মামাবাবুর নিদ্রাভঙ্গ

খাতাপত্র, পুরোনো ডায়েরি আবার ঘাটতে হল।
স্মরণশক্তি আমার তেমন জোরালো কোনদিনই না। স্কুলে পড়বার সময় সংস্কৃতে ধাতুরূপ শব্দরূপগুলো মুখস্ত করতে না পারার জন্যেই সবচেয়ে বিপদে পড়তাম। এখন বয়েস বাড়ার সঙ্গে সে-স্মৃতিশক্তির উন্নতি অন্তত হয়নি।
কিন্তু হঠাৎ স্মৃতিশক্তিকে উসকে দেওয়ার জন্যে পুরোনো খাতা, ডায়েরির দরকারই বা হল কেন?
দরকার হল ‘আশ্চর্য!’ কাগজের সম্পাদকমশাইয়ের জন্যে।
হঠাৎ সেদিন সকালবেলায় আশ্চর্য ব্যাপার!
ভেতর থেকে শুনতে পেলাম বাইরের দরজায় কে ‘গণপতিবাবু, গণপতিবাবু’ বলে ডাকছেন। 
প্রথমটা যেমন হকচকিয়ে গেছলাম তেমনই বিরক্তও হয়েছিলাম একটু। গণপতি আবার কে? না জেনেশেুনে এ-বাড়িতে এসে গণপতিকে খোঁজবার মানে কী? গণপতি আমার নাম নয়। এ-বাড়িতে কস্মিনকালে কারুর নাম গণপতি ছিল না। 
বেশ একটু রুক্ষ মেজাজ নিয়ে ভদ্রলোককে সে-কতা বলবার জন্যে দরজা খুলতে যেতে যেতেই স্মৃতিটা হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বিরক্তির বদলে একটু লজ্জাই অনুভব করলাম। তবে বিস্ময়টা সমানই রইল। 
গণপতি আমার নাম নয়, তবে একসময়ে এই ছদ্মনামটা ব্যবহার করেছি। ব্যাসদেবের অনুলেখক গণেশের নামটাই এ-ছদ্মনামের অনুপ্রেরণা। গণেশ ব্যাসদেবের ভাষণ লিখে গেছেন। আর আমি লিখেছি মামাবাবুর কীর্তিকাহিনী। ঠিক অনুলেখক না হলেও লিপিকার হিসেবে গণেশের বদলে গণপতি নামটা নিয়েছিলাম। সেই নামেই পত্র-পত্রিকাতে ও প্রকাশকের কাছে চিঠিপত্র লেখা এবং পাণ্ডুলিপি পাঠানোর কাজ করেছি। 
কিন্তু এখন হঠাৎ সে-নাম ধরে কে খোঁজ করতে এল? কারণই বা কী?
দরজা খোলার পরই রহস্যটা পরিষ্কার হল।
এসেছেন আর কেউ নয়। ‘আশ্চর্য!’ কাগজের সম্পাদক। কোনও প্রকাশকের কাছ থেকে গণপতি হাজরার ঠিকানা জেনে নিয়ে সরাসরি চলে এসেছেন মামাবাবু কেন নীরব সেই খোঁজ করতে। 
‘আশ্চর্য!’ সম্পাদককে কিছুতেই ঠেকানো গেল না। ঘন্টা দুই বসে তাঁর সঙ্গে আলাপ করে তাঁর অকাট্য যুক্তিতে মামাবাবুর কীর্তিকাহিনী প্রকাশের ব্যবস্থা করতে রাজি হতেই হল।
সেইজন্যেই খাতাপত্র পুরোনো ডায়েরি ঘাঁটা।
পুরোনোর বদলে নতুন কিছু লেখা যয় না এমন নয়। গণপতি হাজরার লেখাই বন্ধ হয়েছে, মামাবাবুর কীর্তিকলাপ তো ফুরিয়ে যায়নি। তবু শুরু যখন করা হল তখন আগেকার কাহিনীগুলোকে বাদ দিলে অন্যায়ই হবে। 
কয়েকবছর আগেকার এমনই শীতের দিনের একটি সকাল থেকেই শুরু করা যাক। সবে তার আগের দিন সন্ধ্যায় দিল্লি থেকে ফিরেছি। দিল্লির হাড়ভাঙা শীতের পরে কলকাতার শীতে কাবু হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু কাবু হয়েছি কলকাতার ধোঁয়া-ধুলো মেশানো বিদ্‌ঘুটে কুয়াশায়।
আগের রাত্রে ফিরে আর মামাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। পরের দিন সকালেই বার হলাম সেই উদ্দেশ্যে। 
ইচ্ছে করে একটু বেলা করেই বেরিয়েছিলাম। মামাবাবুর হালচাল তো আর জানতে বাকি নেই। এমনিতেই বেলা আটটার আগে তাঁর ঘুম ভাঙে না। আর এই শীতের দিনে ন’টার আগে কি আর লেপ-কম্বল ছেড়ে উঠবেন।
ন’টার একটু আগেই অবশ্য এসেছিলাম। এখনও জেগে না থাকলে ঠেলেঠুলে বিছানা থেকে তুলব এই অভিপ্রায়।
কিন্তু বাড়ির কাছে এসে তাজ্জব হয়ে গেলাম। ভোরের গাঢ় কুয়াশা তখনও কাটেনি। একটু ফিকে হয়েছে মাত্র। সেই কুয়াশার মধ্যে মামাবাবুর বাড়ির সামনে প্রথমেই এক পুলিশের গাড়ি দেখে অবাক। শুধু গাড়ি নয়, বাড়ির চারদিকে বেশ জনকয়েক পুলিশ খাড়া পাহারায় দাঁড়িয়ে।
কুয়াশায় ‍দৃষ্টিবিভ্রম হয়েছে কি না প্রথমটা সেই সন্দেহই হল।
কিন্তু দেখার ভূল নয়, সত্যিই জলজ্যান্ত পুলিশ বাড়ির চারিধারে!
বেশ একটু হ্যাঙ্গামা হল পরিচয় দিয়ে ভিতরে ঢুকতে। সেখানে গিয়েও দেখি জন দুই অফিসার নিচের বাইরের ঘরে মামাবাবুর সঙ্গে আলাপ করছেন। বাড়ির নিচে-ওপরেও দু-চারজন পুলিশকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল।
ব্যাপার কী?
পুলিশ অফিসারদের আলাপ থেকে তেমন কিছুই বোঝা গেল না।
আমি ঘরে ঢোকবার পর প্রথম পরিচয়ের শেষে একজন আগের কোনও কথার খেই ধরেই নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করলেন, ‘তাহলে আপনি কিছুই টের পাননি বলছেন? বলছেন, আপনার ঘরের আর সমস্ত বাড়ির কিচুই চুরি যায়নি?’
‘না।’
মামাবাবুর সংক্ষিপ্ত উত্তরে ক্লান্ত অসহায় ভাবের সঙ্গে একটু বিরক্তিও যেন মেশানো। দ্বিতীয় অফিসার সেটুকু বোধ হয় লক্ষ করেই বললেন, ‘আপনাকে একটু বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে আমরা দুঃখিত, কিন্তু আপনার বিপদের কথা ভেবেই এ-হ্যাঙ্গামা করতে হচ্ছে, এটুকু আশা করি বুঝছেন। একটা মানুষ এই বন্ধ বাড়ির ভেতর থেকে সত্যি সত্যি তো আর হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না।’
‘কিন্তু তাকে তো কোথাও খুঁজে পেলেন না।’ মামাবাবুর গলায় যেন ক্লান্ত অনুযোগ।
‘সেইটেই তো আশ্চর্য। আশ্চর্য কেন, প্রায় আজগুবি।’ প্রথম অফিসার বললেন। 
‘ব্যাপারটা কি একটু জানতে পারি?’ এবার না জিজ্ঞেস করে পারলাম না।
প্রথম পুলিশ অফিসার আমার দিকে একটু ভ্রুকুটিভরেই চাইলেন। আমার এ-অনধিকার চর্চাটা তাঁর পছন্দ নয়।
দ্বিতীয় অফিসার একটু উদার। তাঁর কাছে সংক্ষেপে যা জানা গেল তা সত্যিই অদ্ভুত। ভোরের কিছু আগে মামাবাবুর এক প্রতিবেশী মিঃ ভোরা তাঁর গ্যারেজ থেকে মোটর বার করতে বেরিয়ে হঠাৎ একজন লোককে ঝোলানো দড়ি বেয়ে মামাবাবুর ঘরের জানলায় উঠতে দেখেন। গাঢ় কুয়াশার দরুন প্রথমটা তাঁর নিজের চোখের দৃষ্টির ওপরই সন্দেহ হয়। কিন্তু পরে আরও একটু কাছে এগিয়ে গিয়ে লোকটিকে জানালার একটা গরাদে সরিয়ে স্পষ্ট ভেতরে ঢুকতে দেখে মিঃ ভোরা চিৎকার করে মামাবাবুকে ডাকবার চেষ্টা করেন। তাঁর চিৎকারে নিজের বাড়ির ড্রাইভার চাকর বেরিয়ে এলেও মামাবাবুর বাড়ি থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। লোকটা তখন ভেতরে ঢুকে দড়িটাও টেনে তুলে নিয়েছে। মিঃ ভোরা এবার ড্রাইভারও চাকরকে জানলার নিচে পাহারায় রেখে অন্যদিকে মামাবাবুর বাড়ির দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ডাকাডাকি করেন। কিছুক্ষণ বাদে মামাবাবুর নতুন অনুচর রঘুবীর জেগে দরজা খোলবার পরও মামাবাবুর ঘুম ভাঙতে বেশ সময় লাগে। মামাবাবু অবশ্য অসময়ে ঘুম ভাঙার দরুন আচ্ছন্ন অবস্থায় প্রথমটা কিছু বুঝতেই পারেন না। তাঁর ঘরের মধ্যে পড়ে থাকা দড়িটা দেখিয়ে মিঃ ভোরাকে ব্যাপারটার গুরুত্ব তাঁকে বোঝাতে হয়। তা সত্ত্বেও মামাবাবুর বিশেষ উৎসাহ না থাকলেও মিঃ ভোরা তখন পুলিশকে ব্যাপারটা জানান। পুলিশ এস তন্নতন্ন করে সমস্ত বাড়িঘর খোঁজ করেও কোথাও কাউকে পায়নি। যে-লোকটাকে মিঃ ভোরা স্পষ্ট দড়ি বেয়ে উঠে জানলার গরাদে সরিয়ে মামাবাবুর ঘরে ঢুকতে দেখেছেন, সে-লোকটা তাহলে গেল কোথায়? মামাবাবু একটি চাকর নিয়ে একলাই এ-বাড়িতে থাকলেও বাড়িটি নেহাত ছোট নয়। আসলে সেটি একটি মিউজিয়াম, লাইব্রেরি আর ল্যাবরেটরির সমাবেশ। নিচের কয়েকটা ঘর শুধু বইয়ে বোঝাই। কীটপতঙ্গ আর বিরল জন্তু-জানোয়ারের মরা নমুনা দুটি করে কাচের ঢাকনা দেওয়া নানা আকারের আলমারি আর বাক্সে সাজানো। দোতলায় মামাবাবুর নিজের ব্যবহার্য ঘরগুলো ছাড়া আপাতত সবাই ল্যাবরেটরির পাশের একটি ছোট ঘরে শোয়। মাসখানেক হল সে ছুটি নিয়ে গেছে বলে নতুন দারোয়ান রঘুবীর নিচের একটি ঘরে থাকে। 
রঘুবীর তাঁর ডাকে দরজা খোলবার পর মিঃ ভোরা নিজে সে-দরজা আবার বন্ধ করে মামাবাবুকে ওপরে ডাকতে পাঠিয়েছেন। বাইরের যে-জানলা দিয়ে লোকটা ঢুকেছিল তার নিচেও মিঃ ভোরার চাকর ঠায় পাহারায় দাঁড়িয়ে। বাড়ি থেকে বেরুবার আর কোন রাস্তাই নেই কোনখানে। মামাবাবুর না হয় কুম্ভকর্ণের নিদ্রা। লোকটার ঘরে ঢোকা তিনি টেরও পাননি। কিন্তু লোকটা এই বন্ধ বাড়ির ভিতর থেকে উধাও হয়ে গেল কী করে এই হল সমস্যা।
অফিসার তাঁর বিবরণ শেষ করবার পর আমার মনে যে প্রশ্নটা উঠেছিল, তিনি নিজেই সেটা প্রকাশ করে তার উত্তর দিলেন। বললেন, ‘সমস্ত ব্যাপারটা মিঃ ভোরার দৃষ্টিভ্রম ভাবতে পারতাম, কিন্তু জানলার ভাঙা একটা গরাদে আর ঘরের মেঝের ওপরকার ফেলে যাওয়া দড়িটা তো আর উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
‘তাহলে সে এখানেই কোথাও আছে মনে করুন, আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না।’
মামাবাবুর গলাটা খুব প্রসন্ন মনে হল না। একটু বিদ্রুপও তাতে মেশানো।
‘আপনি বিরক্ত হয়ে পরিহাস করছেন বুঝতে পারছি।’ প্রথম অফিসার একটু হেসে বললেন, ‘কিন্তু এ-ব্যাপারে অদৃশ্য মানুষের মতো আজগুবি ব্যাখ্যা তো সত্যি মেনে নিতে পারি না।’
দ্বিতীয় অফিসার হঠাৎ উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, আপনার বাড়িতে লুকনো কোনও চোরা দরজা বা কুঠুরি গোছের কিছু নেই তো?’
‘না, মশাই।’ এবার মামাবাবুই হেসে উঠলেন: ‘আমি রোমাঞ্চ কাহিনীর গোয়েন্দা কি পাপিষ্ঠ নই যে, বাড়িতে ওইসব প্যাঁচ রাখব। আমার বাড়িতে যা আছে চোখেই দেখা যায়। দেখলেন তো সব।’
‘দেখুন!’ প্রথম অফিসারের গলায় এবার একটু আহত অভিমানের সুরই শোনা গেল, ‘আমরা যেন আপনাকে সাহায্য করতে এসে অপরাধ করেছি মনে হচ্ছে। কিন্তু আপনার মতো লোকের বাড়িতে সন্দেহজনক কিছু ঘটলে আর মিঃ ভোরার মতো সম্ভ্রান্ত লোকের কাছে তার খবর পেলে কর্তব্য হিসেবে আমাদের যা করবার করতে আসতেই হয়। আমাদের সাধারণভাবে যা করবার করেছি। মিঃ সেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে আঙুল-টাঙুলের ছাপ কিছু পান কি না দেখতে এসেছিলেন। চোর বা খুনে যেই এ-বাড়িতে ঢুকে থাকুক, লোকটা অত্যন্ত হুঁশিয়ার। ঢোকবার পর গরাদে জানলা সমস্ত এমনভাবে মুছে দিয়েছে যে, চাকর-বাকরের হাতের ছাপ পর্যন্ত কোথাও মিঃ সেন পাননি। সারা বাড়িতে ওই দড়িগাছটা আর ভাঙা গরাদে ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনি আমিও। তবু রহস্যটা অলৌকিক কিছু বলে ছেড়ে দিতে পারছি না। আপনাকে সেই আগেকার প্রশ্নটাই আবার তাই করছি। আপনি সব দেখেশুনে নিশ্চিত হয়ে এখনও বলছেন যে, কিছুই আপনার বাড়িতে কোথাও থেকে চুরি যায়নি? সব যেমন ছিল ঠিক আছে?’
‘নিশ্চত হয়ে চুরি কিছু যায়নি এই কথাই বলেছি।’ মামাবাবু রীতিমত গম্ভীর মুখে বললেন, ‘কিন্তু সব যেমন ছিল ঠিক আছে তা তো বলিনি।’
‘তার মানে?’ অফিসার দু’জনের চোখ কপালে উঠল।
‘এ আবার কি হেঁয়ালি?’ আমিও জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম।
‘হেঁয়ালি কিছু নয়।’ মামাবাবু আগের মতোই গম্ভীরভাবে বললেন, ‘চুরি যাওয়ার বদলে বাড়িতে বাড়তি কোনও জিনিস যদি এসে যায়, তাহলে সব ঠিক আছে তো আর বলা যায় না।’

‘চুরি যাওয়ার বদলে বাড়তি জিনিস বাড়িতে এসেছে!’ অফিসার দু’জনেই বেশ হতভম্ব ও সেইসঙ্গে একটু বিরক্ত, ‘কই এ-কথা তো আগে বলেননি!’
‘আপনারা তো জিজ্ঞেস করেননি!’ মামাবাবু সরলভাবে জবাব দিলেন, ‘আপনারা চুরির কথাই জিজ্ঞেস করছিলেন।’
মামাবাবুর সঙ্গে ন্যায়শাস্ত্রের সূক্ষ্ম তর্কে যাওয়া নিস্ফল বুঝে অফিসার মিঃ সেন একটু অধৈর্যের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাড়তি জিনিসটা কী?’
‘একটা ছোট পিপে বলতে পারেন। আমার পোকামাকড় প্রভৃতির নমুনা যে-ঘরে থাকে সেই ঘরেই সেটা এখন আছে। আগে ছিল না।’
‘আশ্চর্য তো! কিসের পিপে তাহলে দেখতে হয়।’ মিঃ সেন উঠে দাঁড়িয়ে অন্য অফিসারকেও ডাকলেন, ‘আসুন, মিঃ ধর।’
‘কিসের পিপে জানবার জন্যে উঠে গিয়ে দেখতে হবে না।’ মামাবাবু মিঃ সেনকে থামালেন, ‘ও-পিপের মধ্যে কী আছে আমি জানি।’
‘আপনি জানেন!’ প্রথম অফিসার মিঃ ধর অবাক হয়ে মামাবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন করে?’
‘অনুমানে!’ মামাবাবু এবার একটু হাসলেন, ‘আর আমার অনুমান নির্ভুল বলেই ধরে নিতে পারেন।’
অফিসার দু’জনের মুখেই একটু বিরক্তির ভ্রুকুটি যেন ফুটে উঠল। মিঃ সেন জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনার অনুমানটা তাহলে শুনি। কী আছে ও পিপেয়?’
‘এপিল্যাক্‌না বোরিয়ালিস।’
‘কী!’
অফিসার দু’জনের সঙ্গে আমিও একরকম হতভম্ব। 
মিঃ সেনই প্রথম বেশ অপ্রসন্ন সুরে বললেন, ‘এ-সময়ে আপনার রসিকতার ঠিক তারিফ করতে পারছি না।’
‘রসিকতা আমি করছি না।’ মামাবাবুর গলা এবার বেশ গম্ভীর, ‘ও-পিপের মধ্যে এপিল্যাক্‌না বোরিয়ালিস আছে নিশ্চয়ই। আর একটা আধটা নয়, প্রায় এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার বলে মনে করি।’
একটু চুপ করে থেকে বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে মিঃ ধর ভূরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এপিল্যাক্‌না বোরিয়ালিস মানে একরকম পোকা?’
‘হ্যাঁ, কক্‌সিনেল্লিডি বংশের পোকা। বৈজ্ঞানিক নামটা দাঁতভাঙা হলেও এটা সোজা নাম আছে। ইংরেজিতে বলে “লেবি-বার্ড”। আমাদের দেশে বিদঘুটে বদগন্ধের পোকা বলেই আমরা জানি।’
‘কিন্তু ওই পোকা-ভরা পিপে আপনার বাড়িতে রেখে যাওয়ার মানে কী?’ সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন মিঃ সেন, ‘শেষরাত্রে দোতলার জানলা ভেঙে চোর ঢোকার সঙ্গেই বা এর সম্পর্ক কী?’
মামাবাবু একটু যেন দুঃখের সঙ্গেই বললেন, ‘এসব প্রশ্নের জবাব আপনাদেরই খুঁজে বার করা উচিত নয় কি?’
‘হ্যাঁ, তাই করব।’ মিঃ ধর একটু রাগের স্বরেই বললেন, ‘আপনার একটু অসুবিধে করার জন্যে মাপ চাইছি। এ-বাড়ির ভেতর এখনও কাউকে পাওয়া যায়নি। ভেতরের অনুসন্ধান এখন বন্ধ থাকলেও বাইরে পুলিশ পাহারা ঠিকই থাকবে। আর আপনাকে ও মিঃ ভোরাকে হয়তো একবার কষ্ট করে লালবাজার যেতে হতে পারে। আপনার চাকরকে এখন একটু নিয়ে যেতে পারি?’
‘দরকার বোধ করলে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবেন।’ মামাবাবু একটু যেন অনিচ্ছার সঙ্গে সম্মতি দিলেন, ‘কিন্তু ও তো সারারাত বাড়ির ভেতরেই ছিল। ভেতর থেকে বাড়ির দরজা বন্ধ ছিল, তারও প্রমাণ আপনারা পেয়েছেন।’
‘তা পেয়েছি, তবু দু-চারটে প্রশ্ন করে ওর জবানবন্দীটা নিতে চাই। এ-চাকর তো আপনার বিশ্বাসী পুরোনো লোক?’ জিজ্ঞেস করলেন মিঃ ধর।
‘অবিশ্বাসের কোনও কারণ তো এখনও পাইনি।’ মামাবাবু জানালেন, ‘তবে পুরোনো লোক নয়, আমার আগেকার চাকর ছুটি নিয়ে চলে যাওয়ায় একমাস হল কাজ করছে।’
‘মাত্র একমাস কাজ করছে!’ মিঃ ধর একটু ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একমাসে একটা লোককে কি চেনা যায়?’
‘একমাসে যেমন যায় না তেমনই কখনও কখনও সারাজীবনেও নয়।’ মামাবাবু হেসে বললেন, ‘তবে একমাসের মধ্যে সন্দেহ করবার মতো কিছু পাইনি সেই কথাই জানাচ্ছি। তা ছাড়া আজকের যে-ব্যাপার নিয়ে আপনারা মাথা ঘামাচ্ছেন তার সঙ্গে ওর কোন সম্পর্ক আছে ভাবতে আজগুবি বলে মনে হয়। প্রথমত, ওই দু’মনি বপু নিয়ে রঘুবীরের দড়ি বেয়ে দোতলার জানলায় ওঠাই অসম্ভব। দ্বিতীয়ত, আমার ঘরে একটা অদ্ভুত পোকা-ভরা পিপে এনে রাখবার মতো মানুষ ওকে মনে হয় কি?’
‘হুঁঃ।’ বলে গম্ভীরভাবে খানিক্ষণ চুপ করে থেকে মিঃ ধর তাঁর সঙ্গীকে নিয়ে নমস্কার করে বেশ যেন একটু অপ্রসন্ন মেজাজেই চলে গেলেন। 
‘এসব কী ব্যাপার, মামাবাবু?’ অফিসাররা চলে যাওয়ার পর ভৎসনার সুরেই একবার বললাম, ‘দু’মাস মাত্র বাইরে গেছি। এর মধ্যে এসব কী বিদঘুটে কাণ্ড বাধিয়ে বসেছ! মঙপো বাড়িতে থাকলেও এসব কাণ্ড বোধহয় হতে পারত না। সে ছুটি নিয়ে গেছে শুনেই তো অবাক লাগছে। এতকাল তোমার কাছে আছে। মঙপোকে তো কদিনের জন্যেও কখনও ছুটি নিতে দেখিনি।’
‘কখনও যা হয়নি তা আর হবে না এমন কোনও কথা আছে কি? মামাবাবু হাসলেন: ‘আমার দোতলার ঘরের জানলা বেয়ে কাউকে কোনওদিন ঢুকতে কেউ এর আগে দেখেছে কি? না, আমার ঘরে আচমকা অদ্ভুত পোকার পিপে পাওয়া গেছে!’
‘সত্যি, সমস্ত ব্যাপারটা তো আজগুবি বলেই মনে হয়। দড়ি বেয়ে জানলা দিয়ে একটা লোক ঢুকল অথচ বন্ধ বাড়ি থেকে বেরুল না। কোথা থেকে একটা অদ্ভুত পোকার পিপে তোমার ঘরের মধ্যে রাখা। এসব রহস্যের কোনও মানে থাকতে পারে তাই তো ভাবতে পারছি না।’
‘রহস্য যতই গভীরই হোক একটা মানে নিশ্চয়ই আছে।’ মামাবাবু যেন দার্শনিক মন্তব্য করলেন।
‘মানে কিছু খুঁজে পেয়েছ?’ সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলাম।
‘মানেটা যথাসময়ে আপনা থেকে প্রকাশ পাবে। সেই অপেক্ষাতেই আছি। আসুন আসুন, মিঃ ভোরা।’
মামাবাবু অসংলগ্ন কথাগুলোতে প্রথমে একটু হতভম্ব হলেও পিছনে চেয়ে মামাবাবুর হঠাৎ অভ্যর্থিত মানুষটিকে দেখতে পেলাম।
মাঝবয়েসী বেশ লম্বা-চওড়া এক ভদ্রলোক। পরণে দামী সাহেবী স্যুট। মাথায় শুধু দেশি গোল টুপি। চেহারায় পোশাকে সম্ভ্রান্ত সমৃদ্ধির স্পষ্ট ছাপ।
অত্যন্ত উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে এসে তিনি বললেন, ‘বিশেষ জরুরি কাজে সেই সময়টাতেই বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। চেষ্টা করেও তাড়াতাড়ি ফিরতে পারলাম না। পুলিশ কিছু হদিস পেয়েছে কি?’
‘পেয়ে থাকলেও আমায় অন্তত জানায়নি।’ মামাবাবু একটু হেসে বললেন, ‘শুধু আমার চাকরটিকে থানায় নিয়ে গিয়ে আমায় অসহায় করে গেছে। আপনাকে এক কাপ কফিও খাওয়াতে পারব না।’
‘না, না, কফির আমার দরকার নেই।’ মিঃ ভোরা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন: ‘কিন্তু আপনার চাকর, মানে, রঘুবীরকে থানায় নিয়ে যাওয়ার মানে! সে তো নেহাত নিরীহ ভালোমানুষ। দরজা বন্ধ করে সে যে বাড়ির ভেতরেই ছিল তারও প্রমাণ আছে!’
‘কিন্তু সে প্রমাণেও তো ফাঁকি থাকতে পারে।’ মিঃ ভোরার সঙ্গে পরিচিত না হলেও অনাহুত ভাবেই না বলে পারলাম না।
‘কী ফাঁকি?’ মিঃ ভোরা একটু ভ্রুকুটিভরে আমার দিকে চাইলেন।
‘দোতলার জানলা দিয়ে যে ঢুকেছিল তাকে রঘুবীরই নিচের দরজা খুলে প্রথমে বার করে দিয়ে তারপর দরজা বন্ধ করে রেখেছে েএরকম হওয়া তো সম্ভব।’ আমার সংশয়টা খুলে বললাম। 
‘না, তা সম্ভব নয়।’ মামাবাবু আমার কথাটা তাচ্ছিল্যভরেই উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘প্রথমত, কোনও লোক যদি সত্যি ঢুকে থাকে তাহলে পিছনের জানলা দিয়ে তাকে ‍ঢুকতে দেখে মিঃ ভোরার সামনের দরজায় আসতে যেটুকু সময় লেগেছে তার মধ্যে ওপর থেকে গরাদেতে বাঁধা দড়ি খুলে তুলে রেখে নিচে নেমে এসে বেরিয়ে যাওয়া কারুর পক্ষে সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, রঘুবীরকে ওরকম অবিশ্বাস করাই যায় না। রঘুবীর মিঃ ভোরার বহুদিনের বিশ্বাসী চাকর। মঙপো ছুটিতে চলে যাওয়ায় মিঃ ভোরাই রঘুবীরকে আমায় দিয়েছেন।’
মিঃ ভোরা একটু কুন্ঠিতভাবে বললেন, ‘দেখুন, মানুষ সম্বন্ধে কিছুই অবশ্য বলা যায় না। কিন্তু আমার কাছে বহুদিনের বিশ্বাস রেখে কাজ করেছে বলেই রঘুবীরকে নিশ্চিন্তমনে আপনাকে দিয়েছিলাম। আমার বাগানে প্রায় দশ বছর ধরে ও দারোয়ানি করেছে।’
‘হ্যাঁ, বাগান বলতে মনে পড়ল, মিঃ ভোরা।’ মামাবাবু যেন ইচ্ছে করেই আমার বেয়াদপিটা ভোলাবার জন্যে অন্য কথা তুললেন, ‘আমার বন্ধু চালিহার কাল আবার একটা চিঠি পেয়েছি। এখন তো সে তার সমস্ত বাগান বিক্রি করতেই চায়। আপনি যে-দাম দিতে চেয়েছিলেন তাতেই রাজি।’
‘কিন্তু আমি যে আর রাজি হতে পারছি না।’ মিঃ ভোরা মুখখানা কেমন করুণ করে বললেন, ‘বছর বছর ওখানকার বাগানের কী হাল হচ্ছে দেখছেন তো! ফল ধরছেই না। ধরলেও শুকিয়ে যাচ্ছে। লাভের বদলে তাই শুধু লোকসানই গুনছি সবাই। এখন ঘরের পয়সা বার করে নতুন বাগান কেনা মানে ভস্মে ঘি ঢালা নয় কি?’
‘ওসব বাগানের দাম আরও তাহলে পড়ে যাব মনে করুন।’ মামাবাবু চিন্তিতভাবে মিঃ ভোরার দিকে তাকালেন: ‘কিন্তু বাগানগুলোর বাঁচাবার জন্যে আপনি তো অনেক কিছু করছেন শুনছি। বিদেশ থেকে ওষুধপত্র, আরও কত কী, আমদানিও করেছেন!’
‘তা করেছি, কিন্তু ফল তো কিছু পাচ্ছি না।’ মিঃ ভোরা বিষণ্ন ‍মুখে বললেন, ‘আপনার বন্ধু মিঃ চালিহাকেই জিজ্ঞেস করে দেখবেন। আমি যা যা আনিয়েছি তা তো তাঁকেও ব্যবহার করতে দিয়েছি।’
‘হ্যাঁ, তা দিয়েছেন বটে। চালিহা সেজন্যে কৃতজ্ঞতােই জানিয়েছে....’
মামাবাবু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এ-বাড়ির দুর্ভেদ্য রহস্যের প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে কোথাকার কোন বাগানের লাভ-লোকসানের জোলো আলোচনায় তখন আমার মেজাজ বিগড়ে গেছে। বিরক্ত হয়ে বাধা দিয়ে বললাম, ‘তোমাদের বাগানের আলোচনাই তাহলে চলুক। আমি উঠছি।’
‘আহা, উঠবি কেন এর মধ্যেই!’ মামাবাবু বেশ লজ্জিত হয়ে পড়লেন: ‘বাগানের আলোচনা আর করব না। তবে কিসের বাগান জানলে অতটা ব্যাজার বোধ হয় হতিস না। এসব কমলালেবুর বাগান, বুঝেছিস। আসামের সেরা কমলা!’
আমার মুখের ভাবটা লক্ষ করে তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে মামাবাবু আবার বললেন, ‘তা সে কমলা বাগানের কথাও এখন থাক। নিজের চোখেই যখন দু’দিন বাদে দেখতে যাচ্ছিস তখন মুখের আলোচনার দরকার কী?’
বিরক্তি থেকে একেবারে বিমূঢ়তায় পৌঁছে অবাক হয়ে মামাবাবুর দিকে তাকালাম। মিঃ ভোরার অবস্থাও আমার মতো।
তিনিই প্রথম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি সত্যিই কমলা বাগান দেখতে আসাম যাচ্ছেন নাকি?’
‘হ্যাঁ,’ মামাবাবু নেহাত যেন নিরুপায় হয়ে বললেন, ‘বাগান যখন বিক্রিই হবে না, তখন বন্ধুকে একটু সান্তনা দেওয়ার জন্যেও যাওয়া দরকার।’
একটু থেমে ভূলে যাওয়া কর্তব্যটা একক্ষণে স্মরণ করে মামাবাবু আমায় দেখিয়ে আবার বললেন, ‘আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে ভুলে গেছি, মিঃ ভোরা। এটি আমার ভাগনে, গণপতি হাজরা নামে পরিচিত। ওকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।’
কথা বলব কী, আমার গলায় তখন আর আওয়াজ নেই।

দু’দিন নয়, মামাবাবু নানা অজানা ধান্ধায় লালবাজার থেকে কাস্টম্‌স অফিস পর্যন্ত ঘোরাঘুরির পর, প্রায় দিন সাতেক বাদে সত্যিই ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স কর্পোরেশনের প্লেনে দমদম থেকে ‍গুয়াহাটি, আর সেখান থেকে সারাদিন মোটর হাঁকিয়ে মামাবাবুর বন্ধু মিঃ চালিহার বিশাল কমলালেবুর বাগানের অফিসবাড়িতে গিয়ে উঠলাম।
সারাদিন ধকলের পর যে একটু বিশ্রাম করব তারও সুবিধে হল না। চালিহার কাছে জানা গেল তাঁর প্রতিবেশী মিঃ ভোরাও নিজের বাগানে দু’দিন আগে এসেছেন। শুনে মামাবাবুর প্রীতি একেবারে উথলে উঠল। তখনই মিঃ ভোরার সঙ্গে দেখা করতে না গেলেই নয়। 
নিরুপায় হয়ে মিঃ চালিহার একটি জিপে মামাবাবুর সঙ্গী হতে হল। প্রায় মাইল দশেক পাহাড়ী রাস্তায় জিপ চালিয়ে মিঃ ভোরার বাগানে যখন পৌঁছলাম তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। 
মিঃ ভোরার কাঁটাতার-ঘেরা বাগানের গেট বন্ধ। 
বিরক্তিটা অনেক্ষণ ধরেই মনে মনে জমা হচ্ছিল। এবার সেটা আর প্রকাশ না করে পারলাম না। বলালাম, ‘এই পাহাড় জঙ্গলের দেশে এটা কি মানুষের সঙ্গে দেখা করতে আসার সময়? গেট তো বন্ধ দেখছ। মিঃ ভোরার এখন বোধহয় অর্ধেক রাত। চলো, ফিরে চলো।’
মামাবাবু নির্বিকার। জিপের হেডলাইটটা সামনে জ্বেলে রেখে তারস্বরে ইলেকট্রিক হর্ণ বাজিয়েই চললেন। 
উপায় থাকলে জিপ থেকে রাগের চোটে নেমেই যেতাম। তার বদলে জোর করে ইলেকট্রিক হর্ণ থেকে মামাবাবুর হাতটা সরাতে যাচ্ছি, এমন সময় গেটের উপর থেকেই কে যেন বিকট ভারি গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘কে আপনারা? কী চান?’
প্রথমটা চমকে উঠলেও তৎক্ষণাৎ ব্যাপারটা বুঝলাম। গেটের ঠিক মাথাতেই একটা লাউডস্পিকারের চোঙা লাগানো। আগে সেটা চোখে পড়েনি। আওয়াজটা তার ভেতর দিয়েই আসছে। 
মামাবাবু চিৎকার করে এবার নিজের পরিচয় দিয়ে জানালেন, মিঃ ভোরার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। 
খানিক্ষণ তারপর কোনও সাড়াশব্দ কোথাও নো পেয়ে মনে হল মামাবাবুর  বাড়াবাড়ির উচিৎ শিক্ষাই বুঝি হবে। কিন্তু তার পরেই গেটটা আপনা থেকে খুলতে শুরু করল। বোঝা গেল সেটা ইলেকট্রিক তারের সাহায্যে খোলে ও বন্ধ হয়। লাউডস্পিকারের চোঙা থেকেও এবার শোনা গেল, ‘গাড়ি নিয়ে ভেতরে আসুন।’
যান্ত্রিক অভ্যর্থনাটা একটু কড়া গোছের হলেও মিঃ ভোরার নিজের অভ্যর্থনাটা অত্যন্ত উচ্ছ্বসিত। তাঁর চমৎকার বাংলো-বাড়ির সুসিজ্জিত বসবার ঘরে আমাদের সাদরে বসিয়ে তিনি আনন্দে গদগদ হয়ে বললেন, ‘সত্যিই আপনারা আসবেন আমি ভাবতে পারিনি। এত রাত্রে গেটে হর্ণের আওয়াজ পেয়ে আমি তো প্রথমটা একটু ভড়কেই গেছিলাম। এত রাত্রে এ-অঞ্চলে-’
‘হ্যাঁ, আমাদের আসাটা একটু অসময়েই হয়ে গেছে।’ মামাবাবু লজ্জিতভাবে স্বীকার করলেন, ‘কিন্তু আপনার জন্যে যে-উপহারটা এনেছি সেটা দেওয়ার আগ্রহে সকাল পর্যন্ত আর সবুর করতে পারলাম না।’
‘আমার জন্যে উপহার এনেছেন!’ মিঃ ভোরার মুখে আনন্দের চেয়ে বিস্ময় বেশি, ‘কী উপহার?’
‘সেটা খানিক বাদেই জানতে পারবেন।’ মামাবাবু হাসিমুখে বললেন, ‘এখন সেটা জিপেই রেখে এসেছি।’
মামাবাবুর কথা শুনে আমিও অবশ্য কম বিস্মিত হইনি। জিপে একটা কার্ডবোর্ডের বড় বাক্স মামাবাবু সঙ্গে এনেছেন অবশ্য দেখেছি। প্লেনে আসবার সময়ও সেটা তাঁর কাছেই ছিল। সেটা যে মিঃ ভোরাকে উপহার দেওয়ার জন্য আনা তা অবশ্য ভাবতে পারিনি। কী সেটা হতে পারে তাও বুঝতে পারলাম না। 
আমর চেয়ে মিঃ ভোরার কৌতুলহ আরও বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। তিনি বেশ একটু অধীর হয়েই বললেন, ‘উপহার এনে আবার জিপে রেখে এলেন কেন?’
‘উপহার দেওয়ার আগে একটু ভণিতা করবার জন্যে, সেইসঙ্গে একটা প্রস্তাব করবার জন্যেও।’ মামাবাবু মধুরভাবে হেসে বললেন, ‘শুনুন, মিঃ ভোরা। আপনাদের এ-অঞ্চলের কমলা বাগানের দুর্দশার কথা শোনবার পর থেকেই এ-বিষয় নিয়ে আমি ভাবছি। ভেবে ভেবে আর পড়াশুনো করে এ দুর্দশা ঘোচাবার একটা উপায় আমি বার করে ফেলেছি।’
‘বলেন কী!’ মিঃ ভোরার গলার স্মরে সামান্য একটু যেন বিদ্রুপের আভাস পেলাম। তার জন্যে তাঁকে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। এমন বেয়াড়া সময়ে উপহার দেওয়ার নামে এই ভণিতা আমারও তখন খুব ভালো লাগছে না। 
মামাবাবুর কিন্তু কিছুতেই ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজের উৎসাহে বলে চললেন, ‘হ্যাঁ, মিঃ ভোরা। আপনি জানেন নিশ্চয়ই যে, আজ পৃথিবীর নানা অঞ্চলে যে-কমলালেবুর এত আদর তার আদি জন্মভূমি এই ভারত বলেই বৈজ্ঞানিকরা সন্ধান করে জেনেছেন। যেখান থেকে এ ফল সমস্ত দুনিয়া পেয়েছে সেই ভারতেই কমলার চাষ নষ্ট হয়ে যাবে এর চেয়ে লজ্জার কিছু নেই। কমলাগাছের নানারকম শত্রু আছে। এ-অঞ্চলে যে-শত্রুতে সমস্ত বাগান ছারখার করছে তা প্রধানত হল অ্যাফিড জাতীয় পোকা। পোকা মারার রাসায়নিক ওষুধ দিয়ে তাদের ধ্বংস করবার চেষ্টা করা যায়, কিন্তু সেসব ব্যবহারে মানুষেরও কিছু আনুষাঙ্গিক কুফলের ভয় আছে। ইওরোপ আমেরিকাতে পর্যন্ত কীটপতঙ্গ-নাশক রাসায়নিক ওষুধের বিরুদ্ধে একটা আন্দোলন তাই শুরু হয়ে গেছে। রাসায়নিক ওষুধের চেয়ে অ্যাফিড নির্মূল করবার অনেক সহজ নিরাপদ উপায় কিন্তু আছে। সেই উপায়ের কথাই আপনাকে প্রথম বলব।’
মিঃ ভোরা একটু যে হাই তুললেন তা আমার দৃষ্টি না এড়ালেও মামাবাবুর নজরেই পড়ল না। তিনি সোৎসাহে বলে চললেন, ‘যে-উপায়কে এক হিসেবে ষাঁড়ের শত্রু বাঘ দিয়ে খাওয়ানো বলা যায়। পোকাদের coleoptera বিভাগের coccinellidae বংশের একটি জাতের পোকা আছে ইংরেজিতে যার বাহারে নাম লেডি-বার্ড। এই লেডি-বার্ড পোকা অ্যাফিড জাতীয় পোকার যম। এই লেডি-বার্ডেরও অবশ্য প্রায় তিনহাজার শাখা আছে। ফলের বাগানের শত্রু-পোকা ধ্বংসের জন্যে এই লেডি-বার্ড ব্যবহার করে নানা দেশে, বিশেষ করে ক্যালিফোর্ণিয়ার, আশ্চর্য ফল পাওয়া গেছে। লেডি-বার্ড এখন তাই কোটি কোটি বিক্রি হয়। শীতকালে এ পোকা জড়ভরত হয়ে ঘুমায়। সে-সময়ে এদের সংগ্রহ করে তারপর পিপেয় ভরে খরিদ্দারদের কাছে পাঠানো হয়। একটা এক গ্যালনের পিপেতে প্রায় এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার পোকা ধরে। একজন বিদেশি ব্যবসাদারের কথা জানি ‍যিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় চারশো কোটি লেডি-বার্ড বিক্রি করেছেন। এই লেডি-বার্ডই আপনাদের কমলা বাগানের মুশকিল আসান। ইনসেক্‌টিসাইড রাসায়নিক ওষুধের বদলে এই লেডি-বার্ড কিনে আপনাদের বাগানে ছাড়ুন।’
মিঃ ভোরা এবার স্পষ্টই হাই তুলে বেশ একটু কৌতুকের স্বরে বললেন, ‘আপনার মুশকিল আসানের দাওয়াইয়ের জন্যে ধন্যবাদ। কিন্তু দাওয়াইটার কি আপনিই প্রথম সন্ধান পেয়েছেন মনে করেন? তাহলে বলি শুনুন, আজ দু’বছর ধরে অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, এমন কি আমেরিকা থেকে এই লেডি-বার্ডই লক্ষ লক্ষ আমদানি করেছি।’
‘তাই নাকি?’ মামাবাবুকে অত্যন্ত অপ্রস্তুত মনে হল, ‘আমি মায়ের কাছে মাসির গল্প করতে এসেছিলাম। ছিঃ  ছিঃ, আমার উপহারটাই মাটি হয়ে গেল দেখছি।’
‘আপনি কি আমার জন্যে লেডি-বার্ডই এনেছিলেন নাকি?’ মিঃ ভোরা এবার হেসে উঠলেন: ‘তা এনেছেন যখন দিয়ে যান। অতিকন্তু ন দোষায়।’
‘হ্যাঁ, এনেছি যখন দিয়ে যেতেই হবে।’ মামাবাবু একটু যেন করুণ সুরে বললেন, ‘কিন্তু তার আগে যে-প্রস্তাবের কথা বলেছিলাম সেটা সেরে নিই।’
‘প্রস্তাব আবার কী?’ মিঃ ভোরার মুখে বিদ্রুপ-মেশানো কৌতুক।
‘আপনি আমার বন্ধু চালিহার বাগান আর কিনতে চান না তো?’ মামাবাবু যেন কুন্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘না, সে-কথা তো আগেই বলেছি।’ মিঃ ভোরার গলায় একটু অধৈর্য প্রকাশ পেল, ‘জলের দরে ও বাগান কেনাও তো এখন লোকসান।’
‘হুঁ,’ মামাবাবু আবার যেন দ্বিধাভরে বললেন, ‘তাই আমি চালিহার হয়ে আপনার বাগানটাই কিনতে এসেছি।’
‘আমার বাগান। আমার বাগান কিনতে চায় চালিহা!’ মিঃ ভোরার মুখটা কয়েক মুহূর্তের জন্যে হিংস্র হয়ে উঠে আবার বিদ্রুপের হাসিতে বাঁকা হয়ে উঠল: আমার বাগান আমি বিক্রি করব কেন?’
‘করবেন, আপনার বাগানেরও জলের দর হতে পারে বলে! মামাবাবুর গলা হঠাৎই গম্ভীর।
‘মাপ করবেন,’ মিঃ ভোরা তীক্ষ্ম স্বরে বললেন, ‘রাত অনেক হয়েছে, আপনার প্রলাপ শোনবার আমার সময় নেই।’
‘সময় যদি না থাকে তাহলে আমি নাচার,’ মামাবাবু যেন লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘চলুন, আমার উপহারটা তাহলে নেবেন চলুন।’
‘আমাকে যেতে হবে না। আমার লোক দিয়েই আনিয়ে নিচ্ছি।’ মিঃ ভোরার গলায় এখন আর খুব সৌজন্য নেই।
‘না, না, তা কি হয়!’ মামাবাবু যেন মিনতি করলেন, ‘উপহারের মর্যাদাটা অন্তত রাখুন।’
‘বেশ, চলুন,’ মিঃ ভোরা বিরক্তিভরেই উঠলেন।
ঘর থেকে বারান্দা পেরিয়ে নিচে গিয়ে জিপ থেকে কার্ডবোর্ডের বাক্সটা খুলেই মামাবাবু প্রায় যেন আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘এ কী ব্যাপার!’
গত কয়েক মিনিটের কথাবার্তায় মাথাটা কেমন গুলিয়েই ছিল, মামাবাবুর হঠাৎ এই আর্তনাদে একবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম।
‘কী হল কী মামাবাবু?’ জিজ্ঞেস করলাম দিশেহারা হয়ে।
‘ফুটো দিয়ে সব বেরিয়ে গেছে।’ মামাবাবুর হতাশ চেহারা : ‘অথচ এ-বাগানে ঢোকা পর্যন্ত কোথাও ফুটো ছিল না আমি জানি।’
‘কী বেরিয়ে গেছে!’ মিঃ ভোরা ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘ওগুলো বেরিয়ে আমার বাগানেই ছড়িয়ে গেছে এতক্ষণে।’
‘তবু নিজের হাতে আপনাকে দিতে পারলাম না।’ মামাবাবুকে অত্যন্ত দুঃখিত মনে হল : ‘ওগুলো ঠিক সাধারণ লেডি-বার্ড তো নয়। বিশেষ জাতের।’
‘বিশেষ জাতের!’ মিঃ ভোরার গলায় স্বর হঠাৎ তীক্ষ্ম হয়ে উঠল।
‘হ্যাঁ,’ মামাবাবু যেন কাতরভাবে বললেন, ‘আমেরিকা থেকে স্পেশাল অর্ডার দিয়ে আনিয়ে আপনার প্রতিবেশী মিঃ চালিহাকে তাঁর বাগানে ছাড়বার জন্যে যা আপনি উদারভাবে সরবরাহ করেছেন গত এক বছর, এ সেই বিশেষ জাতের লেডি-বার্ড, এপিল্যাক্‌না বোরিয়ালিস!’
‘আপনি-আপনি।’ মিঃ ভোরার মুখ দিয়ে যেন ফেনা উঠবে মনে হল : ‘আপনি আমার বাগানে ওই পোকা ছেড়েছেন। ইচ্ছে করে পিপের জালে ফুটো করে এনেছেন ওই পোকা ছাড়বার জন্যে!’
‘আজ্ঞে, উপকারের প্রতিদান তো দিতে হয়!’ মামাবাবু বিনয়ের অবতার: ‘আমার বন্ধু চালিহার জন্যে আপনি যা করেছেন তার একটু শোধ না দিলে চলে? এক লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার আন্দাজ ওই পোকা আপনার বাগানে এতক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে। লক্ষ থেকে কোটি হতে ওদের আর দেরি হবে? আপনার এ-বাগান জলের দরে নামতেই বা কতক্ষণ। লেডি-বার্ডের মধ্যে ওই বিশেষ জাতের পোকাই উপকারের বদলে চরম সর্বনাশ করে। ক্যালিফোর্ণিয়ায় বড় বড় বাগান এক সময়ে ওই পোকার উৎপাতে ছারখার হয়ে গেছল। কিন্তু আপনাকে এসব বলে আমার মায়ের কাছে মাসির গল্প করছি। আপনাকে এসব বলে আবার মায়ের কাছে মাসির গল্প করছি। আপনি সব জেনেশুনেই আশপাশের সমস্ত বাগানের দর নামিয়ে সস্তায় কিনে নেওয়ার ফন্দিতেই তো সাহায্যের ছলে ওই পোকা অন্যদের এতদিন বিলিয়েছেন!’
মিঃ ভোরার তখন প্রায় হাত-পা খিঁচে ফিট হওয়ার অবস্থা। হিংস্র চিৎকার করে বললেন, ‘আপনাকে আমি গুলি করব। আমার ও-গেট যে বিদ্যুতের সাহায্য ছাড়া খোলে না বা বন্ধ হয় না, তা দেখেছেন। বেরুবার উপায় আপনার নেই। আমার বাগানে চুরি করে ঢুকেছেন বলে আমি আপনাকে গুলি করে মারব।’
‘না, না, ওসব হাঙ্গামায় যাবেন না।’ মামাবাবুর গলা স্নিগ্ধ শান্ত : ‘আহাম্মকের মতো নেহাত অসহায়ভাবে কি আপনার বাগানে ঢুকেছি মনে করেন? লালবাজার মারফত আসাম পুলিশকে সব জানিয়ে তবেই এখানে ঢুকেছি। গেটের বাইরে একটু চেয়ে দেখুন, পুলিশ জিপের হেডলাইটগুলোও তাহলে দেখতে পাবেন। আচ্ছা, নমস্কার। সুবোধ ছেলের মতো গেটটা খোলার ব্যবস্থা করুন গিয়ে!’

মামাবাবুর সঙ্গে জিপে চালিহার বাগানে ফিরতে ফিরতে হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর সবই তো বুঝলাম। কিন্তু ওই এপিল্যাক্‌না বোরিয়ালিস পোকার পিতে তোমার নিচের ঘরে কোথা থেকে এল? আনলই বা কে?’
‘এল আর কোথা থেকে?’ মামাবাবু হাসলেন : ‘ওই মিঃ ভোরাই বাড়িরই গোপন গোডাউন থেকে।’
‘তার মানে তোমার জানলায় দড়ি বেয়ে যে উঠেছিল সে-ই ওই পিপেটা চুরি করে এনেছিল? কিন্তু সে কে! সে বন্ধ বাড়ি থেকে উধাও হলই বা কেমন করে?’
‘শক্ত মানের বদলে সোজা মানেটা খুঁজলেই বুঝবি।’
‘যেমন?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘যেমন সে-লোকটা বাইরের কেউ নয়, বাড়িরই লোক। সুতরাং উধাও সে হয়নি, বাড়িতেই ছিল।’
‘তার মানে?’ সবিস্ময়ে বলে উঠলাম, ‘তার মানে রঘুবীর যখন হতে পারে না, তখন তখন তুমিই পিপেটা চুরি করে জানলা বেয়ে উঠেছিলে। কিন্তু জানলা বেয়ে কেন? নিচের দরজা দিয়ে ঢুকলে কী হত?’
‘ঢুকলে রঘুবীর জানতে পারত। সে ভোরার চর। আমি চালিহার বাগানের ব্যাপারে মনোযোগ দিয়েছি জেনে ভোরা আমার ওপর পাহারা রাখতে চেয়েছিল। আমি ইচ্ছে করেই মঙপোকে বুঝিয়ে কিছুদিনের জন্যে সরিয়ে দিয়ে ভোরার দেওয়া লোক নিয়েছিলাম তার বিশ্বাস জাগাবার জন্যে।’
এরপর আমার পক্ষে নির্বাক হওয়াই স্বাভাবিক নয় কি?