রুদ্রনারায়নের বাগানবাড়ি
এক
সময়ে সময়ে নাকি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ে। আমারও একদিন ঐ দশা হয়েছিল। মাছ ধরতে গিয়ে ডাঙায় টেনে তুলেছিলুম- না, থাক। ঘটনাটা গোড়া থেকেই বলা ভালো।
আমার কাছে মাছ ধরতে যাওয়া হচ্ছে, একটা নেশার মত। মাছ পেলে তো কথাই নেই, কিন্তু মাছ না পেলেও আমার আনন্দ ম্লান হয় না। সারা বেলা মেঘমেদুর আকাশের তলায়, নীল সরোবরের পশে, গাছের সবুজে সবুজে আলোছায়ার ঝিলিমিলি দেখতে দেখতে বাতাসের গান শুনতে আমার বড় মিষ্টি লাগে। তাই কোথাও কোন পুকুরের খবর পেলেই ছিপ কাঁধে করে ছুটি।
সন্তোষ খবর দিলে, তাদের দেশে এক পুকুর আছে, যার জলে পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যে ছিপ পড়েনি এবং মাছ হাজার হাজার!
আমি বললুম “এমন আশ্চর্য পুকুরের কথা তো কখনো শুনিনি। পুকুরের অধিকারী গোঁড়া বৈষ্ণব বুঝি?”
সন্তোষ বললে, “ঠিক উল্টো। তাঁরা গোঁড়া শাক্ত।”
-“তবে ছিপের এমন অপমান কেন?”
-“মুর্শিদাবাদের সাগর-দিঘির নাম শুনেছ তো?”
-“রাজা মহীপালের সাগর-দিঘি?”
-“হ্যাঁ। একমাইল ব্যাপী বিরাট সেই দিঘি। তার বয়স শত শত বৎসর, তাতে মাছ আছে হয়তো লক্ষ লক্ষ, কিন্তু স্থানীয় লোকরা ভয়ে সেখানে মাছ ধরে না, এমন কি তার জল পর্যন্ত ব্যবহার করতে চায় না। অথচ কি যে সেই ভয়, কেউ তা জানে না! বিভীষিকা যেখানে অজ্ঞাত, মানুষের আতঙ্ক সেখানেই হয় বেশী।”
-“তোমাদের দেশের পুকুরটাও ঐ জাতীয় নাকি?”
সন্তোষ সোজাসুজি জবাব না দিয়ে বললে, “আমাদের গ্রামের বর্তমান জমিদারের পিতামহের নাম ছিল রাজা রুদ্রনারায়ণ। লোকের বসতি থেকে অনেক দূরে তাঁর একখানি বাগানবাড়ি ছিল। তিনি প্রায়ই সেখানে বাস করতেন। পঞ্চাশ বছর আগে সেই বাগানবাড়ির একটি ঘরে হঠাৎ একদিন তাঁর মুণ্ডহীন মৃতদেহ পাওয়া যায়। আসল ব্যাপারটা প্রকাশ পায়নি, তবে কেউ যে তাঁকে কুন করে মুণ্ড কেটে নিয়ে পালিয়েছিল, এতদিন পরেও এইটুকু আমরা অনুমান করতে পারি।”
সন্তোষ এই পর্যন্ত বলে থামলে। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলুম, রাজা রুদ্রনারায়ণের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পুকুরের রুই-কাতলার সম্পর্ক কি?
সন্তোষ আবার মুখ খুললে। বললে, “সেই সময় থেকেই ও-বাগানে কেউ বাস করে না, তার পুকুরে কেউ মাছও ধরে না। তবে বাগান-সংলগ্ন দুই মন্দিরে জমিদরের ঠাকুর আছেন, আজও তাঁদের পূজা হয়, আর সেইজন্যেই বাগান পুকুর আর বাড়িখানি সংস্কার অভাবে নষ্ট হয়ে যায়নি। কিন্তু মন্দিরের পূজারীও সন্ধ্যাপূজার পর সেখানে আর থাকেন না, তাড়াতাড়ি গ্রামে ফিরে - অর্থাৎ পালিয়ে আসেন।”
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “ওখানে অপদেবতার ভয়-টয় আছে নাকি?”
-“তাও ঠিক জানি না। এ-বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে জমিদারের নিষেধ আছে। গ্রামের লোক নানারকম কাণাঘুষো করে বটে - আমি সে - সবে কানও পতি না,ম বিশ্বাসও করি না। তবে শুনেছি, সেখানে এমন কোন মূর্তিমান আতঙ্ক আছে, যান নাম মুখেও উচ্চারণ করা উচিত নয়। ...যত সব বাজে কথা! - আর এই - সব কথা নিয়েই পল্লীগ্রামের আড্ডাগুলি ভর্সন্ধেবেলায় রীতিমত জ’মে ওঠে। ভূত-পেত্নী, দৈত্য দানব! রূপকথার নায়ক-নাইকা! ভূত-পেত্নী বেঁচে ছিল মান্ধাতার যুগে, একেলে মানুষ মরবার পর আর বাঁচবার সুযোগ পায় না।”
আমারও ঐ মত। মরবার পর যে দেহ লুপ্ত হয়ে যায়, আত্মা যদি আবার সেই দেহ ধারণ করতে পারত, তাহ’লে এই প্রাচীনা পৃথিবীতে ভূত-পেত্নীর দল এত ভারি হয়ে উঠতো যে, মানুষদের আর মাটিতে পা ফেলবার ঠাঁই থাকতো না।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “রুদ্রনারায়ণের বাগানবাড়িতে মাছ ধরাও নিষেধ নাকি?”
- “না। এখন যিনি জমিদার তিনি আমার বন্ধু। তাঁর কাছ থেকে অনায়াসেই অনুমাতি আনতে পারি। ইচ্ছে থাকলে গ্রামের আরো অনেকেও মাছ ধরার অনুমতি পেতে পারত, কিন্তু কারুর সে ইচ্ছে নেই। সকলেরই বিশ্বাস, ও-বাগানের পুকুরে মাছ ধরতে যাওয়া নিরাপদ নয়।”
আমি উৎসাহিত হয়ে বললুম, “সন্তোষ, তুমি তোমার জমিদার বন্ধুর কাছ থেকে ছাড়পত্র জোগাড় কর। আমি খালি ওখানে মাছই ধরব না, দিন-তিনেক ঐ বাগানবাড়িতে নির্জন-বাসও ক’রে আসব।”
-‘‘নির্জন-বাস! কেন?”
-“প্রথমত, আমি তোমাদের গ্রামের কুসংস্কার ভেঙে দিতে চাই। দ্বিতীয়ত, রহস্যময় বাড়ি, ভৌতিক আবহ এ-সব আমি ভালোবাসি। তৃতীয়ত, শহুরে জনতার তর্জন-গর্জন ভারি একঘেয়ে হয়ে উঠেছে, বিজন স্তব্ধতার ভিতরে মনকে খানিকটা ছুটি দেবার সাদ হচ্ছে।”
সন্তোষ বললে, “বহুৎ আচ্ছা! তাহ’লে আমিও তোমার সঙ্গী হতে চাই।”
দুই
রাজা রুদ্রনারায়ণ নিশ্চয়ই কবিদের মতন নির্জনতা প্রিয় ছিলেন। সাধারণ ধনীরা এমন জায়গায় বাগানবাড়ি তৈরি করেন না।
বাগানের কোনদিকে পাঁচ মাইলের মধ্যে লোকালয় নেই। চারিধারে ধূ-ধূ করছে মাঠ আর মাঠ আর জলাভুমি।
কিন্তু বাগানখানি যে একসময়ে চমৎকার ছিল, বহুকাল পরে আজও তা বোঝা যায়। পুকুরের জলও এখনো পরিষ্কার আছে। তার কারণ শুনলুম, মন্দিরবাসী দুই পাষাণ-দেবতার দয়া। পুকুরের জল তাঁদের নিত্যপূজার কাজে লাগে, তাই নিয়মিতভাবে তার পঙ্কোদ্ধার হয়।
বাড়িখানিও শুনলুম রুদ্রনারায়ণের যুগে যেমন ছিল প্রায় সেইভাবেই আছে। বর্তমান জমিদার তাঁর পিতামহের প্রিয় প্রমোদ-ভবনটিকে একেবারে হতশ্রী হতে দেননি। মাঝে মাঝে তার ভিতরে-বাইরে যে মার্জনা কার্য হয়েছে, এটাও আন্দাজ করতে পারলুম। মানুষ হচ্ছে গৃহের আত্মা। পরিত্যাক্ত বাড়ি দেখলেই আমার মনে হয়, আত্মাহীন। এ বাড়িখানাকে তেমন বোধ হল না। মনে হল এখনো তার প্রত্যেকটি ইপ প্রাণের হিল্লোলে জীবন্ত। যেন এখনো তার ঘরে ঘরে বাজছে নীরব চরণধ্বনি!
সন্তোষ মাথা নেড়ে বললে, “অসম্ভব। ঐ ঘরেই রাজা রুদ্র নারায়নের মুণ্ডহীন দেহ পাওয়া গিয়েছিল। ও-ঘর তালা বদ্ধ, কারুর প্রবেশ-অধিকার নেই।”
-“বেশ, তাহলে ওর পাশের ঘর। ওখানা পেলেও দুঃখিত হব না।”
বাগানের পাশের মন্দিরে উঠেছে সন্ধ্যারাতির শঙ্খধ্বনি। তারপরেই এক মুহূর্তের ভিতরে যেন ঘুমিয়ে পড় চতুর্দিক। দূরের মাঠ থেকে কোন গৃহগামী গাভীর হাম্বাধ্বনি বা কৃষক কি রাখালের একটা কন্ঠস্বর পর্যন্ত শোনা গেল না। এ জায়গাটা যেন মানুষের পৃথিবীর বাইরে। নির্জনতাকে কোনদিন এমন স্পষ্টভাবে অনুভব করার সুযোগ পাইনি।
স্তব্ধতাকেও মানস-চক্ষে দেখলুম ফ্রেমে-আঁটা ছবির মত। মাঝখানে রয়েছে যেন মৌনতার রেখা লেখা - আর তারই চারিদিক ঘিরে শব্দময় অদৃশ্য ফ্রেমের মতন পাখিদের সন্ধ্যা-কাকলি, তরুকুঞ্জের পত্রমর্মর, বাতাসের দীর্ঘশ্বাস, ঝিল্লীদের ঐকতান!........সুন্দর!
গাড়ি-বারান্দার উপরে একলা দাঁড়িয়ে আছি। সন্তোষ গিয়েছে রাত্রের-নিদ্রার বন্দোবস্ত করতে।
মন্দিরের ভিতর থেকে তিনজন লোক বেরিয়ে এল। একজনকে দেখেই বুঝলুম পূজারী।
তারা হন্ হন্ করে চলে যাচ্ছিল, হঠাৎ আমাকে দেখেই গাড়ি-বারান্দার সামনে থম্কে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের চোখ-মুখ বিস্ময়-চকিত।
তাদের মনের ভাব বুঝে মৃদু হেসে বললুম, “মশাইরা অবাক হয়ে কি দেখছেন?”
পূজারী বললে, “আপনি কে?”
-“জমিদারবাবুর অতিথি।”
পূজারী দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে ত্রস্ত স্বরে বললে, “অতিথি! এই বাড়িতে!”
-“সেইরকমই তো মনে হচ্ছে!”
পূজারী আর কিছু বললে না। তারা তিনজনেই একপার পরস্পরের সঙ্গে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে দ্রুতপদে বাগানের সীমানা পেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
লোকগুলোর সন্দেহজনক কথা ও ভাবভঙ্গী নিয়ে হয়তো মনে মনে খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করতুম, কিন্তু সে-সময় আর পেলুম না। কারণ সুদূরে একটা তালবনের মাথার উপরে আকাশ তখন পরিয়ে দিচ্ছিল চাঁদের মণিমুকুট। সে গৌরবময় দৃশ্য আমাকে অভিভূত করে দিল।
তিন
গ্রামের কোন চাকর বা পাচক আমাদের সঙ্গে এখানে রাত্রিবাস করতে রাজী হয়নি। কাজেই সন্তোষই নিজের হাতে রান্নার আয়োজন করলে। এদিকে আমার বিদ্যা প্রথম ভাগ পর্যন্ত পৌঁছোয় না। আমি চেষ্টা করলে কেবল একটি জিনিস ভাল রাঁধতে পারি, ভাত। তবে হাঁড়ি নামিয়ে ফেন গালতে পারি না।
আমার যে ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলুম সেখানে ছিল একখানা সেকেলে পালঙ্ক, দুখানা কাঠের কেদারা, দুখানা টুল, দেয়ালে টাঙানো দুখানা মস্ত মস্ত আরশি, একটা দেরাজ-ওয়ালা আলনা ও কারুকার্য করা প্রকাণ্ড আলমারি। প্রত্যেক আসবাবাই ময়লা ও জীর্ণ। দেওয়ালে খানকয়েক পৌরাণিক ছবি ঝোলানো রয়েছে-সবগুলোই সেকালের বিখ্যাত চোরবাগান আর্ট-স্টুডিয়োর লিথোগ্রাফ।
চেয়ারের উপর ব’সে ব’সে সন্তোষের সঙ্গে আগামী কল্যকার মৎস্য শিকার নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। জলে মাছেদের অবিরাম লাফালাফি দেখেই বুঝেছি, এ পুষ্করিনী হচ্ছে ছিপধারীদের স্বপ্নস্বর্গ। বঁড়শির সঙ্গে সাংঘাতিক পরিচয় হয়েছে, এখানে এমন ঘাগী মাছের অভাব। ফ্যালো টোপ, তোলো মাছ, - কালকের ব্যাপার যে এই হবে, এ সম্বন্ধে আমার একটুও সন্দেহ নেই!
মনের আনন্দে এমনি সব আলোচনা চলছে, এমন সময়ে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সন্তোষ ব’লে উঠল, “রাত সাড়ে-বারোটা বেজে দু-মিনিট”
বললুম, “তাই নাকি? তাহ’লে নিদ্রাদেবীর আরাধনা করবার আগে আর একবার আকাশের চাঁদমুখ দেখে আসি।”
ওঠবার উপক্রম করছি, হঠাৎ পাশের ঘরে হ’ল অভাবিত শব্দ।....মেঝের উপর দিয়ে হড়্ হড়্ ক’রে কে যেন একখানা ভারী চেয়ার টেনে ও-ঘরের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত নিয়ে গেল। ও-ঘর মানে, রাজা রুদ্রনারায়ণের তালাবন্ধ ঘর। যার মধ্যে কারুর ঢুকবার হুকুম নেই।
সন্তোষ একলাফে দাঁড়িয়ে উঠল।
আমি বললুম, “তুমি বললে এ-বাড়িতে আর কেউ থাকে না। তবে ও-ঘরে অমন সশব্দে চেয়ার টানলে কে?”
হতভম্ব সন্তোষ কোন জবাব দেবার আগেই বাইরে কোথায় দড়াম্ করে একটা দরজা খোলার আওয়াজ হল! আধ মিনিট পরেই শোনা গেল, সিঁড়ির উপর দিয়ে কে যেন দুম-দুম করে অত্যন্ত ভারী পা ফেলে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে।
শব্দ খুব উচ্চ ও পাগুলো ভারী বটে, কিন্তু মনে হল, যে নেমে গেল সে মাতাল আর অন্ধ। কারণ আওয়াজ শুনলেই বোঝা যায়, সে পা ফেলছে দ্বিধাভরে ও বিশৃঙ্খলভাবে।
সন্তোষ বললে, “খালি-বাড়ি পেয়ে নিশ্চয়ই এখানে কোন বদমাইশ এসে বাসা বেঁধেছে। চল, দেখে আসি।”
এর পরে সমস্ত ঘটনা ঘটল ঠিক বায়োস্কোপের ছবির মতই দ্রুত। ঘরের কোণ থেকে আমার মোটা লাঠিগাছা তুলে নিয়ে সন্তোষের সঙ্গে আমি তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লুম। নিচে নেমে গিয়ে দেখি, বাড়ির সদর দরজা খোলা। অথচ এ-দরজা আমি আজ নিজের হাতেই বন্ধ করে তবে উপরে গিয়েছি।
কিন্তু বাগানের বেরিয়ে দেখি, কেউ কোথাও নেই। কাছাকাছি এমন কোন ঝোপঝাপও দেখলুম না, যার ভিতরে বা আড়ালে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চারিদিক ধব্-ধব্ করছে, ঘাস-বিছানায় একটা পাখি বা বিড়াল পর্যন্ত থাকলেও নজর এড়াতে পারবে না। তবে বাড়ির উপর থেকে এইমাত্র যে সশব্দে নেমে এসেছে, এর মধ্যে সে কোথায় গিয়ে গা-ঢাকা দিলে?
সবিস্ময়ে এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে নজর পড়ল পুকুরের দিকে। জীর্ণ ঘাট থেকে হাত-কয়েক তফাতে জলের উপর দেখলুম একটা অস্বাভাবিক চাঞ্চল্য! জল যেন ছট্ফট্ করে চারিধারে ছুঁড়ে ফেলছে ছিন্নভিন্ন চাঁদের কিরণ।
কোন মস্ত মাছও ঘাই মেরে জল অমন তোলপাড় করে তুলতে পারে না! পুকুরের বুকে ক্রমেই বৃহত্তর হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে জ্যোৎস্নামাখা জলচক্রের পর জলচক্র!
সন্তোষও দেখতে পেলে। দুজনেই ছুটে ভাঙা ঘাটের উপরে গিয়ে দাঁড়ালুম। প্রথমটা আর কিছুই দেখতে পেলুম না। তারপর আচম্বিতে ভেসে উঠল মানুষের দুখানা হাত। যেন কোন জলমগ্ন লোক তলিয়ে যাবার আগে অসহায়ভাবে দুই হাত উপরে তুলে প্রাণ বাঁচাবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে!
দ্রুতপদে ঘাট দিয়ে নেমে গেলুম জলের ভিতরে। ক্রমে আমার বুকের উপর জল উঠল। আমি সাঁতার জানি না, আমার পক্ষে এর বেশি এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব।
ব্যাকুল হাত দুখানা জেগে আছে তখনো জলের উপরে। যেন তারা কোন অবলম্বন খুঁজছে।
হাত দুখানা হঠাৎ একবার অদৃশ্য হল। ভাবলুম, লোকটা বোধ হয় একেবারেই তলিয়ে গেল।
কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ দেখি হাত দুখানা একেবারে আমার কাছে এসে ভেসে উঠেছে! দুই হাতের দুই মুঠো একবার খুলছে, একবার বন্ধ হচ্ছে - যেন তারা আর কিছু না পেয়ে শূন্যতাকেই ধরবার চেষ্টা করছে!
আমার হাতে ছিল লাঠি। তাড়াতাড়ি লাঠিখানা এগিয়ে দিলুম এবং সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করলুম, আমার লাঠি ধরে জলের ভিতর থেকে কে যেন সজোরে টান মারছে! প্রচণ্ড টান!
সে বিষম টান আমি সামলাতে পারলুম না। আরো খানিকটা এগিয়ে গেলুম এবং জল উঠল প্রায় আমার গলার উপরে।
নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্যে হাতের লাঠি ত্যাগ করবার উপক্রম করছি, এমন সময় পিছন থেকে সন্তোষ এসে আমাকে দুই হাতে প্রানপণে জাড়িয়ে ধরলে। তারপরে আমাকে যত জোরে পারে টানতে টানতে সিঁড়ির উপর দিকে নিয়ে চলল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার লাঠির অন্য প্রান্ত ধরে জল থেকে ঘাটের উপরে টলতে টলতে এসে উঠল আর এক মনুষ্য-মূর্তি!
নিরাপদ স্থানে উঠে হাঁপাতে হাঁপাতে বললুম, “সন্তোষ ভয় নেই, - আমার কিছু হয়নি। কিন্তু ঐ লোকটিকে দেখ, ওর অবস্থা বোধহয় শোচনীয়।”
মূর্তিটা তখন ঘাটের উপর-ধাবে এসে লম্বা হয়ে শুয়েছিল। সন্তোষ এগিয়ে এসে তার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং পর-মুহূর্তেই বিকট এক চিৎকার করে সেখান থেকে এক ছুটে পালিয়ে গেল।
সে-রকম প্রচণ্ড চিৎকার জীবনে আমি কখনো শুনিনি-আমার সর্বাঙ্গ হয়ে উঠল রোমাঞ্চিত! বিদ্যুৎ-আহতের মতন আমি উঠে বসলুম এবং তার পরেই স্তম্ভিত নেত্রে দেখলুম, ঘাটের উপর শায়িত এক আড়ষ্ট নিশ্চেষ্ট দেহ, - তার হাত আছে, পা আছে, এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব আছে, কিন্তু স্কন্ধের উপর নেই কেবল তার মুণ্ডু-সে হচ্ছে কবন্ধ!

0 মন্তব্যসমূহ