বাবার ডায়েরি
কাটে না সময় যখন আর কিছুতে, বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না, জানলার গ্রীলটাতে ঠেকাই মাথা, মনে হয় বাবার মতো কেউ বলে না আয়, আয় খুকু আয়, আয় খুকু আয়--! হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের এই গান শুনছে আর চোখ মুছছে মীরা। তার চোখ দুটি যেন আজ শ্রাবণের ধারা। কিছুতেই বাধ মানছে না। অঝোর ধারাই ঝরেই চলেছে। বার বার মুছতে মুছতে চোখ দু’টি লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। চোখের পানি নাক-মুখ বেয়ে গায়ের জামা ভিজে গেছে। তার একই চিন্তা, একই ভাবনা, কেন আমি বাইরে গেলাম। আমি বাবার তাজা মুখটি দেখতে পেলাম না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, শ্রেষ্ঠ মানুষটিকে হারালাম! আমি বাইরে না গেলে হয়তো বাবা অভিমান করে এভাবে চলে যেত না! বাব! ও বাবা! তুমি তোমার এ অবাধ্য মেয়েকে ক্ষমা করো বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো মীরা। মীরার কান্নার আওয়াজ শুনে ছুটে এলো তার বড় বোন হীরা। বন্ধ দরজা ঠেলে হীরা ঘরে ঢুকে লাইটের সুইচ দিলো। দেখে মীরা বিছানায় শুয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। বিছানায় বসে মীরার মাথাটা নিজের উরুর উপর নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর শান্তনা দিয়ে বলছে, কাঁদিস না। কারো বাবাই চিরদিন বেঁচে থাকে না। মীরা কান্নাস্বরে বলে চলেছে, আমি আমার বাবার তাজা মুখটা দেখতে পাররাম না! এটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় কষ্ট। তুই ছিলি না কিন্তু আমরা তো বাবার কাছে ছিলাম! মীরার কান্না যেন আরো বেড়ে গেল! কাঁদতে কাঁদতে মীরা বলে চললো, তুমি তো জানো, বাবা আমাকে কতটা ভালোবাসতো! বাবা ছাড়া আমার জীবন কতটা অসহায়! আমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে এটা আমি ভাবতেও পারছি না! যাওয়ার সময় বাবা আমাকে বলেছিল, মা রে, টেনশন করিস না। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করিস। আমার জন্য ভাবিস না। কিন্তু তুমি তো আমাকে ভাবনার মহা সাগরে রেখে গেলে বাবা! আমি এখন না ভেবে কি করবো!
রোনালদো বলেছেন, যখন আমার অর্থবিত্ত কিছুই ছিল না, কিন্তু আমার বাবা ছিলেন। আজ আমার সব আছে কিন্তু পাশে আমার বাবা নেই!
মাকর্ টুয়েন বলেন, আমি যখন বালক তখন মনে হতো আমার বাবা কিছু জানে না। এই পুরনোকালের মানুষটার সাথে থাকা অসহ্যকর! আমি যখন একুশে পা দিলাম, তখন উপলব্ধি করলাম, ‘‘এই মানুষটা কতটা জানে ”!
মীরা’রা দুই বোন ও এক ভাই। বাবা মোমিন সাহেব হাইস্কুলে পড়াতেন। ছেলেকে পড়া-লেখা করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। সে এখন বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে ঢাকা থাকেন। বড় মেয়েকেও বিয়ে দিয়েছেন। সে প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। মীরা সবার ছোট। স্টাইপিন নিয়ে সে পড়াশুনা করছে জাপানে। মা অনেক আগেই গত হয়েছে। মোমিন সাহেব একাই পিতা-মাতার আদর-স্নেহ দিয়ে সন্তানদের বড় করে তুলেছেন। মানুষ করেছেন। আর এ কাজ করতে গিয়ে নিজের জীবনের সুখ-শান্তি, সাধ-আহলাদ বিসর্জন দিয়েছেন। বন্ধু-বান্ধব, নিকটাত্মীয়-স্বজনরা বলেছিল দ্বিতীয় কাজ করার কথা। কিন্তু মোমিন সাহেবের একই কথা এসব চিন্তা এখন আর আমার মাথায় নেই। আমার মাথায় শুধু একটিই চিন্তা, আর তা হচ্ছে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করা। মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলা।
মোমিন সাহেবের স্ত্রী খুব ভালো মানুষ ছিলেন। ছিলেন অতি সহজ-সরল ও নির্ভেজাল প্রকৃতির। মানুষে বলে, ভালো মানুষকে নাকি আল্লাহ তাড়াতাড়ি নিয়ে নেয়। মোমিন সাহেবের স্ত্রীও হয়তোবা এই কোটায় চলে গেলেন না ফেরার দেশে ! সেদিন মোমিন সাহেব বাড়ি ছিলেন না, মোমিন সাহেব ছিলেন ট্রেনিং এ। কাছে ছিলেন ছেলে ও দুই মেয়ে হীরা ও মীরা। সবাই ছোট। মাঝরাতে হঠাৎ তার বুকে ব্যথা অনুভব করেন। মায়ের ডাকাডাকিতে ছোট ছোট অবুঝ ছেলে- মেয়েরা উঠে বুকে-পিঠে তেল মালিশ করে দিয়ে সকালের অপেক্ষা করতে থাকে। সকাল হলে প্রতিবেশিদের সহযোগিতায় মাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু বিধি বাম! সেদিন ডাক্তার ও নার্সদের দাবী-দাওয়া নিয়ে কর্মবিরতি চলছিল। ফলে দৃশ্যতো সেদিন রুগী কোন চিকিৎসা পায়নি! পরের দিন ডাক্তার আসতে আসতে দুপুর বারোটা বেজে গেলো। রোগ তো আর কারো আত্মীয় হয়না যে, সে পরিস্থিতি বিবেচনা করে চলে যাবে! যা হবার তাই হলো। ছোট্ট ছোট্ট ছেলে- মেয়েদের এতিম করে মোমিন সাহেবকে একা দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে জনমের মতো বিদায় নিলেন।
অ-সময়ে স্ত্রীকে হারিয়ে মোমিন সাহেব যেন অথৈ সাগরে পড়ে হাবু-ডুবু খেতে লাগলেন। মিঠু বড় ছেলে। সে পড়ছে দশম শ্রেণীতে। বড় মেয়ে হীরা ক্লাশ এইটে এবং ছোট মেয়ে মীরা চতুর্থ শ্রেণীতে। একদিকে নিজের চাকরি, অন্যদিকে ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা, তাদের রান্না করে নিজ হাতে খাওয়ানো সব মিলে যেন সে একেবারে দিশেহারা! ছোট মেয়ে মীরা তাকে ছাড়া খাবে না, তাকে ছাড়া ঘুমাবে না! এহেন অবস্থা দেখে আত্মীয়স্বজন-প্রতিবেশীরা সবাই মোমিন সাহেবকে দ্বিতীয়বার কাজ করার কথা বলেছেন। কিন্তু মোমিন সাহেবের একই কথা, আমার যত কষ্টই হোক আমার ছেলে -মেয়ে মানুষ করাই একমাত্র ব্রত। অন্য কোন সুখ--শান্তি, আনন্দ আমার নেই!
মীরাকে শান্তনা দিয়ে রাত
হলেই হীরা চলে যায় তার সংসারে। তার চাকুরি আছে। আছে ছেলে-সংসার। মাঝে মাঝে আসে আর
মীরাকে সঙ্গ দিয়ে চলে যায়। আর বড়ভাই মিঠুতো বউ-বাচ্চা নিয়ে দুরে থাকে। মীরা এক
মাসের ছুটিতে এসেছে। সুতরাং সে মা বিহীন
বাবার অগোছালো ঘরটি পরিস্কার করা শুরু
করলো। এ ঘরে তার কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পরিস্কার করছে আর এসব মনে করছে। জিনিষপত্র
থেকে ধুলাবালি যতটুকু না পড়ছে তার চেয়ে চোখ থেকে মীরার পানি ঝরছে অনেক বেশী।
আলমারি পরিস্কার করতে গিয়ে হঠাৎ একটি ডায়েরি পেল মীরা। ডায়েরিতে তার বাবার নাম
লিখা রয়েছে। এমন ডায়েরি মীরার চোখে আগে কখনো পরেনি। মীরা ডায়েরিটি ভালো করে
পরিস্কার করলো। এবার প্রথম পাতাটি উল্টালো। সেখানে বড় বড় লেখা
‘‘এটা তোমাদের বাবার ডায়েরি, আমি যখন থাকবো না, তখন তোমরা পড়বে।’’
মীরার বুকের মধ্যে হুহু করে উঠলো। ডায়েরিতো নয়, যেন বাবা তার সাথে কথা বলছে! বুক গলা ধরে আসলো। হেক্সি তুলতে তুলতে সে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে উঠলো। বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলো। মীরা আবার ডায়েরীর কিছু পাতা উল্টালো।
তারিখঃ ১২-০১-২০২০ ইং
আজ আমার ছেলে বাসায় গেল। প্রাণভরে দোয়া করি আমার ছেলে বউমা ও নাতিকে নিয়ে যেন ভালো থাকে। আমার প্রথম ছেলে, বড় আদরের ছেলে। এই ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক গর্ব, অনেক অহংকার। নিশ্চয় আল্লাহ আমার এ অহংকার, এ গর্ব চিরদিন অটুট রাখবে।
মীরার চোখ যেন ঝাপসা হয়ে এলো। চোখ দিয়ে ঝপঝপ করে কয়েকফোঁটা লোনা পানি পৃথিবীর কোলে পড়লো। ডায়েরির আরো কিছু পাতা উল্টালো মীরাঃ
তারিখঃ ১০-০৩-২০২০ ইং
আজ আমার বড় মেয়ে হীরা আমাকে ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি গেল। মেয়েকে পরের ঘরে পাঠানো যে কতো কঠিন তা কেবল মেয়ের বাবারাই জানে। সেই ছোট বেলা থেকে মেয়েকে আদর, যত্ন, সোহাগ দিয়ে তিল তিল করে মানুষ করে গড়ে তোলা এবং সেই মেয়েকে একেবারে অচেনা জায়গায়, অচেনা পরিবেশে, অচেনা মানুষের কাছে পাঠানো বাবাদের জন্য একটি বিশাল ত্যাগ, বিশাল কষ্ট। মেয়েটি যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল তখন আমার হৃদয়টা যেন দুমড়ে-মুছড়ে গেল। মনে হলো যেন, আমার পুরো দেহের উপর দিয়ে সিডর-আইলা একসাথে বয়ে গেল! অথচ কাউকে বলতে পারলাম না। বরং বিদায় বেলায় আমাকে হাসিমাখা মুখে থাকা লাগলো। মনে হলো যেন আমি পৃথিবীর সেরা অভিনেতা! হায়রে বাবা’রা! তোমরা কতো অসহায়! মীরা ডায়েরির পাতা উল্টালোঃ
তারিখঃ ২০-০৩-২০২০ ইং
আজ প্রথম আমার মেয়ে হীরার শ্বশুরবাড়ি গেলাম। আজ খুব করে মনে পড়ছে হীরার মায়ের কথা। গল্পসারে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার কথা বললে সে বলতো, আমি নিজে যাবো আমার মেয়ের বিয়ের ঘর-বাড়ি দেখতে। আর জামাই হতে হবে আমার মনের মতো। মেয়ের বাড়ি যেতে কি কি নেবো সে থাকলে আজ ঠিকই তা বলে দিতো! দামী মিষ্টি কিনেছি। অনেকগুলো ফল-ফলাদি কিনেছি। আমার মেয়ের দই খুব পছন্দের তাও নিয়েছি। এখন যদি সে আমার সাথে থাকতো কতো সুন্দরই না হতো! কিন্তু তাতো আজ হবার নয়! সে যে অনেক আগেই আমাকে এই ভার একা বহন করার জন্য দুরে, অনেক দুরে চলে গেছে! ভাবলাম ছেলেকে সাথে করে নিয়ে যাবো। কিন্তু ছেলের নাকি অফিসে কাজের চাপে ছুটি পেল না। অগত্য একাই ঘুরে এলাম। তবে আসার সময় আমার মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারি নাই! কি যেন অব্যক্ত বেদনা আমার মেয়ে সারা অবয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে বলে আমার মনে হলো! আচ্ছা, আমার মেয়েও কি আমাকে নিয়ে একই রকম ভাবছে! ডায়েরির ক’পাতা উল্টালো মীরাঃ
তারিখঃ ১৭-০৬-২০২০ ইং
মুলা বড় হলে মাটি ফাটে, একথা বলে সর্বলোকে। আজ আমার একমাত্র অবলম্বন , আমার ছোট মেয়ে, আমাকে ছেড়ে কলেজ হোস্টেলে গেল। যেন আমার হৃদয় তার ছিড়ে গেল! ওদের মায়ের অসময়ে চলে যাওয়ার দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছিলাম ছেলে-মেয়েদের দিকে তাকিয়ে। আমার শত ব্যথা, শত কষ্ট চেপে রেখেছিলাম। কিন্তু শেষ ভরসা ছিল আমার ছোট মেয়ে মীরা। ছেলে বিয়ে করে বউ-বাচ্চা নিয়ে ঢাকা থাকে। বড় মেয়ে শ্বশুর বাড়ি। আমার খাওয়া-পড়া, সুখ-দুঃখ সবই দেখভাল করতো মীরা। খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। আমার কষ্ট হবে বলে মেয়ে আমাকে ছেড়ে যেতে চায়নি। আমি জোর করে পাঠিয়েছি। কেননা মীরাকে তো মানুষ হতে হবে। হোকনা আমার কষ্ট, তাতে কি! ওরা মানুষ হলেই আমার কষ্ট, আমার এই ত্যাগ সার্থক হবে বলে আমি মনে করি। কেননা আমি যে বাবা!
বাবার আজকের লিখাটা পড়ে হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলো মীরা। কাঁদতে কাঁদতে যেন পাগল হয়ে যাবে আজ মেয়েটা। বাবা তুমি এতো কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে রেখে চলে গেলে বাবা! একটিবারও আমাকে জানালে না তোমার মনের ব্যথা বাবা! তুমিতো জানো বাবা! তোমার এই মেয়ে তোমাকে কতটা ভালোবাসে! তবে কেন তুমি আমাকে কিছু না বলে আমাকে এভাবে একা ফেলে চলে গেলে! এমন সময় বড় বোন হীরা এসে তাকে শান্তনা দিয়ে বললো, আর কাঁদিস না। এভাবে কাঁদলে বাবার আত্মা কষ্ট পাবে যে বলে তাকে বোঝাতে লাগলো। হীরা কিছু খাবার এনে মীরাকে খেতে বললো। কিন্তু মীরার আজ খাওয়া তো দুরে থাক কোন কিছুই আজ ভাল লাগছে না। হীরা খেয়ে সহসা ঘুমিয়ে পড়লো। হীরার চোখে আজ ঘুমের লেশমাত্র নেই। নেই কোন ক্লান্তি, নেই শান্তি। আছে শুধু বাবা হারাবার হাহাকার। মীরা ডায়েরির পাতা উল্টালোঃ
তারিখঃ ২০-০৪-২০২০ ইং
আজ ক’দিন ছেলের বাসাতে এসেছি। ভালই লাগছে। ছেলে-বউমা সব সময় খোজ-খবর নিচ্ছে। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে একেবারে গৃহবন্দীর অবস্থা। এখানে আমার কোন বন্ধু-বান্ধব নেই। নেই কোন পরিচিতজন। শুধু শুধু ঘরে ক’দিন বসে থাকা যায়! আর একা কি ভাল লাগে! মিঠু সেই সকালে অফিসে যায় আর ফেরে রাতে। ছেলেটা সারাদিন পরিশ্রম করে আসে বলে ঐ রাতে আর দেখা করি না। মিঠুর সাথে যে ভালো করে কতোদিন কথা হয় না! খুব ইচ্ছে করে ছেলের সাথে একটু বসতে, কথা বলতে, একসাথে বসে চা খেতে। আমার মনে আছে, কোন কারণে আমার ফিরতে দেরি হলে আমার এই ছেলে খাবার নিয়ে বসে থাকতো। ওর মা যতই বলতো, তোর বাবার ফিরতে দেরি হবে তুই খেয়ে নে, কিন্তু ছেলে খেতো না। সকালে ছাত্র-ছাত্রীদের পড়া দেখাতে আমার দেরি হলে এই ছেলে চা নিয়ে আমার জন্য বসে থাকতো। আর আজ! একসাথে কতদিন বসা হয় না, একসাথে খাই না! হায়রে সময়! সময়ের ব্যবধানে আমাদের কত পরিবর্তন!
তারিখঃ ৩০-০৪-২০২০ ইং
হাটতে গিয়ে তিনজন বন্ধু পেয়েছি। তারাও আমার মতো অবসরপ্রাপ্ত। একজন হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। একজন সরকারি কলেজ শিক্ষক এবং অন্যজন জেলা সমাজসেবা অফিসার । বিকালটা বেশ ভালই কাটছে বর্তমানে। একসাথে হাটাহাটি করি, চা-নাস্তা খাই। মনে হচ্ছে যেন সেই কলেজ জীবন পেয়ে গেছি। ওরাই পাল্লাপাল্লী করে বিল পরিশোধ করে। আমি একদিনও বিল দিই নাই। আমার কাছে বিল দেওয়ার মতো টাকা নাইও! শুধু খেয়ে যাচ্ছি অথচ আমি একদিনও খাওয়াচ্ছি না এটা বেমানান। ক’দিন ধরে ভাবছি, মিঠুর কাছে কিছু টাকা চাইবো। কিন্তু মিঠুর সাথে কি আর আমার দেখা হয়! বেশ ক’দিন চলে গেল। বাধ্য হয়ে বউমার কাছেই চাইলাম। বউমা বললো, আব্বা, টাকা কি করবেন? কথায় বলে না, ‘‘অল্প শোকে কাতর,আর অধিক শোকে পাথর!’’ আমি থ-মেরে দাড়িয়ে আছি। যেন বাকরুদ্ধ! বউমা কি বললো আমাকে! আমি তার শ্বশুর, অর্থাৎ আমার মানুষ করা ছেলের টাকা দেবে আমাকে অথচ সে বলে, টাকা কি করবেন?
মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা। আমি স্কুলে যাচ্ছি এমন সময় মিঠুর মা বললো, ছেলে বন্ধুদের সাথে কোথায় যেন যাবে, একশো টাকা চেয়েছে। আমি দুশো টাকা দিলাম মিঠুর মায়ের হাতে। ছেলের মা বললো দু’শো টাকা দিচ্ছো কেন? আমি বললাম, ছেলে যাচ্ছে বন্ধুদের সাথে এজন্য একশো বেশি দিলাম। আমার ছেলে তার সব বন্ধুদের কাছে এ গল্প করেছে। আর আজ! আজ সেই ছেলের বউ আমাকে বলে, আব্বা টাকা কি করবেন! হায়রে সমাজ! হায়রে সমাজের মানুষ! হায়রে নিয়তি! হায়রে অবসর জীবন!
মীরা আজকের লিখা ডায়েরি পড়ে রাগে ফোঁস ফোঁস করে উঠলো। দ্রুত ডায়েরিটা বন্ধ করলো। পাশে পড়ে থাকা মোবাইলটা হাতে নিয়ে কাকে যেন মোবাইল করলো। ওপ্রান্ত থেকে উত্তর আসলো, ‘‘দুঃখিত, কাঙ্খিত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হাচ্ছে না। একটু পরে আবার ট্রাই করুন’’ মীরা যেন আরো অস্থির হয়ে উঠলো। আবারও কয়েকবার মোবাইল করলো। কিন্তু মোবাইল কর্তৃপক্ষও আজ যেন মীরা’র বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। একটি নম্বরেও কানেক্ট করতে পারলো না। মীরা বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে গড়াগড়ি করতে লাগলো। বললো, বাবা, তুমি এতোটা পাষান কি করে ছিলে বাবা! এতোটা কষ্ট কি করে কিভাবে হজম করলে বাবা! আমাকে যদি একবার বলতে তোমার এ অবস্থার কথা, তবে আমি তোমার ছেলের টুটি টিপে ধরে জিজ্ঞাসা করতাম, আমার বাবাকে এমন কথা বলার সাহস তোর বউকে কে দিয়েছে?
মীরা বলেই চলেছে, ও বাবা! তুমি বাড়ির গাছের প্রথম পেঁপেঁটা তোমার এই ছেলেকে দিয়েছো! দুধের মোটা সরটা তোমার এই ছেলেকে খাইয়েছো আর বলেছে ওকে তো অনেক বড় হতে হবে! মুরগীর রানের কি স্বাদ তা আমরা দু’বোনে কোনদিন বুঝিনি! তোমার ছেলেকে ফল-মুল খাইয়েছো আর বলেছো, রবীন্দ্রনাথের ব্রেইন বাড়ানোর জন্য তার বাবা-মা তার মাথায় কমলার রস তেল আকারে মাখাতো! তোমার সাধ্য থাকলে হয়তো তুমিও তোমার ছেলের মাথায় তাই মাখাতে! আর আজ সেইখান থেকে তুমি এমন আঘাত পেলে বাবা বলে হাঁউমাঁউ করে কাঁদতে লাগলো। সেদিন আর মীরার ডায়েরী পড়া হলো না। কাঁদতে কাঁদতেই সেদিন ঘুমিয়ে পড়লো।
মীরা শুয়ে শুয়ে ভাবছে, তার ভাবী বাবার সাথে এমনটা করতে পারলো! কি করে এমনটা করলো! কিছুতেই যেন মেলাতে পারছে না। এমন সময় বাবা এসে পাশে বসলো। বললো, মা-রে--, তোর কাছে কিছু টাকা হবে? মীরা বললো কতো টাকা বাবা? মীরা বললো, এই ধর পাঁচশো টাকা। মীরা বললো, বাবা, আমার কাছে পাঁচ হাজার টাকা আছে। সব টাকা তোমাকে দিবো। তুমি নিবে? বাবা বললো, না-রে মা। আমার এতো টাকার দরকার নেই। আমার মাত্র পাঁচশো টাকার দরকার। মীরা বললো, বাবা তুমি এতো কম টাকা দিয়ে কি করবে? পাঁচশো টাকায় আজকাল কিছুই হয় না! বাবা বললো, আমার বন্ধুরা আমাকে বেশ ক’দিন খাওয়াইছে কিন্তু আমি একদিনও তাঁদের খাওয়াতে পারি নাই। পাঁচশো টাকা হলেই আমার বন্ধুদের খাওয়াতে পারবো।
মীরা ব্যাগ খুলে চকচকে পাঁচশো টাকার একটি নোট বের করে বাবার দিকে এগিয়ে ধরলো এমন সময় মীরার ভাবী এসে হাত থেকে ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে নিল। বললো, এটা আমার টাকা। মীরা বললো, কখনোই না। এটা আমার টাকা। আমি খুব কষ্ট করে না খেয়ে খেয়ে আমার বাবার জন্য এ টাকা জমিয়েছি। আমার টাকা আমি বাবাকে দিচ্ছি, তুমি কেন নিচ্ছো? দাও, আমার টাকা আমাকে ফিরিয়ে দাও। সে বললো না, দিবো না। শুরু হলো ধস্তাধস্তী। কেউ কাউকে নাহি ছাড়েঙ্গা। মীরার মনের কোণে বাবাকে টাকা না দেওয়ার কঠিন ব্যথা লুকিয়ে ছিল। প্রতিশোধের যেন এই সুযোগ মনে করে টাকা আদায়ের ওছিলায় মীরা ভাবীর গলা যেন চেপে ধরেছে। হীরা বলছে, আরে ছাড় ছাড়! এভাবে গরা ধরলি কেন? ঘুম ভেঙ্গে দেখে মীরা শক্ত করে হীরার গলা ধরে আছে। তাড়াতাড়ি বড়বোন হীরার গলা ছেড়ে উঠে বসে প্রতিশোধের ব্যর্থতার জন্য ফোস ফোস করতে লাগলো। হীরাও বুঝতে পারলো মীরা নিশ্চয় দুঃস্বপ্ন দেখছিল।
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি,
কুষ্টিয়া সাহিত্য পরিষদ।

0 মন্তব্যসমূহ