক্ষা তাঁকে কৈশরেই টেনে আনে রাজনৈতিক ঘূর্ণবর্তে।
বিপ্লববাদী বা বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত আন্দোলনের দিকে তিনি আকৃষ্ট হন এবং অনুশীলন পার্টির গুপ্ত কাজ কর্মের সঙ্গে যুক্ত হন ১৯২৪-২৫ সালে। পরবর্তীকালের অন্যতম প্রায়ত কমিউনিস্ট নেতা ও তৎকালীন অনুশীলন পার্টির নিরঞ্জন সেন ও আরও অনেক নেতার সংস্পর্শে আসেন তিনি সংগঠনের কাজের মধ্য দিয়ে। এমনি করে নতুন পথে কৈশোরে সেই যে শুরু হলো তাঁর জীবন-পরিক্রমা, তা থেকে তিনি আর পেছনে ফেরেন নি, শান্ত নিরুপদ্রব গার্হস্থ্য জীবনের প্রলোভন তাঁকে টলাতে পারেনি মানবমুক্তির দুশ্চর তপস্যা থেকে।
১৯২৮ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং বাবার নির্দেশমতো কলকাতায় এসে ভর্তি হন ক্যালকাটা টেক্নিক্যাল স্কুলে। ইতিমধ্যে অনুশীলন পার্টির তরুণ নেতা নিরঞ্জন সেন আগেই ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক বিনা বিচারে আটক রাখার কুখ্যাত কালো কানুনে গ্রেপ্তার হয়েছেন। বন্দীদশা থেকে তিনি মুক্তি পান এই ১৯০২৮ সালে এবং প্রমোদ দাশগুপ্ত ও অন্য কয়েকজন তরুণকে নিয়ে নতুন করে আবার অনুশীলন পার্টি ও বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে নামেন।
এর কিছুকাল পরেই ব্রিটিশ সরকার শুরু করলো মেছুয়াবাজার বোমার মামলা। নিরঞ্জন সেন সমেত আরো অনেক নেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলো। প্রমোদ দাশগুপ্ত কিন্তু পুলিসের চোখে ধুলো দিয়ে পার্টি-সংগঠনের কাজ করে চললেন গোপনে। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। ১৯৩১ সালের মাঝামাঝি বর্তমান বাংলাদেশের বগুড়ায় সাদা পোশাকের পুলিশ তাঁকে ঘিরে ফেলে গ্রেপ্তার করলো।
এবার শুরু হয় বিনা বিচারে আটক দীর্ঘ বন্দীজীবন। জেল থেকে জেলে, বন্দীশিবির থেকে বন্দীশিবিরে আটক, তারপর অন্তরীণ, এমনিভাবে কেটে যায় তাঁর জীবনের দীর্ঘ প্রায় সাত-সাতটা বছর। কিন্তু বৃথা কাটে নি।
গান্ধীবাদী রাজনীতি প্রমোদ দাশগুপ্তের জীবনে কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। কৈশোর ও তারুণ্যের দীর্ঘ পাঁচ-ছয় বছর কেটেছে বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের মধ্যে। আজ যৌবনের দোরগোড়ায় পৌছে পেছনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এই মতবাদের যৌক্তিকতা ও যথার্থ্য সম্পর্কে তাঁর মনে জাগে নানা সংশয়, গুরুতর সব প্রশ্ন। সন্ত্রাসমূলক বিপ্লববাদ বা ব্যক্তিগত বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে বৃটিশ আধিপত্রের অবসান ঘটানো কিভাবে সম্ভব? নির্বিচার শোষণ ও বঞ্চনার শিকার যে কৃষক, শ্রমিক তথা শ্রমজীবী জনসাধারণ, দেশের যারা শতকরা নব্বই-পঁচানব্বই জন, তাদের স্বাধীনতা কোথায়? তাদের মুক্তির কথা, তার জন্য নিদৃষ্ট কার্যকরী কর্মপন্থার হদিস তো কোথাও নেই, ইত্যাকার গুরুতর নানা প্রশ্নে যুবক প্রমোদ দাশগুপ্তের মন তখন অশান্ত তোলপাড়। পথ খোঁজেন তিনি।
জেলখানায় এই যখন মনের টালমাটাল অবস্থা, তখন ঘটলো মার্কসবাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। শুরু হলো পড়াশুনা। তিনি দেখলেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদই হলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ-কৃষক ও অন্যান্য শ্রমজীবী জনগণের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বারা কিভাবে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী তথা ধনতান্ত্রিক সামন্ততান্ত্রিক শোষণব্যবস্থা ধ্বংস করা যায় এবং সর্বপ্রকার শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব হয়, এ হলো তারই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও কর্মপন্থা বা কর্মকৌশল।
পড়তে পড়তে তার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে মানবসভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা উৎপাদন-পদ্ধতি অনুসারেই যে যুগে যুগে সমাজ গড়ে উঠেছে, মানবসভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাস যে শুধু ধারাবাহিক শ্রেণীসংগ্রামেরই ইতিহাস, সে বিষয়ে নিঃসংশয় হন তিনি। মার্কসীয় দর্শনের আলোয় তাঁর চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে মানবসমাজের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অগ্রগতির রূপরেখা। তাঁর মনে আর কোন সন্দেহ থাকে না যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সাধারণ দর্শন নয়, এ হলো বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বিপ্লবী অংশ শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দর্শন। এ দর্শনের দুটো অংশ - তত্ত্ব ও কর্মপন্থা। দুটোই সমান অপরিহারর্য। তত্ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা যেমন একান্ত দরকার, তেমনি তা দেশের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে কিভাবে প্রয়োগ করা যায় তার পন্থা বা পদ্ধতি বা কৌশলও পুরোপুরি আয়ত্ত করা সর্বতোভাবে প্রয়োজন। আর সেইভাবেই গড়ে তুলতে হয় শোষিত শ্রমিকশ্রেণীর ও অন্যান্য শ্রমজীবী জনগণের আন্দোলন, সংগ্রাম আর শ্রমিকশ্রেণীর নিজস্ব সংগঠন।
এ এক অত্যাশ্চর্য জ্ঞানের রাজ্য। এই জ্ঞানের আলোক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে তিনি দেখেন ও বিচার করেন সব কিছু এবং আপন অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাই করেন প্রতিটি বিষয়। মার্কসবাদ-লেনিনবাদ যে পুরোপুরি বিজ্ঞান, কোন আপ্তবাক্য নয়, না বুঝে মুখস্ত করার বস্তুও নয়, তা তিনি উপলব্দি করেন। এই মতবাদের তত্ত্ব ও কর্মপন্থাকে ঠিকমতো বোঝা ও আত্মস্থ করা এবং বাস্তব অবস্থার সঠিক বিচার-বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের মাধ্যমে তাকে কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করা ও রূপ দেওয়াই একজন কমিউনিস্টের কাজ। তাই সত্যিকার কমিউনিস্ট হওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। নিরন্তর পড়াশুনো, কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনার মধ্যে দিয়ে তাকে যেমন বিপ্লবের স্বার্থে কাজ করে যেতে হবে, তেমনি এই বিপ্লবী মতবাদের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্যও তাকে খর দৃষ্টি রাখতে হবে অতন্দ্র প্রহরীর মতো। উপরন্তু আদর্শ-নিষ্ঠায়, ত্যাগস্বীকারে, নিয়মশৃঙ্খলাপালনে ও স্বভাবচরিত্রে তাকে হতে হবে সবার আদর্শস্থানীয়। এমনিভাবে সেই যৌবনে জেলখানাতেই শুরু হয় প্রমোদ দাশগুপ্তের সাচ্চা কমিউনিস্ট হবার নিরলস সাধনা।
দীর্ঘ প্রায় সাত বছর পরে ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বৃটিশের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পান তিনি। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ বেআইনী। অতি ছোট পার্টি, সভ্যসংখ্যাও তেমন কিছু নয়। গোপনে প্রমোদ দাশগুপ্ত দেখা করেন ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্থপতি ও পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা প্রায়ত মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে এবং তাঁর নির্দেশে ডকের শ্রমিকদের আন্দোলন সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সেইসঙ্গে অবশ্য চলতে থাকে পড়াশোনা ও শরীরচর্চা আর খাঁটী কমিউনিস্ট হবার একাগ্র প্রয়াস। এ কাজ তিনি জীবনভোর আগাগোড়া চালিয়ে গেছেন, এবং তাঁর কর্মধারা ও জীবনচর্যা থেকে এটা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে, এ সাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টিই ছিল তাঁর সবকিছু, একমাত্র আকর্ষণ আর মার্কসবাদ-লেনিনবাদই ছিল চিরভাস্বর একমাত্র পথপ্রদর্শক।
১৯৩৮ সালের ১লা মে তিনি পার্টির সভ্যপদ লাভ করেন। এ সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কোন একটা বিশেষ দলের পার্টি ছিল না, ছিল দেশে স্বাধীনতাকামী সমস্ত দল ও ব্যক্তির সাধারণ রাজনৈতিক কাজের মঞ্চ। প্রমোদ দাশগুপ্ত তখন যেমন ডক শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেছেন, তেমনি কাজ করেছেন মধ্য কলকাতা কংগ্রেসেও। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তার অন্যতম কর্মকর্তা হয়ে ওঠেন।
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেধে গেল সাম্রাজ্যবাদী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ দেশে ভারতরক্ষা আইন জারী করলো ব্রিটিশ সরকার। সরোজ মুখোপাধ্যায় তখন কমিউনিস্ট পার্টির কলকাতা জেলা কমিটির সেক্রেটারী বা সম্পাদক। ১৯৪০ সালের গোড়ার দিকে তিনি আত্মগোপন করেন এবং গোপন কেন্দ্র থেকে পার্টির কাজ চালাতে থাকেন। এইসময় প্রমোদ দাশগুপ্তের ওপর এসে পড়ে নতুন দায়িত্ব। প্রকাশ্যে তিনি জেলা কমিটির কাজ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু বেশি দিন নয়। ১৯৪০ সালের মাঝামাঝি ভারতরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার হন তিনি। আবার শুরু হয় বন্দীজীবন।
এদিকে কিছুকাল পরেই বিশ্বযুদ্ধের মোড় হঠাৎ ঘুরে গেল। অক্ষশক্তির প্রধানতম নায়ক নাৎসী ডিক্টেটর হিটলারের জার্মানী আক্রমণ করে বসলো সেভিয়েত সমাজতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রকে। তার ফলে মিত্রশক্তির অন্যতম প্রধান শরিক হলো সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র। এই অবস্থায় ১৯৪২ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে প্রত্যাহৃত হয় ব্রিটিশ সরকারের নিষেধাজ্ঞা। অন্যান্য কমিউনিস্ট বন্দীদের সঙ্গে প্রমোদ দাশগুপ্ত মুক্তি পান বন্দীদশা থেকে।
তখন কমিউনিস্ট পার্টির সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘জনযুদ্ধ’ বের হচ্ছে। তার প্রকাশনা ও পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। দেশজুড়ে তখন তীব্র কমিউনিস্টবিরোধী হাওয়া বইছে। তারই মধ্যে পত্রিকার কর্মাধ্যক্ষ বা ম্যানেজার হিসাবে তিনি সবিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ‘জনযুদ্ধ’ - এর প্রচার-সংখ্যা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়ে সতেরো হাজারে গিয়ে দাঁড়ায়।
১৯৪৫ সালের শেষে প্রকাশিত হয় দৈনিক ‘স্বাধীনতা’। তারও ম্যানেজার বা কর্মাধ্যক্ষ হিসাবে প্রমোদ দাশগুপ্তের সাংগঠনিক ক্ষমতার সবিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়। কিছুকাল পরে ডেকার্স লেনে প্রতিষ্ঠিত হয় পার্টির নিজস্ব প্রেস। এই প্রেস গড়ার ও সংগঠিত করার পেছনে মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে প্রমোদ দাশগুপ্তের অবদান ছিল অসাধারণ। তাঁর তখন দেখার মোত বলিষ্ঠ নিটোলা স্বাস্থ্য, মনে অফুরন্ত কর্মোদ্দীপনা। স্নান-খাওয়া ও ঘুমানোর একান্ত প্রয়োজনীয় সময়টুকু ছাড়া পার্টির দায়িত্বপালন ও মঙ্গলসাধনই হলো তাঁর সর্বক্ষণের ধ্যানজ্ঞানস্বপ্ন।
১৯৪৭ সাল এল। দেশ-বিভাগের মধ্যে দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান দুটো দেশ জন্ম নিল ও স্বাধীনতা লাভ করলো। সেই বছরই কমিউনিস্ট পার্টির বাংলা প্রাদেশিক সম্মেলন হয় এবং নতুন প্রাদেশিক কমিটির অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হন প্রমোদ দাশগুপ্ত।
এর কিছুদিন পরেই ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে দেখা দিল ঘোরতর দুর্দিন। ১৯৪৮ সালের গোড়ার দিকে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস। সে কংগ্রেসে পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বি.টি. রণদিভে। উপরন্তু সেখানে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়, তা ছিল যেমন বিপজ্জনক তেমনি ক্ষতিকর। তার মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিতে অচিরে মাথা ছাড়া দেয় বামপন্থী সঙ্কীর্ণতাবাদী হটকারী লাইন।
এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, দেশে দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে যুগে যুগে বারবার দুটো বিষাক্ত বিপজ্জনক ধারা আত্মপ্রকাশ করেছে। তার একটি হলো শোধনবাদী ধারা বা সংশোধনবাদ, অন্যটি হলো অতি-বামপন্থী সঙ্কীর্ণতাবাদী হটকারী ধারা বা পথ। উভয়েরই কাজ হলো মার্কসবাদ-লেনিবাদকে বিকৃত করা, তার বিজ্ঞানভিত্তিক বৈপ্লবিক সত্তাকে নিষ্প্রভ ও নষ্ট করা এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনকে হীনবল ও সম্ভব হলে ধ্বংস করে ফেলা। সারা বিশ্ব জুড়ে তাই কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বিশুদ্ধতা রক্ষার সংগ্রাম চলে আসছে যুগ যুগ ধরে এবং আজও চলছে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়।
যাই হোক, হটকারী লাইন চালু হতেই দেখা দিল তার বিষময় ফল। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় পরিচালিত কংগ্রেস সরকার পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করলো। শুরু হলো লাঠিচার্জ, গুলি, ধরাপাকড়। পার্টির সমস্ত পত্র-পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ হলো, অফিসে ও প্রেসে সরকারী তালা ঝুললো। পার্টির নেতাদের নামে জারী হলো গ্রেপ্তারী পরোয়ানা। অনেক পার্টি নেতা আত্মগোপন করলেন। অদ্ভুত কৌশলে পুলিশ-বেষ্টনী ভেদ করে আত্মগোপন করলেন প্রমোদ দাসগুপ্ত এবং গোপন কেন্দ্র থেকে বের করতে লাগলেন সাপ্তাহিক ‘স্বাধীনতা’।
কিছুকাল পর থেকেই কিন্তু এই হটকারী লাইনের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে সন্দেহ ও সংশয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সালে তা আন্তঃপার্টি বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। শুরু হলো তুমুল বিতর্কের ঝড়। মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দর্শনের বিশুদ্ধতা রক্ষায় এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে অতি-বামপন্থী হটকারী লাইনের বিরুদ্ধে সেই আন্তঃপার্টি সংগ্রামে প্রমোদ দাশগুপ্তের তৎকালীন ভূমিকা ও অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। কিন্তু এই সংগ্রাম-পরিচালনাকালেই ১৯৫০ সালে গ্রেপ্তার হলেন তিনি। ১৯৫১ সালে ছাড়া পেয়ে আবার ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকা পুনঃপ্রকাশের যখন ব্যবস্থা করছেন, থখন অল্প দিনের মধ্যেই আবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। এবার মুক্তিলাভ করতে সেই ১৯৫২ সাল।
১৯৫৩ সালে কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে রাজ্য কমিটিতে এবং সেক্রেটারিয়েট বা সম্পাদকমন্ডলীতে নির্বাচিত হন প্রমোদ দাশগুপ্ত। এবার পার্টির জীবনে শুরু হয় তাঁর নতুন ভূমিকা। পার্টির সংগঠক রূপে, তাকে শক্তিশালী বড় পার্টিতে পরিণত করার কাজে নামলেন তিনি। এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে তাঁর এই ভূমিকা যে কত বড় আশীর্বাদ হিসাবে এসেছিল, তা আজ সবাই প্রত্যক্ষ করছে। পশ্চিমবাংলায় আজ আমরা যে সুবিশাল সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি বা সংক্ষেপে সি.পি.আই. (এম)- কে দেখতে পাচ্ছি, তা তাঁর এই ভুমিকারই ফল।
রাজ্য কমিটির সম্পাদকমন্ডলীতে নির্বাচিত হবার পর থেকেই তিনি জেলায় জেলায় সফর শুরু করেন। ভগ্ন স্বাস্থ্যের দরুণ অশক্ত হয়ে না পড়া পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল ধরে এ কাজ তিনি নিয়মিত বারবার করে গেছেন একান্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। জেলার পার্টি-কর্মী, দরদী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর মেলামেশা ছিলো সহজ, সরল ও আন্তরিকতাপূর্ণ। কথায় কথায় মার্কসবাদী বুলি কপচানো এবং পান্ডিত্য দেখিয়ে অন্যদের তাক লাগিয়ে দেবার ছলাকলা ছিল প্রমোদ দাশগুপ্তের একেবারেই স্বভাববিরুদ্ধ। ওসব কলাকৌশল তিনি জানতেনও না, বুঝতেনও না। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কিভাবে বাস্তব অবস্থার বিচার-বিশ্লেষণ করে নীতি ও কর্মপন্থা স্থির করতে হয় এবং এগিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে হয়, তারই তত্ত্বগত ও প্রয়োগগত শিক্ষা তিনি লাভ করেছিলেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদ থেকে। এ আদর্শ তাই তাঁর কাছে আপ্তবাক্য ছিল না, ছিল সাচ্চা কমিউনিস্ট হিসাবে সুষ্ঠুভাবে কাজ করার পথ-নির্দেশক।
বারবার এইসব সফরের মধ্য দিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে তাঁর স্থাপিত হয় অতি গভীর নাড়ীর যোগ। দেশের বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে তিনি ওয়াকিবহাল থাকতেন সবসময়। তার ফলে পার্টির ও তার গণ-সংগঠনগুলির কাজকর্মের পরিচালনায় এবং প্রয়োজনমতো সেবসে কৌশলগত পরিবর্তন-সাধনে বারবার পাওয়া গেছে তার অসাধারণ দক্ষতার পরিচয়। মূল আদর্শ ও নীতির সঙ্গে তিনি কখনই আপস করেন নি, করতে পারতেনও না। কিন্তু অবস্থানুসারে নমনীয় কৌশল-গ্রহণে তাঁর অদ্ভুত দক্ষতা বিরুদ্ধপক্ষীয়দেরও বিপাকে ফেলেছে বারবার। পার্টি-কর্মী ও শ্রমজীবী জনগণের সঙ্গে গভীর যোগাযোগই ছিল তাঁর এই ক্ষমতার অন্যতম মূল উৎস।
১৯৬০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পরিষদের সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার পর থেকে তাঁরই নির্দেশে ও নেতৃত্বে কৃষকদের জমি-সমস্যা ও অন্যান্য দাবি-দাওয়া নিয়ে প্রচন্ড আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয় সারা পশ্চিম-বাংলার গ্রামাঞ্চল জুড়ে। তার ফলে কৃষক সভা আজ প্রচন্ড শক্তিশালী, ৪৬ লক্ষকেও ছাড়িয়ে গেছে তার সভ্যসংখ্যা।
ইতিমধ্যে ১৯৫৪ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে আবার নতুন এক বিপদ দেখা দিয়েছে। এবার বামপন্থী হটকারী ধারা নয়, সংশোধনবাদী ধারা পার্টিতে প্রাধান্য বিস্তার করছে। যেসব কমিউনিস্ট নেতা তখন সংশোধনবাদবিরোধী লড়াইয়ের পুরোভাগে, প্রমোদ দাশগুপ্ত তাঁদের অন্যতম। .
১৯৬০ সাল নাগাদ ভারত-চীন সীমান্ত-বিরোধ নিয়ে পার্টির অভ্যন্তরে মতপার্থক্য গুরুতর আকার ধারণ করে। সংশোধনবাদী নেতৃত্ব তখন উগ্র জাতীয়তাবাদীরুপে চীনের বিরুদ্ধে কংগ্রেস সরকারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে বদ্ধপরিকর। আর সংশোধনবাবিরোধী অংশ চীনের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধের বিরোধী। তাঁরা চান, দু দেশের মধ্যে আপস-আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত-বিরোধের মীমাংসা হোক। এই অবস্থায় ১৯৬২ সালে ভারত ও চীনের মধ্যে সশস্ত্র সীমান্ত-সংঘর্ষ শুরু হতেই পার্টির সংশোধনবাদবিরোধী অংশের ওপর নেমে এল নেহরু সরকারের আক্রমণ। পশ্চিমবঙ্গে প্রমোদ দাশগুপ্ত সমেত প্রথম সারির প্রায় সব পার্টি নেতা ও শত শত কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলো। পার্টির কাজ অবশ্য চলতে লাগলো, তবে গোপনে। সরকারের এই আক্রমণ আসবে, এটা আগে থেকেই আন্দাজ করে নিয়ে দুরদর্শী বিপ্লবী নায়ক প্রমোদ দাশগুপ্ত ইতিমধ্যে পার্টির গোপন সংগঠন তৈরি করে ফেলেছেন।
১৯৬৩ সালের শেষ থেকে ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি নাগাদ অন্যান্য পার্টি-নেতা ও কর্মীদের সঙ্গে প্রমোদ দাশগুপ্তও ছাড়া পেলেন জেল থেকে। এর পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে বিরোধ চরমে উঠলো। পার্টির সর্বোচ্চ সংগঠন জাতীয় পরিষদে তখন সংশোধনবাদীদের প্রাধান্য। তাঁদের মার্কসবাদ-লেনিনবাদবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জাতীয় পরিষদের সভায় যে ৩২ জন কমিউনিস্ট নেতা বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন, প্রমোদ দাশগুপ্ত তাঁদের অন্যতম। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের জোরে তাঁদের সাস্পেন্ড্ করা হলো। এর পর ১৯৬৪ সালের শেষ দিকে সংশোধনবাদবিরোধী অংশের উদ্যোগে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলো কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম কংগ্রেস। কিন্তু তার আগেই প্রমোদ দাশগুপ্ত সমেত পশ্চিম-বঙ্গের প্রধান সব পার্টি নেতাদের অনেককেই আবার বিনা বিচারে আটক করা হলো। এই কংগ্রেসে পার্টির সর্বোচ্চ পরিচালক সংগঠন পলিটবরেতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত হলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত এবং জ্যোতি বসু। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটিরও সম্পাদক রইলেন প্রামোদ দাশগুপ্ত।
১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি বন্দীদশা থেকে সর্বশেষ মুক্তিপান মুজফ্ফর আহ্মদ এবং প্রমোদ দাশগুপ্ত। বিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সংশোধনবাদবিরোধী অংশের নাম তখন হয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সংক্ষেপে সি.পি.আই. (এম)।
১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭ সাল, এই দশটা বছর পশ্চিমবঙ্গে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির জীবনে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দশক- যেমন বৈচিত্রময়, তেমনি ঘটনাবহুল। এই সময়েই পাওয়া যায় প্রমোদ দাশগুপ্তের সাংগঠনিক প্রতিভা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতার সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয়। শহরে গ্রামে গঞ্জে কলকারখানায় অফিসআদালতে ও খেতখামারে েএই সময় অতি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে সি. পি. আই. (এম) - এর প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা। একদিকে যেমন সে লাভ করে জনসাধারণের অকৃত্রিম সমর্থন ও ভালবাসা, অন্যদিকে তেমনি শত্রুপক্ষের হিংস্র ভয়াল আক্রমণে তার পথ হয়ে ওঠে কঠিন, দুর্গম ও বন্ধুর।
এ দশকেরই গোড়ার দিকে পশ্চিমবঙ্গে প্রথম গঠিত হয় অকংগ্রেসী সরকার - প্রথম ও দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। সি. পি. আই. (এম) তাতে যোগ দেয়। কিন্তু দুবারই সে সরকারের পতন ঘটে। তারপর ১৯৭১ সালের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সি. পি. আই. (এম)। কিন্তু ১৯৭২ সালে এক নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে কায়েম হয় কংগ্রেসী সরকার। ইতিমধ্যে নকশালপন্থীদের নৃশংস আক্রমণ শুরু হয়েছে সি. পি. আই. (এম) এর ওপর। অন্য দিকে চলছে হিংস্র কংগ্রেসী হামলা। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রের ইন্দিরা সরকার দেশে জারী করে জরুরী অবস্থা।
এই গোটা দশক ধরে সুদিনে, দুর্দিনে, সম্পদে বিপদে সুস্থির নিষ্কম্প হাতে পার্টির হাল ধরে থাকেন যে অকুতোভয় সুদক্ষ কান্ডারী, তিনি হলেন প্রমোদ দাশগুপ্ত। জনসাধারণের ওপর অটল আস্থা রেখে স্থির লক্ষ্যে তিনি পরিচালনা করেন পার্টিকে। তাঁর নির্ভুল নেতৃত্বে ইস্পাতের মতো দৃঢ়তা নিয়ে অদ্ভুত বীরত্বের সঙ্গে সমস্ত আক্রমণ প্রতিরোধ করে সি.পি.আই (এম) অন্য দিকে শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে বজায় রেখে চলে ঘনিষ্ঠ নিবিড় সম্পর্ক।
তারপর শেষ পর্যন্ত ১৯৭৭ সালে এল পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। সি.পি.আই. (এম) এর নেতৃত্বে বামফ্রন্ট লাভ করলো সুবিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। একা সি.পি.আই. (এম)ই হলো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল। এই অভূতপূর্ব সাফল্যের পেছনেও যে রয়েছে প্রমোদ দাশগুপ্তের অসামান্য নেতৃত্ব, তা বোধহয় বলার দরকার পড়ে না। ১৯৮২ সালের নির্বাচনেও সেই একই ইতিহাস। বামফ্রন্ট গঠনে এবং চেয়ারম্যান হিসাবে তার পরিচালনাতেও তিনি যে রাজনৈতিক সাংগঠনিক ক্ষুরধার বুদ্ধি ও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে গেছেন, তা কখনই ভুলবার নয়।
সুদীর্ঘ ৫৫/৫৬ বছরের কর্মময় সার্থক রাজনৈতিক জীবনের শেষে ৭৩ বছর বয়সে এই সর্বত্যাগী অকৃতদার বিপ্লবী জননায়কের তিরোধান ঘটলো। পেছনে রেখে গেলেন তিনি এক বিপুল কীর্তি-ভান্ডার।
প্রমোদ দাশগুপ্ত, এই নামটি কি পশ্চিমবাংলার শ্রমজীবী মানুষ কোনদিন ভুলতে পারবে? না, অবিস্মরনীয় এ নাম-অক্ষয় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে তা ইতিহাসে আর তাঁর সহকর্মী, সহযোদ্ধা, পার্টিকর্মী, দরদী এবং শ্রমজীবী মানুষের অন্তরের মনিকোঠায়। তাঁর জীবন ও আদর্শ অনির্বাণ আলোকবার্তিকার মতো তাদের পথ দেখাবে প্রতিদিনের কর্মধারায় এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংগ্রামে।

0 মন্তব্যসমূহ