কঙ্গো রেইনফরেস্ট । পৃথিবীর দ্বিতীয় ফুসফুস

পৃথিবীতে এক স্থান আছে, যেখানে আছে এই গ্রহের গভীরতম নদী। তার দু-কুল জুড়ে ছড়িয়ে আছে অনন্ত অরণ্য। যেখানে আছে প্রায় ১০,০০০ (দশ হাজার) প্রজাতির উদ্ভিদ। সেখানে রোজ রোজ ভোরের মেঘ সরিয়ে জেগে ওঠে নবীন অরণ্য। নদী আর অরণ্য এক হয়ে পাশাপাশি বেঁচে আছে বহুকাল। অনন্তকাল ধরে কথা হয় তাদের। নদী অরণ্যকে বলে, ‘তুমি জানো হে অরণ্য, আমি যখন ছুটে যাই তখন আমি অনেক শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে যাই। তখন মানুষ আমাকে জাইরে, কুয়াঙ্গ, উবাঙ্গী, সিমি, চাংবেই কিংবা কঙ্গো বলে ডাকে।’ অরণ্য উত্তর দেয়, ‘মানুষ আমাকেও বিভিন্ন নামে ডাকে। তারা আমাকে ভার্জিন ফরেস্ট, রেইন ফরেস্ট, রানীর বন কখনো বা পৃথিবীর ফুসফুস বলেও ডাকে। আমাকে এত আদর করে ওরা ডাকে কেন জানো? আমার বুকের চঞ্চল হাওয়ায় শতাব্দী প্রাচীন গাছের কাণ্ড দুলে ওঠে। অগণিত পাতার আদিম শব্দে জেগে ওঠে অরণ্যবাসী পাখি। তখন আকাশ থেকে গাছের উপর ছাউনির সমতল দিগন্ত দেখতে কি দারুণ লাগে। তুমিও কম কোথায়? তোমার ছুটেচলা নিরন্তর। তুমি তোমার লক্ষ্যে অবিচল।’ নদী বলে, ‘তুমি অরণ্য। তুমি সবদিকেই বিকষিত হও। ক্রমাগত নিজেকে পুনরুদ্ধার করতে পারো তুমি, তুমি বিষ্ময়কর।’

কঙ্গো নদী আর তার অববাহিকা জুড়ে বিস্তৃত গভীর অরণ্যের বোঝাপড়া অনেকটা এমনই। পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী কঙ্গো অববাহিকায় গড়ে ওঠা এই অরণ্যকে ডাকা হয় কঙ্গো রেইনফরেস্ট নামে। 

চলুন তবে জেনে  আসা যাক পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত কঙ্গো রেইনফরেস্ট সম্পর্কে  সংক্ষেপে কিছু তথ্যঃ


রেইনফরেস্ট বা বৃষ্টির অরণ্য বলা হয় সেই সকল অরণ্যকে যেখানে সারা বছর প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বিশেষ করে গৃষ্মমন্ডলিয় রেইনফরেস্টগুলোতে বছরে গড়ে ২৫০ থেকে ৪৫০ সে.মি পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মাঝখানে নিরক্ষীয় অঞ্চলে মূলত বেশিরভাগ রেইনফরেস্ট অবস্থিত। এই রেইনফরেস্টগুলো দক্ষিণপূর্ব এশিয়া, সাব শাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, সেন্ট্রাল আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরিয় দ্বীপজুড়ে অবস্থিত। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইনফরেস্ট হল আমাজন এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম রেইনফরেস্টের নাম কঙ্গো রেইনফরেস্ট। ১৫ শতকের দিকে পর্তুগিজ বনিকদের আগমনের পর কঙ্গো নদীর নামকরণ করা হয়েছিল। কঙ্গো শব্দটি এই অঞ্চলে বাস করা বাকঙ্গু উপজাতীদের নামথেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। নদীর নামের সাথে মিল রেখে এর অববাহিকায় অবস্থিত অঞ্চলকেও সবাই কঙ্গো নামে চেনে। কঙ্গো নামে নদী এবং অরণ্যের পাশাপাশি দুটি দেশেরও নামকরণ করা হয়েছে। একটি কঙ্গো প্রজাতন্ত্র এবং অপরটি কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। যদিও আফ্রিকার নয়টি দেশ জুড়ে কঙ্গো অববাহিকা বিস্তৃত তবে এদের মধ্যে ছয়টি দেশে ছড়িয়ে আছে কঙ্গো রেইনফরেস্ট। ক্যামেরন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, কঙ্গ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, ইকোইটোরিয়ার গিনি ও ক্যাবন। এই ছয়টি দেশের প্রায় ১.৫ মিলিয়ন বর্গমাইল জুড়ে অবস্থিত এই রেইনফরেস্টটি পৃথিবীর সকল রেইনফরেস্টের সম্মিলিত আয়তনের প্রায় ১৮ শতাংশ। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অরণ্যের সিংহভাগ অঞ্চল রয়েছে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো তে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিমাপ করা প্রাথমিক রেকর্ড অনুযায়ী এই রেইনফরেস্টের আয়তন ছিল ১,০৭,৮০,০০০ (এক কোটি সাত লক্ষ আশি হাজার) বর্গ কিলোমিটার। অবিশ্বাস্য মনে হলেও বর্তমানে বণভূমির প্রায় ৮০ ভাগই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জীববৈচিত্রের অনন্য তীর্থভূমি এই রেইনফরেস্ট। এখানে প্রায় ১০,০০০ (দশ হাজার) প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও রয়েছে ৪০০ (চারশত) প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৭০০ (সাতশত) প্রজাতির মাছ, ১০০০ (এক হাজার) প্রজাতির পাখি। যে সকল প্রজাতি এখানে পাওয়া যায় তারমধ্যে পিগমি সিমপাঞ্জি, বন্য হাতি, গরিলা, কঙ্গো ময়ুর, সাদা গণ্ডার, ওকাপি, স্থল প্যাঙ্গুলিন অন্যতম। কঙ্গো রেইনফরেস্টের প্রাণিগুলোর মধ্যে ওকাপি অদ্ভুত এক প্রাণী। ওকাপি সাধারণত ৫০০ থেকে ১০০০ মিটার উচ্চতায় পাহাড়ি অঞ্চলের দিকে এবং ৫০০ মিটারের কম উচ্চতার জলাভূমিতে বসবাস করে। ওকাপির প্রধান খাদ্য ঘাস, লতাপাতা, ফলমুল হলেও এর এমন অনেক প্রজাতির উদ্ভিদও খায় যা মানুষের জন্য বিষাক্ত। এছাড়াও এই রেইনফরেস্টে বিচরণ করে মাংসাশী আফ্রিকান চিতাবাঘ। শক্তিশালী ও ক্ষিপ্র গতির এই চিতাবাঘ টিককিকি থেকে শুরু করে পাখি, কৃষ্ণসার থেকে মহিষ পর্যন্ত শিকার করে। কঙ্গো রেইনফরেস্টের আরেকটি ভয়ানক প্রাণি হল আফ্রিকান সোনালী বিড়াল। এই বিশালদেহি বিড়াল বাখি, বানর এবং ছোটছোট কৃষ্ণসার শিকার করে থাকে। এই রেইনফরেস্টের গাছের ঘন পাতার সামিয়ানায় বাস করে কালো কলোম্বাস বানর যারা তাদের লাফ দেওয়ার অসাধারণ পারদর্শিতার জন্য বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত। এরা আফ্রিকার অন্যতম সংকটাপন্ন বানর প্রজাতির মধ্যে অন্যতম। গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, দারিদ্র এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেখানকার অনেক অধিবাসী এখনও বন্যপ্রাণীর মাংসের উপর নির্ভরশীল। এগুলো শিকার করা হয় ফাঁদ পেতে কিংবা গুলি করে। কাঠ সংগ্রহকারী ও খনি খননকারী কোম্পানীগুলো রেইনফরেস্টের একটা বিরাট অংশ পরিষ্কার করে রাস্তা বানানোর কারণে শিকারীরা এখন অরণ্যের এমন গহীন জায়গায় পৌঁছাতে সক্ষম যেখানে তারা আগে কখনই যেতে পারতো না। এর ফেলে গোরিলার মতো অনেক প্রাণির সংখ্যাও কমে যাচ্ছে রাতারাতি। এছাড়াও অবৈধ বন দখলকারীরা বিলুপ্তপ্রায় হাতি শিকারে বনের মধ্যে ফাঁদ পেতে রাখে কেননা আফ্রিকান হাতির দাঁতের দাম অন্যান্য অঞ্চলের হাতির দাঁতের তুলনায় অনেক বেশি। আশংকার বিষয় হচ্ছে এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যে এই অঞ্চলের হাতির সংখ্যা ৬০ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। এরপরও কঙ্গো রেইনফরেস্টের কিছু কিছু জায়গায় গাছপালা এত ঘন এবং দুর্গম যে, সে সব জায়গায় এখনও মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। এই অরণ্যের সবচেয়ে ঘন জায়গায় সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে না। গবেষকরা খুঁজে পেয়েছেন কঙ্গো রেইনফরেস্টে সাধারণত লম্বা গাছের উপস্থিতি বেশি। এখানে আমাজন কিংবা বৈনিয়র বনের তুলনায় ছোটগাছের ঘনত্ব খুব কম। কারণ হাতি, গোরিলা এবং বড় তৃণভোজি প্রাণীরা খাদ্য হিসেবে ছোটছোট গাছগুলোর উপরে নির্ভরশীল। এখানে লিয়ানা নামে একপ্রকার গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ পাওয়া যায়। যা ৩০০০ (তিন হাজার) ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। সেগুন কাঠ কঙ্গো রেইনফরেস্টের প্রধান গাছগুলোর মধ্যে একটি। এই বনের সেগুন গাছগুলো ১৫৪ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। কাঠ হিসেবে এই সেগুনগাছের চাহিদা অনেক বেশি এবং বন উজাড়ের পেছনে এটা অনেক বড় একটা কারণ। প্রায় ৫০ হাজার বছর ধরে মানুষ বসবাস করে আসছে কঙ্গো রেইনফরেস্টে। বর্তমানে এখানে সব মিলিয়ে ১৫০ টি জাতী গোষ্ঠি বসবাস করে যাদের জীবন ও ভাগ্য বনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। অনেক জাতীগোষ্ঠি আছে যারা এখনও গভীর অরণ্যে দলবদ্ধ হয়ে বাস করে। এই জাতীগোষ্ঠির মধ্যে বিখ্যাত পিগমিরাও আছে। পিগমিরা তাদের আকারে জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। পিগমি পুরুষদের গড় উচ্চতা চার ফুট দশ ইঞ্চি আর মহিলাদের গড় উচ্চতা চার ফুট এক ইঞ্চি। তাদের এই সল্প উচ্চতা তাদেরকে রেইনফরেস্টের ভেতর সহজে চলাচলে সহায়তা করে। তাছাড়া কম উচ্চতার কারণে তাদের ওজনও হয় কম। আমাজন কিংবা ইন্দোনেশিয়ার রেইনফরেস্টের তুলনায় বৃক্ষ নিধনের হার এখানে অনেক কম হওয়া সত্বেও কঙ্গো রেইনফরেস্টের ইকোসিস্টেম অনেক দূর্বল হয়ে পড়েছে। অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বন ধ্বংস, অতিরিক্ত খনিজ সম্পদ আহরণ এবং এসব কাজে ব্যবহৃত গ্যাস ও রাসায়নিক ছড়িয়ে পড়ার ফলে এখানকার ইকোসিস্টেম আজ ভয়াবহ হুমকির মুখে। প্রতিবছর ১০,৫০,০০০ (দশ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) হেক্টর বন পরিষ্কার করে তৈরি করা হচ্ছে ‍কৃষিজমি, বাসস্থান, আর জ্বালানীর সংস্থান। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার দেওয়া তথ্য মতে ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে সেন্ট্রাল আফ্রিকা প্রায় ৯১,০০০ (একানব্বই হাজার) বর্গ কিলোমিটার রেইনফরেস্ট হারিয়েছে বৃক্ষনিধনের কারণে। অনুমান করা হচ্ছে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ কঙ্গো রেইনফরেস্টের ৩০ শতাংশ বিলিন হয়ে যাবে যদি না বৃক্ষনিধনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রন করা হয় অথবা বাণিজ্যিকভাবে কাঠ সংগ্রহ কমানো হয়। মূলত ক্রমাগত রেইনফরেস্ট উজাড় এই অঞ্চলের মানুষদের দীর্ঘকালীন দারিদ্রের জন্য দ্বায়ী। কঙ্গো প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। বিভিন্ন খনিজ সম্পদ যেমন, ইউরেনিয়াম, কোবাল্ট, সোনা, হিরা, তেলের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে রয়েছে বৃক্ষ আর উর্বর ভূমি। তা স্বত্বেও দরিদ্রতম দেশের তালিকা থেকে এখানকার দেশগুলো মুক্ত হতে পারেনি। সম্পদের ভাগ বাটোয়ারার সু-ব্যবস্থা না থাকার কারণে সংঘাত, সংঘর্ষ এবং হত্যাকাণ্ড এসব অঞ্চলের নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজসম্পদ, কাঠ, পশুর চামড়া, হাড়, লিভার, মাংস ইত্যাদির চাহিদা বাড়ায় গাছ ও বন্যপ্রাণির অবৈধ্য ব্যবসাও এখানে বিস্তৃতভাবে ছড়িয়েছে। এছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে বন্যপ্রাণী হত্যা করে স্থানীয় বাজারে মাংস বেঁচে রোজগার করা এই অঞ্চলের বহু পরিবারেই জীবিকা নির্বাহের একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতুলনীয় জীববৈচিত্র আর হাজার হাজার প্রজাতীর আবাসস্থল কঙ্গো অরণ্যের সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবীতে পরিণত হয়েছে। কেননা বন্য প্রাণি থেকে শুরু করে আফ্রিকার জনগণের বিশাল একটা অংশ খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য এখনও এই অরন্যের ‍উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। কঙ্গো রেইনফরেস্টের গহীনে অসীম সুবজ আঁচলের তলে বয়ে চলা কঙ্গো নদী হয়তো তার জলের কন্ঠে গভীর হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরণ্যকে বলে, ‘হে অরণ্য দেখতে পাচ্ছ সবকিছু বদলে গেছে কেমন। মানুষরা কেমন নির্মম হয়ে গেছে। ওরা আমাদের কথা ভুলে গেছে একেবারেই।’

পৃথিবীর মানুষেরা কি শুনতে পাচ্ছে কঙ্গো নদী আর অরণ্যের গভীর এই আর্তনাদ?