পিয়ার আলী বৃদ্ধাশ্রম

মোঃ আশরাফুল ইসলাম (চাঁদ)


বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। আর বিশ্বাস যে এতবড় সম্পদ। বাস্তব প্রতিফলন দেখে একেবারে হতবাক। ব্যাংক থেকে পেনশন নিয়ে থাকি। পেনশন নিতে গিয়ে দেখি এক বৃদ্ধ সে চোখে দেখতে পায় না। তার সাথে আসা মহিলা তার হাত ধরে নিয়ে এসে ওয়েটিং সিটে বসিয়ে রেখে চেক বই খানা ব্যাংক এর এক স্টাফ কে দিয়ে মহিলা বৃদ্ধের পাশে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। সে যে চোখে দেখতে পায় না তার চোখ দেখে বুঝার উপায় নাই। এরই মধ্যে টাকা উত্তোলনের প্রক্রিয়া শেষে ব্যাংক এর সেই স্টাফ টাকা এনে বৃদ্ধের হাতে দেয়। বৃদ্ধ ঐ ভাবেই টাকা গুলো বৃদ্ধা মহিলার কাছে দিয়ে দেয়। মহিলা টাকা গুলো শাড়ির আঁচলে শক্ত করে বেঁধে তারা চলে যায়। টাকা গুলো গুণে পর্যন্ত দেখে না। বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধার এমন বিশ্বাসের উপর ভর করে সাবলিল ভাবে বেরিয়ে যেতে দেখে একটা কৌতুহলী প্রশ্ন জেগে উঠলো মনে। আমাকে জানতে হবে ঐ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সম্পর্কে


এক মাসে আমার পেনশনের টাকা নিয়ে বসে থাকি ঐ বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা মহিলার আসার অপেক্ষায়। একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি তারা একটা নিদৃষ্ট দিনে এমনকি নিদৃষ্ট সময়ে এসে থাকেন। সেদিনও তারা ঐ একই সময়ের মধ্যে এসে চেক বই খানা ঐ ব্যাংক স্টাফ এর হাতে দিয়ে ওয়েটিং সিটে বসে অপেক্ষা করতে থাকেন। টাকা উত্তোলন প্রক্রিয়া শেষে পূ্র্বের ন্যায় টাকা গুলো তাদের হাতে দিলেন। বৃদ্ধা মহিলা টাকা গুলো যথানিয়মে হেফাজত করে চলে যাচ্ছেন সে সময় আমিও পিছু নিলাম। আমাকে জানতে হবে এই বৃদ্ধ চোখে দেখতে পায় না তার উপর বৃদ্ধাও টাকা গুলো গুণে পর্যন্ত দেখে না। এর কারণ টা কী? ব্যাংক থেকে বের হয়ে বৃদ্ধা মহিলাকে জিঙ্গেস করলাম আপনারা কোথায় যাবেন ?

বৃদ্ধ বলে উঠলো, কে গো আমাদের কথা জিঙ্গেস করছে? আমাদের সম্পর্কে জানতে চাইছে?

আমি নিজেই বলে উঠলাম। আমাকে আপনারা চিনবেন না। আর আমিও আপনাদেরকে চিনি না। আমি সুজন। আপনাদের সাথে আমি কিছু কথা বলতে চাই যদি অনুমতি দেন বা আপনাদের হাতে সময় থাকে

বৃদ্ধ আবার বলে উঠলেন দেখুন আপনাকে চিনি না জানি না, কী বলে সন্মোধন করবো জানি না। তার উপর আমি চোখে ভালো দেখতে পাই না

বললাম বয়সে হয়তো সমসাময়িক হবো আমাকে ভাই বলে সন্মোধন করতে পারেন

বৃদ্ধ বললেন চলুন কোথাও বসি। আর সময়ের কথা বললেন না? সময়টাকে তো এখন দু'হাত দিয়ে ঠেলে সরাচ্ছি। কখন আল্লাহ্পাক এই দুর্বিসহ জীবন থেকে রেহায় দেবে। খাওয়া পরার কোনো চিন্তা নেই। চিন্তা কেবলই এই অন্ধত্বের বোঝা আর কতো বয়ে বেড়াবে বৃদ্ধা বয়সে আমার এই বুড়ি। বৃদ্ধা বলে উঠলো, ওগো এমন কথা তুমি বলো না। সেই যে কবে আমার বাবা তোমার হাতে আমার হাত রেখে বলেছিলেন আজ থেকে তোমরা দু'জন দু'জনের। একে অন্যের আপদে বিপদে সঙ্গের সাথী। ওগো অমন কথা তুমি আর কখনও বলো না

বৃদ্ধার কথা শুনে আমি একেবারে হতবাক। কতখানি বিশ্বাস, ভক্তি ও ভালোবাসা থাকলে এমন কথা বলতে পারে। ইতমধ্যে একটা হোটেলের এক কোণে একটা ফাঁকা টেবিলে কিছু নাস্তার অর্ডার দিয়ে তিন জন বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের ছেলে মেয়ে নেইতারাতো আপনাদের সাথে আসতে পারে। তাছাড়া একজন অপরিচিত লোক দিয়ে টাকা উঠান। সেই টাকা গুলো গুণে পর্যন্ত দেখেন না

বৃদ্ধ বলেন কোনো সন্তানাদি আল্লাহ্পাক আমাদের দেয়নি ভাই। আর টাকার কথা বললেন না? আমাদের কোনো সন্তানাদি নেই, তবে একটা সম্পদ আছে যার বদৌলতে আজ পর্যন্ত টিকে আছি। তা হলো বিশ্বাস। এ ছাড়া আমাদের আর কছুই নেই। এই সামান্য টাকা গুলো থেকে কে কিইবা নেবে। বিশ্বাস আছে বলেইতো আজ পর্যন্ত কেউ আমাদের ঠকায়নি

জিজ্ঞেস করলাম কী চাকরী করতেন? পেনশন স্কিমে কত টাকা রেখেছেন যে সেই টাকাতে আপনাদের চলে যায়
বৃদ্ধ বলে একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী করতাম ভাই। আর পেনশন স্কিমের কথা বলছেন? না ভাই ব্যাংকের এ্যকাউন্টে আমাদের কোনো টাকা নেই

বললাম তাহলে যে প্রতি মাসে টাকা উঠান তা আসে কোথা থেকে? এরই মাঝে বৃদ্ধার কাছে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। বৃদ্ধা ফোনটা রিসিভ করে বলে উঠলো বাবু ফোন দিয়ছে। সে কথা বলতে থাকে.....হ্যাঁ বাবু টাকা টা ঠিকমত পেয়েছি। এখন আমরা এক হোটেলে বসে এক ভাই এর সাথে নাস্তা করছি আর কিছু কথাবার্তা বলছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই এখনই চলে যবো। তুমি কোনো চিন্তা করো না বাবু। আমরা আল্লাহ্'র রহমতে ভালো আছি। আচ্ছা রাখি, বলেই ফোনটা রেখে বলে উঠলো আচ্ছা আমরা এখন উঠি

আমার মনে আরও প্রশ্নের দানা বেঁধে উঠলো। বললাম ঐ যে বললেন আপনাদের কোনো সন্তানাদি নেই। তবে ঐ বাবু টা কে?

বৃদ্ধ তখন এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো সে এক করুন আশির্বাদের কাহিনি। এই অল্প সময়ের মধ্যে রেস্টুরেন্টে বসে বলা সম্ভব নয়। তবুও আপনি যখন শুনতে চাইছেন তখন সংক্ষেপে কিছু বলি। আমার বুড়ি সব সময় চিন্তা করতো। আমাদের কোনো সন্তানাদি হচ্ছে না। বুড়ো বয়সে আমাদেরকে, কে দেখাশুনা করবে। তুমি একটা দত্তক ছেলে বা মেয়ে নাও। আমি তাকে বুঝিয়ে বলতাম দেখো যিনি আমাদেরকে এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন তাঁর উপর বিশ্বাস বা ভরশা রাখো তিনিই আমাদের হেফাজত করবেন। একদিন ডিউটি শেষে বাড়ি আসছি।সেদিন ছিল আমার নাইট শিফট ডিউটি। আসতেই শুনি আবর্জনা স্তুপের মধ্যে থেকে ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ ভেসে আসছে। কাছে গিয়ে দেখি রক্তে ভেজা কাপড়ে জড়ানো মানুষের বাচ্চা। প্রথমে মনে হলোনা এটা মানুষের বাচ্চা হতে পারে না। কারণ, মানুষ যে, সে এমন কাজ করতে পারে না। হাতে নিয়ে দেখি না এটা আদম সন্তানই। মনে পড়ে গেল আমার বুড়ির কথা। সে একটা সন্তানের জন্য কতইনা ব্যাকুল। আর এমন মা। না তাকে মা বললে মা জাতির কলঙ্ক হবে। যে পাষণ্ড রীপুর তাড়নায় এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে পারে তাকে ধিক্কার দেওয়ার মত ভাষা নেই। যা হউক মানবিক দিক বিবেচনা করে আমার বুড়ির কথা ভেবে অবৈধ সম্পর্কের অবাঞ্ছিত সদ্য ভুমিষ্ট পরিত্যক্ত শিশুটিকে নিয়ে বাড়িতে আসি। বুড়িকে বলি দেখো তোমার আশা পরম দয়াময় আল্লাহ্পাক পুরণ করেছেন। আমার বুড়ি শিশুটিকে পেয়ে কী যে খুশি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। এরই মধ্যে শিশুটির বুকে এমন ঠাণ্ডা লেগে গেছে সারা শরীর নীল বর্ণ ধারণ করে ফেলেছে। তাকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি

কথোপকথনের মাঝে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা'র আকুতি ভরা যে আবেগ অনুভুতি পরিলক্ষিত করেছি তা ভাষায় প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কথায় আছে ভাষা যেখানে কাজ করে না সেখানে ইশারা বা সাংকেতিক ভাষায় কাজ করতে হয়। যাকে বলে বডি ল্যাংগুয়েজ অর্থাৎ শারীরিক সাংকেতিক ভাষা। আর ঐ বডি ল্যাংগুয়েজ তথা ইশারা বা সাংকেতিক ভাষা অনেক ক্ষেত্রে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। দুনিয়ায় মানুষ যত ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলে থাকুক না কেন, দু'টি ক্ষেত্রে ভাষার কোনো ভিন্নতা নেই। যার মাধ্যমে মানুষ আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। দুনিয়ায় যত বর্ণের, যত ভাষা-ভাষির মানুষ আছে তাদের হাসি-কান্নার ভাষা ভাবভঙ্গি একই। একই আওয়াজে হাসি-কান্না করে থাকে। আর এই ভাষা শিখতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন পড়ে না। প্রকৃতিগত ভাবে জন্মগতসূত্রে পাওয়া ঐ ভাষা'র মধ্যে কোনো ভিন্নতা নেই।

বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকে। রাতের আঁধার কেটে ভোরের আলো তখনও বিকষিত হয়নি। নিকটস্থ কবরস্হানে মাটিচাপা দিয়ে দাফন করে আসি আবর্জনার স্তুপের মাঝে কুড়িয়ে পাওয়া এক পাষণ্ড মায়ের ফেলে রাখা অবাঞ্চিত শিশুটির নিথর দেহ। ধিক্কার জানানোর কোনো ভাষা তখন খুজে পাইনি কুরুচিপূর্ণ জৈবিক চাহিদার বশবর্তী হয়ে বিবেক বর্জিত মনুষত্বহীন এমন নিকৃষ্ট মাতৃত্ব ও পৌরষত্বের প্রতি। বলতে বলতে বৃদ্ধের কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠল গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে 

আমি সান্তনা দিয়ে বল্লাম। দুঃখ করবেন না ভাই সাহেব। সবই নিয়তির অমোঘ লিখন। এখানে আপনার কিছুই করার ছিল না। আপনার আন্তরিক প্রচেষ্টার তো আর কমতি ছিল না। কথায় আছে রাখে আল্লাহ্ মারে কে, আর মারে আল্লাহ্ রাখে কে। তবে আপনারা যাকে বাবু বলছেন ঐ বাবুটা কে?

বৃদ্ধ আবারো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকে। সে আর এক নির্মম নিষ্ঠুর কাহিনি। আবার অন্যদিকে বলা যায় আশির্বাদ স্বরূপ ফেরেস্তার রূপ ধরে আভির্ভাব হয়েছিল আমাদের জীর্ণ কুটিরে। সে অনেক কথা। হ্যাঁ যা বলছিলাম আল্লাহ্পাক ঐ বচ্চাটাকে এই নরক নামক নিষ্ঠুর পাপাচার সমাজের বিভিন্ন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় না করিয়ে তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেছেন। আর আমাদেরকেও এই সমাজ নামক বিষাক্ত কালনাগিনীর ছোবল থেকে রেহায় দিয়েছেন। তা না হলে কী জবাব দিতাম এই সমাজের কাছে। তার উপর এমন কোনো টাকা কড়িও ছিল না তাকে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলবো। বিষয়টা আমি আর আমার বুড়ি ছাড়া তৃতীয় ব্যক্তি কেউ জানে না। আজ আপনার কাছে যা বল্লাম। বলতে বলতে বৃদ্ধ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। সেই সাথে বৃদ্ধাও ভারাক্রান্ত কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলো ওগো এতো দিন পর ঐ সব ফেলে আসা স্মৃতিকথা গুলো বলে মনে কষ্ট বড়াচ্ছো কেনো? আর ঐ সব কথা উনাকে শুনিয়ে লাভ কী। বৃদ্ধ বলে উঠলো, না মানে মনকে একটু হালকা করি। যে কথাগুলি এতো দিন বুকে চাপা দিয়ে রেখেছি। যা কোনো দিন কাউকে বলিনি। আজ যখন উনি শুনতে চাইছেন, কিছুু কথা বলে মনকে হালকা করি
আমি বল্লাম। বলুন আমি শুনবো। তারপর কী হলো?

বৃদ্ধ বলতে থাকে। তারপর বিপদ হলো আমার বুড়িকে নিয়ে। মাতৃত্বের স্বাদ নিতে না নিতেই তারই কোলের উপর ঐ বাচ্চাটা মারা গেল। সেই শোকে আমার এই বুড়ি চরম অসুখে পড়ে গেল। বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে উঠলো। এই ভাবেই চলতে থাকে আমাদের সংসার জীবন। সব শোক তাপ ভুলে আমাদের সংসার চলতে থাকে। কারো সাতেও নেই পাঁচেও নেই

আমার আসল বিষয় জানার আগ্রহ বা জিজ্ঞাসা তার উত্তর পাচ্ছি না। ব্যাংকে যে টাকা পাঠায় অর্থাৎ উনারা যাকে বাবু বলে থাকেন আসলে ঐ বাবুটা কে! আমি আবার প্রশ্ন করলাম। আপনারা যাকে বাবু বলছেন ঐ বাবুটা কে?

বৃদ্ধা হঠাৎ বলে উঠলেন। ওগো চলো এখন উঠা যাক। অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা পথ যেতে হবে। তাছাড়া বাবু আবার খোঁজ নিতে পারে আমরা বাড়িতে পৌঁছেছি কিনা

আমি হতাশ হয়ে বল্লাম। না না আর একটু বসুন। আমাকে বলুন আপনাদের বাবুটা কে? এরই মধ্যে তাদের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। বৃদ্ধা ফোনটা তার স্বামীকে দিয়ে বল্লেন বাবু কথা বলবে। বৃদ্ধ ফোনে কথা বলতে থাকে। কথার মাঝে বলে উঠলেন। হ্যাঁ হ্যাঁ এখনই বাড়ি যাচ্ছি। আচ্ছা রাখি। ফোনটা বৃদ্ধাকে দিয়ে বলে, ভাই দুঃখিত আজ আর কথা বলা হলো না। আমাদেরকে এখন উঠতে হবে। কইগো চলো এবার উঠা যাক

আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বল্লাম ঠিক আছে। তবে আপনাদের মোবাইল নম্বরটা দেয়া যাবে?

বৃদ্ধা বলেন তা না হয় নম্বরটা নিলেন। নম্বরতো আমার মুখস্থ নাই। যদি পারেন। নম্বরটা দেখে নিতে পারেন। যা হউক মোবাইলটা নিয়ে নম্বরটা তুলে বল্লাম কী নামে সেভ করবো?

বৃদ্ধ বলে। পিয়ার আলী। পিয়ার আলী নামে সেভ করেন। আমি বল্লাম ঠিক আছে। আপনারা যান। বিল আমি দিয়ে দেবো। উনারা উঠে রওনা দিলেন। আমি উনাদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি। বিশ্বাস মানুষের জীবনে কতবড় সম্পদ। যার উপর ভর করে আমরা সংসার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলেছি। প্রতিটি পদক্ষেপে বিশ্বাসের পরীক্ষার সন্মুখিন হতে হয়। অপরদিকে বিশ্বাস ভঙ্গকারীকে বলে বিশ্বাসঘাতক। আর ঘাতক অর্থ খুনি। বিশ্বাসঘাতককে খুনি বললে ভুল হবে না। সর্বক্ষেত্রে আইনের কাঠামতে চলা যায় না। আত্নিক বিশ্বাস যেখানে বিরল জীবন যাত্রা সেখানে বিকল

বিল পরিশোধ করে আমিও রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ি। এবং ভাবতে থাকি আমাকে জানতে হবে ঐ বৃদ্ধ পিয়ার আলীর বাবুটা কে? কে ঐ বৃদ্ধের বিশ্বাসের বস্তু। কেইবা বৃদ্ধকে প্রতিমাসে টাকা পাঠায়। পরেরদিনই ফোন করলাম বৃদ্ধের নিকট থেকে নেওয়া নম্বরে। জেনে নিলাম তার ঠিকানা। বেরিয়ে পড়লাম তার দেওয়া দিকনির্দেশনা অনুযায়ী। প্রায় ঘন্টা খানেক মোটরসাইকেল চালিয়ে পৌঁছে গেলাম বকুলপুর মোড়ে। যতটুকু রাস্তা এতখানি সময় লাগার কথা নয়। আমি যেমন বুড়ো আমার মোটরসাইকেলও বুড়ো সেই আগের আমলের ৮০ সিসি হুণ্ডা। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম ভাই এখানে পিয়ার আলী ভাই এর বাড়িটা কোথায় ভাই?

ভদ্রলোক বললেন, কোন পিয়ার আলী? এখানেতো পিয়ার আলী দুইজন

বললাম আমি যে পিয়ার আলী ভাই এর কথা বলছি উনি চোখে দেখতে পারেন না

ভদ্রলোক বললেন। ও আমাদের পিরু ভাই? একটু সামনে গিয়ে দেখবেন মসজিদ। মসজিদের পাশের বাড়িই উনার
এতো সহজেই পেয়ে যাবো ভাবতে পারিনি। গ্রাম হলেও শহরের ছোঁয়া লাগানো গ্রামটি। বাড়িটাও বেশ ছিমছাম নিরিবিলি। আমি বড়ির সামনে গিয়ে মোটরসাইকেলের হর্ণ দিতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সেই বৃদ্ধা মহিলা। তিনি বলে উঠলেন, ভাই সাহেব আপনি চলে এসেছেন আমাদের বাড়িতে! আসুন ভাই সাহেব ভিতরে আসুন। কইগো শুনছো কে এসেছে। ঐ যে গতকাল রেস্টুরেন্টে যার সাথে কথা হলো উনি এসেছেন। বৃদ্ধ অর্থাৎ পিরু ভাই বলে উঠলেন। হ্যাঁ ভাই সাহেব এত কষ্ট করে আমার বাড়ি এসেছেন?

বললাম আমি স্বস্তি পাচ্ছি না। আপনাদের সম্পদ বিশ্বাসের উৎসটা কী? আর আপনি বলতেছিলেন ফেরেস্তার রূপ ধরে নাকি আপনাদের জীর্ণ কুটিরে এসেছিল। একথার অর্থ কী?

উনি আবার বলে উঠলেন। কইগো শুনছো একটু চা নাস্তার ব্যবস্থা করো। আমরা কথা বলি। বৃদ্ধ বলতে থাকে, বর্তমানে আমি চোখে ভালো দেখতে পাই না। এমনটি ছিলাম না। আমিও সুস্থ ছিলাম। হঠাৎ করে চোখে ঝাপসা দেখতে থাকি। তারপর বাবু আমার অনেক বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছে কিন্তু কোনো ফল হয়নি। সেই থেকে পুরোপুরিভাবে দেখতে পাই না। যা দেখতে পাই তা কেবলই ধোঁয়ার কুণ্ডলী যেন চোখের সামনে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ অবস্থায় একা একা রাস্তায় বেরুনো সম্ভব হয়ে ওঠে না। হ্যাঁ এখন কথায় আসা যাক। আপনি যে জন্য এতো কষ্ট করে এসেছেন। আজ সব আপনাকে খুলে বলবো আমাদের জীর্ণ কুটিরে আশীর্বাদ স্বরূপ  হয়ে আসার সেই গল্পটা। না না এটাকে শুধু গল্প বলে খাটো করা যাবে না। ঘটনাটি বিধির বিধান। অন্ধের যষ্টি। বিশ্বাসের বিজয় কেতন। দিনটি ছিল পৌষের মাঝামাঝি সময়বাহিরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মত কুয়াশার চাদরে ঢাকা। বাহিরে মানুষতো দুরের কথা কুকুরগুলো কোথায় যে মাথা গুঁজে পড়ে আছে করো বলার উপায় নেই। আমরা দু'জন লেপ কম্বল জড়িয়ে শুয়ে আছি। তারপরেও যেন ঠাণ্ডা যাচ্ছে না। এমন সময় রাত তখন দুইটা কিংবা আড়াইটা হবেবাহির থেকে কাতর কণ্ঠে কে যেন বলছে। মা-মা-রো মোক একটু জাগা দেন মা। মুই জাড়ে মরে যাওছি মা। ও মা-রো ও বাবা-রো সারা শরিল জাড়ে ঘুলঘুলাওছে মা। মোক এলা বাঁচান মা! ও মা-রো ও বাবা-রো!

বাহির থেকে কাতর কণ্ঠের ডাক শুনতে পেয়ে বুড়ি অর্থাৎ আমার স্ত্রী বলে উঠল। বয়স হয়েছে বলে তাকে বুড়ি বলছি আসলে তা নয়। ছোট বেলা তার বাবা মা তাকে আদর করে ডাকতো বুড়ি বলে। তাই সেই ছুঁড়িকাল থেকেই সে বুড়ি, আসল নাম আম্বিয়া। সেই সাথে আমার শাশুড়ি আছিয়া থেকে হয়ে গেলো আম্বিয়ার মা। আমার শশুর মশাই আদর করে ডাকতেন কইগো আম্বিয়ার মা.....। কিন্তু আমার বুড়ি সেই বুড়িই রয়ে গেলো। সে কারও মা হতে পারলো না। সেই সাথে আমারও আদর করে তাকে কারো মা বলে ডাকার সাধটা অপূর্ণই রয়ে গেল। একই গ্রামের মেয়ে আমার বুড়ি। এপাড়া ওপাড়া। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুলে যেতো অন্যান্য মেয়েদের সাথে। দেখতে দেখতে কতো স্বপ্নের জাল বুনেছি তাকে ঘিরে। এরই মধ্যে হৃদয় অঙ্গনে ভালোবাসর বীজ বপণ হয়ে গেলো তাকে ঘিরে। একদিন সেই বীজ অঙ্কুরীত হয়ে ধীরে ধীরে সবুজ পত্র পল্লবে ভরে উঠলো। আমার বিশ্বাস এই স্বপ্ন একদিন বাস্তবে রূপ নেবে। বেশ কিছুদিন আর দেখা হচ্ছে না। পরে শুনেছি পেয়ারা পাড়তে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে। ভাবলাম একবার গিয়ে দেখা করে আসি। কিন্তু এক অদৃশ্য আদেশে দেখা করতে যেতে পারিনি। তিন-চার মাইলের মধ্যে কোনো হাই স্কুল ছিল না। ক্লাস ফাইভ পাশ করার পর তার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। পড়া বন্ধ বাড়িতেই থাকে। তার সাথে আর দেখা হয় না। মনে মনে ভাবি আমার মনের ইচ্ছাটা বাবা-মা কে বলি। কিন্তু সাহস হয়নি। লাজুক ও ভীতু স্বভাবের ছিলাম। একতরফা এই প্রেমের কথা কাউকে বলতে পারিনি। একতরফা এই জন্য বলছি কারণ তার সাথে তো আর এ বিষয়ে কোনো কথাই হয়নি। চলতি পথে দু'একদিন দেখা হলেও সামনাসামনি মুখ ফুটে কিছু বলতে পারিনিসামনে যেন এক সচ্ছ পুরু কাঁচের দেয়াল। এ যে সেকালের প্রেম। বাব-মা'র একমাত্র আদরের সন্তান আমি। আমার মনের কথা তাঁরা কী করে যে বুঝতে পেরেছিলেন জানি না। আল্লাহ্পাকের অশেষ রহমতে আমার বাবা-মা এর প্রস্তাবেই লাল বেনারশি শাড়ি পরে বুড়ি আমার ঘরে বৌ হয়ে আসলো। বলতে বলতে বৃদ্ধের কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠে এবং গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। এই অশ্রু আনন্দের না বেদনার বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে তার চোখ মুখের চেহারা দেখে এতটুকু বুঝতে পারলাম আনন্দ বেদনা মিশ্রিত এই অশ্রু ধারা। বলতে বলতে বৃদ্ধ থেমে গেলো

আমি বললাম বলুন তারপর কী হলো?

চোখের পানি মুছে নিয়ে সে আবার বলতে শুরু করে। এই দেখেন কি বলতে বলতে কি বলে চলেছি। যাক সে সব কথা যা বলছিলাম। তখন আমার বুড়ি বলে, ওগো শুনছো বাহিরে কে যেন ডাকছে। এতো রাতে ঠাণ্ডার মধ্যে কেউ বের হয় নাকি। আমার বাসাটি ছিলো রাস্তার পাশে। রাস্তার দিকে একটা দরজাও ছিলো। আমি বললাম, না এতো রাতে দরজা খোলা যাবে না। তখন বাহির থেকে দরজায় ধাক্কা দিয়ে কাতর কণ্ঠে কাকতি মিনতি করে বলতে থাকে। ও বাবা রো ও মা রো মোক এনা বাঁচান মা। বুড়ি আবার বলে উঠলো, তুমি কী পাষান হয়ে গেছো নাকিশুনতে পাচ্ছো না, একটা ছোট্টো বাচ্চার কণ্ঠ। দরজা খুলে দেখো। দরজা খুলতেই একটি ছেলে পাতলা একটা হাফ শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরা অবস্থায় হুমড়ি খেয়ে আমার পা এর কাছে পড়ে বলে উঠলো ও বাবা-রো মোক এনা বাঁচান বাবা। আপনি মোর বাবার মতো। মোক এনা বাঁচান বাবা-রো। মুহুর্তে আমার বুড়িকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো আপনি মোর মা'র মতো মোক এনা বাঁচান মা-রো। বুড়ি ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো ওরে হতভাগা মা এর মতো নয়, বল মা। মতো আর আসল এক জিনিষ নয়। মতোর মধ্যে আসলের স্বাদ পাওয়া যায় না। বুড়ির কথাটা শুনে আমার এক বন্ধুর উপদেশ বানী মনে পড়ে গেলো। আমার সেই বন্ধু বলেছিল শোন দোস্ত সুজন তোকে একটা কথা বলি। কথাটা মনে রাখিস। আর যাই করিস মতো কে কখনও আসল ভাবিস না। দেখনা চাইনা ফনিক্স সাইকেলটা কিনলাম এক বছরও হয়নি এর মধ্যে রং চটে কি অবস্থা দেখতে পাচ্ছিস? আসলে কেনার সময় খেয়াল করিনি সাইকেল টা মেইড ইন চাইনা নয়, পরে দেখি মেইড এস চাইনা। অর্থাৎ চাইনার তৈরী নয়, চাইনার মত তৈরী। একটা কথা মনে রাখিস মতোর গর্ত দিয়ে একদিন বিষাক্ত কালকেউটে বেরিয়ে এসে এমন ছোবল দিয়ে বসবে। সবধান দেখে শুনে, বুঝে কোনো কাজ করবি। আমিতো আমার বুড়ির কথা শুনে এবং দৃশ্যটা দেখে হতবাক হয়ে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এ যেনো হারিয়ে যাওয়া কোনো অমূল্য সম্পদ ফিরে পাবার অনুভুতি। শাড়ির আঁচল দিয়ে জড়িয়ে ঐ অবস্থায় বুকে নিয়ে কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়লো। ছেলেটির ঠাণ্ডা যেনো সে চুষে নিয়ে উঠে বসলো। যেমন সদ্য ভুমিষ্ট শিশুকে ডাক্তার সাহেবরা বাচ্চাটাকে পাতলা সুতি কাপড়ে জড়িয়ে মা এর স্পর্শে রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন সেই রকম। আমার বুড়িরতো সেই অভিজ্ঞতা ছিলো  না। তাহলে এটা কী মাতৃত্বের প্রকৃতিগত গুণের বৈশিষ্ট্য? কই গো তোমার হলোআর কতক্ষণ বসিয়ে রাখবে। কি যে করছে আমার বুড়িটা!

আমি বললাম। না না ঠিক আছে আপনি বলুন। তারপর কী হলো ছেলেটি কোথা থেকে এসেছিল? এরই মধ্যে ট্রে ভর্তি নাস্তা নিয়ে বৃদ্ধা এসে বলে অনেক দেরি করে ফেলেছি কিছু মনে করবেন না ভাই। না না মনে করবো কেনো। এইতো ঘন্টা খানেক আগে নাস্তা করে বেরিয়েছি। বৃদ্ধ মানে পিয়ার আলী ভাই বলে উঠলো আমার বুড়িটা যে কী নাস্তা দিলো আমিতো আর দেখতে পাচ্ছি না। খান ভাই উপস্থিত যা দিয়েছে। কিছু মনে করবেন না

বললাম নিন আপনিও নিন

উনি বলে আপনি বিসমিল্লাহ্ বলুন। আমরা এই মাত্র নাস্তা করে বসে আছি। এর মধ্যে আপনি এলেন। অগত্য নাস্তা খেতে শুরু করলাম। পিরু ভাই বলতে লাগলো। হ্যাঁ যা বলছিলাম। ওকে কতবার জিজ্ঞেস করেছি। তার কোনো ঠিকানা সে বলতে চায় না। আর আমরাও তেমন জানার আগ্রহ করিনি। পাছে তাকে হারাতে হয় সেই আশঙ্কায়। তবে এতটুকু বলেছে আপন বলতে এ দুনিয়াতে তার কেউ নেই। মা এর পেটে থাকতে সে বাবাকে হারিয়েছে। আর তিন বছর বয়সে মাকে হারায়। চাচা চাচীর কাছে বড় হতে থাকে। চাচা যদিওবা একটু সু-নজরে দেখতো চাচীর অবজ্ঞা আর অবহেলা আর সহ্য করতে পারে না। কথায় কথায় মুখ ঝেটকানি আর বলতে থাকে তোর বাবা-মা এর মাথা খেয়েছিস আবার আমাদের মাথা খাবি নাকি? বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। কিছুদিন পর তার চাচা হঠাৎ স্টোক করে এক সাইড অবস হয়ে বিছানায় পড়ে থাকলে চাচী ও চাচাতো ভাইদের অবজ্ঞা অবহেলা আর অত্যাচার বেড়ে যায়। চাচার সকরুণ মায়া ভরা অসহায় চাহনি দেখে আর চাচীর কথায় কথায় বলতে থাকা তোর বাবা মা এর মাথা খেয়ে বসে আছিস, আবার আমাদের মাথা খাওয়া শুরু করলি। মরতে পারিস না। যা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। এত সব অবজ্ঞা অবহেলা সহ্য করতে না পেরে বাড়ি থেকে বের হয়ে পাঁচ সাত কিলোমিটার হেঁটে স্টেশনে এসে ট্রেনে উঠে অজানার উদ্দ্যেশে রওনা দেয়। তারপর ঘুরতে ঘুরতে আমাদের বাসাতে এসে উঠে। সেই থেকে তাকে বাবু বলে ডাকি আর লালন পালন করতে থাকি। স্কুলে ভর্তি করে দেই তার পিতৃপরিচয়ে

বললাম সে আর কখনও তার বাপ দাদার ভিঁটায় যায় নাই?

হ্যাঁ একবার যখন স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে পড়তে যাবে তখন আমাকে নিয়ে তার বাপ দাদার ভিঁটে দেখার জন্য গিয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে কাউকে পায় নাই। অর্থাৎ নদী ভাঙনে এলাকার কে কোথায় ছিটকে পড়েছে কেউ কারো খোঁজ দিতে পারে নাই। হ্যাঁ যা বলছিলাম পড়া লেখায় ভালো রেজাল্ট করতে থাকে। ক্লাস ফাইভে, ক্লাস এইটে ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়ে মাস্টারদের সু-নজরে পড়ে যায়। তারপর আর তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এস.এস.সি, এইচ.এস.সি বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে মেধা তালিকায় স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে লেখা পড়া সবই সরকারী খরচে হয়েছে। কথায় বলে যে মুলা মোটা হয় তার জন্য মাটি খুঁচিয়ে আলগা করে দিতে হয় না। নিজে থেকেই মাটি ফাটিয়ে মোটা হতে থাকে। তবে প্রাথমিক পরিচর্যা অবশ্যই করতে হয়। এখন সে ঐ দেশের নাগরিক। আমাদের বিশ্বাসের বস্তু, আমাদের সাতরাজার ধন অন্ধের যষ্টি, বিশ্বাসের বিজয় কেতন আমাদের বাবু। সেই প্রতি মাসে আমাদরকে টাকা পাঠায়। আর বাইশ শতক জমির উপর এই বাড়ি ছাড়া আমাদের আর কিছুই নেই ভাই। বাবু বলে, তোমরা যখন একেবারেই চলতে পারবা না তখন একটা ব্যবস্থা করে দেবো। এ কথার মানে কী ভাইএ কথার মানে বৃদ্ধ বুঝতে না পারলেও আমি ঠিকই বুঝে নিয়েছি। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম সে দেশে আসে নাপিরু ভাই বলে হ্যাঁ দু'এক বছর পর আমাদেরকে দেখতে আসে। বললাম আমি একটা পরামর্শ দেইএতক্ষণ যা শুনলাম তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার বুঝেছি আপনাদের কোনো সন্তানাদি নেই। আপনাদের বাবু আপনার ঔরশজাত সন্তান নয়। সে তার নিজ পিতৃপরিচয়ে বড় হয়েছে। এই বাড়ির অংশিদার সে নয়। তাকে দিতে হলে রেজিস্ট্রি করে দিতে হবে। তাছাড়া আপনাদের বাবু আর এ দেশে আসবে বলে মনে হয় না। তাই বলছিলাম আপনার এই বাড়ি শর্ত সাপেক্ষে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে দান করে যান। আপনারা যতদিন আছেন ততদিন বৃদ্ধাশ্রম থেকে আপনাদেরকে দেখাশুনা করবে। যদিও বৃদ্ধাশ্রমের পক্ষ সমর্থন করেনা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা তথা পারিবারিক মমত্ববোধ। তারপরেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে শেষ বয়সে যাদের দেখা শুনার কেউ নেই এই ধরুন আপনাদের কথাই বলি আপনি চোখে দেখতে পারেন না। ভাবি সাহেবা কিছুটা সুস্থ আছে বলে দু'জনে কোনো প্রকারে চলে যাচ্ছেন। একজনের অবর্তমানে আর একজনের অবস্থা কি দাঁড়াবে একবার ভেবে দেখেছেন? যদিও আল্লাহ্পাক নির্ধারণ করে রেখেছেন কাকে কি অবস্থায় রাখবেন। তার পরেও তো ভবিষ্যতের  জন্য একটু ভাবতেই হয়

বৃদ্ধা অর্থাৎ ভাবি বলে উঠলেন। হ্যাঁ ভাই সাহেব, আপনি ঠিক বলেছেন ভাই সাহেব। একদিনতো আমার প্রেশার বেড়ে ঘাড় মাথা ধরে আমি আর উঠতে পারিনি। মাথায় পানি ঢালার মতো কেউ নেই উনিতো চোখে দেখতে পারেন না। ঐ অবস্থায় ট্যাপ খুলে ট্যাপের নিচে মাথা দিয়ে বসে মাথায় পানি নিতে থাকি। আমাদের বড়িটা দেখছেনতো একটু ফাঁকা জায়গায়। আশে পাশে তেমন কোনো প্রতিবেশীদের ডাকারও সুযোগ নেই। তাছাড়া কে কয়দিন কাকে দেখতে পারে

তাইতো বলছিলাম ভাবি সাহেবা। বিষয়টা বিবেচনায় রেখে আমার পরামর্শটা আপনাদের বিশ্বাসের সম্পদ যাকে আপনারা বলছেন বিশ্বাসের বিজয় কেতন আপনাদের বাবুকে জানাবেন। আচ্ছা আজকে তাহলে উঠি। আবার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ্

পিরু ভাই বলেন, বসেন ভাই সাহেব যাবেনক্ষণ। আর একটু বসেন। সেই সাথে বৃদ্ধা অর্থাৎ ভাবি বলে উঠলেন বসেন ভাই সাহেব রান্না করি দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে তারপরে যাবেন। না না ভাবি আজকে উঠি অন্য একদিন আমার গিন্নী সহ এসে খেয়ে যাবো। পিরু ভাই বলেন, বসেন বসেন আরও কিছু কথা বলি। কার সাথে কথা বলবো। সবাই যার যার মত ব্যাস্তএই অন্ধত্ব জীবন বড়ই দুর্বিসহ জীবন। ভাই, আপনি আমার মনের কথা বলেছেন। আমি যে আমার এই সামান্য সম্পদ বাড়ি খানার ব্যাপারে ভাবি নাই তা নয়। এ ব্যাপারে আমার বুড়ি ও বাবুর সাথে আলাপ আলোচনাও করেছি। তাই বুঝি আমাদের বাবু এসে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলেছে

আমি বললাম, দেখুন আপনার মনের কথাতো আমি বলতে পারবো না। বাস্তবতার আলোকে বিষয়টা আপনাকে বলেছি। কোনো একটা ব্যবস্থা না করে গেলে আপনার এই সম্পত্তি বেওয়ারিশ হয়ে যাবে। বিষয়টা ভেবে দেখবেন। আজ আমি উঠি। আর হ্যাঁ। ভাবি আপনাদের মোবাইল ফোন টা দেন। আমার নম্বরটা সেভ করে দিয়ে যাই। সময় সময় কথা হবে। আর আপনাদের বাবু বাড়ি আসলে আমাকে জানাবেন। এ এই যে সুজন নামে সেভ করে দিলাম

সেভ করেতো দিলেন ভাই সাহেব, আমিতো নম্বর বের করে কল দিতে পারি না

আমি বললাম, ঠিক আছে আমি মাঝে মধ্যে কল দেবো। আর বেশি প্রয়োজন হলে কাউকে দিয়ে ফোন করবেন। এর মধ্যে তো ব্যাংকে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ্। আজ আমি আসি। বলেই বাড়ির উদ্দ্যেশে রওনা দিলাম

এর মধ্যে দেখতে দেখতে বেশ কিছু দিন কেটে গেলো। পিয়ার আলী ভাই এর কোনো ফোন আসে নাই। মাঝে মধ্যে আমিই খোঁজ নিয়েছি। ব্যাংকেও দু'এক বার দেখা হয়েছে। ভাবছি এর মধ্যে একবার পিয়ার আলী ভাই এর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসি। হঠাৎ আমার ফোনটা বেজে উঠলো। দেখি পিয়ার আলী ভাই এর নাম। সঙ্গে সঙ্গে মনটা একটা অজানা আশঙ্কায় নাড়া দিয়ে উঠলো। উনারা তো নম্বর বের করে কল দিতে পারেন না। নিশ্চয় কোনো বিশেষ প্রয়োজনে কাউকে দিয়ে কল দিয়েছে। রিসিভ করে কথা প্রসংগে বুঝলাম খবর টা বেশ আনন্দেরউনাদের বাবু বাড়ি এসেছে। আমার প্রস্তাবটা তাকে বলাতে সে অর্থাৎ উনাদের বাবু আমার সাথে কথা বলতে চায়। তাই আগামী কাল উনাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন পিয়ার আলী ভাই। মনে মনে বলে উঠলাম অনুরোধের প্রয়োজন নেই। আমি তো নিজে থেকেই যাওয়ার জন্য তৈরী ছিলাম। যা হউক পরের দিন নাস্তা করেই সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম পিয়ার আলী ভাই এর বাড়ির উদ্দেশ্যে। যথা সময়ে পৌঁছে গেলাম সেখানে। পৌঁছে দেখি এলাকার বেশ কিছু মানুষ বসে আলাপ আলোচনা করছে বাড়ির আঙ্গিনায় বসে। আমি ছালাম দিয়ে উঠতেই একজন বলে উঠলেন ভাই আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। বললাম আপনারা আমাকে চিনবেন না। আমি সুজন, রসুলপুর আমার বাড়ি। ভাবি অর্থাৎ পিয়ার আলী ভাই এর ওয়াইফ আমাকে চিনবেন। সঙ্গে সঙ্গে সুদর্শন এক যুবক চেয়ার থেকে খাড়া হয়ে বলে উঠলো। আপনি সুজন আঙ্কেলআমিই বাবাকে দিয়ে গতকাল আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম। বসুন আঙ্কেল। একটা বিষয়ে আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনাদের সহযোগীতা কামনা করছি। যেহেতু কাজটা একক ভাবে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যে কাজটি করতে যাচ্ছি এটা একটা টিম ওয়ার্ক। সবার সহযোগীতা ছাড়া করা সম্ভব নয়। আপনারা এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি আপনাদের সহযোগীতা একান্ত ভাবে কামনা করছি। আর এ ব্যাপারে এলাকার যুব সমাজের ভুমিকা থাকবে অতি গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা এলাকাবাসি। আপনারা সবই জানেন। এই বকুলপুর গ্রামের আলো বাতাসে আমার বেড়ে উঠা। আপনাদের দোয়া ও আশির্বাদে এবং আল্লাহ্পাকের অশেষ রহমতে আজকে আমি এপর্যায়ে আসতে পেরেছি। তা না হলে আমার অবস্থান যে কোথা হতো তা একমাত্র আল্লাহ্পাকই ভালো জানেন। আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি। আর আপনাদেরকে বেশি কিছু বলা মানে মা এর কাছে মামার বাড়ির গল্প বলার সমান হবে। আমার বাবা মা এর বয়স হয়েছে। বাবা চোখে ভালো দেখতে পারেন না।  তাদের দেখা শুনা সেই সাথে আমার বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর এই বাড়িটা একটি ট্রাস্টের অধীনে সীমিত আকারে একটি বৃদ্ধাশ্রম করতে চাই। এখন আপনাদের মতামত বা অনুমতি পেলে কাজ শুরু করতে পারি। তবে কাজটা যত সহজ মনে হয় ততটা সহজ নয়। তবে ইচ্ছা যদি হয় সৎ আর উদ্দেশ্য যদি হয় মহৎ তবে কোনো কাজই কঠিন নয়। এর মধ্যে মাথায় টুপি ও জুব্বা পরিহিত  একজন বলে উঠলেন। বাবাজী আপনি ঠিকই বলেছেন। " ইন্না মাল আমালু বিন নিয়্যাত " বুখারি শরিফ ০১নং হাদিস।" নিশ্চয় সমস্ত কাজই নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল"। আপনাদের এই মহৎ উদ্দ্যেশ্য সফল হউক। পরে জানলাম উনি মসজিদের ইমাম সাহেব। ছেলেটি বলতে থাকে গত বছর বাড়িতে এসে আমার এক প্রবাসী বন্ধুর সীমিত আকারের এক বৃদ্ধাশ্রম দেখতে গিয়েছিলাম। বৃদ্ধ বয়সে তারা কী ভাবে জীবন যাপন করে। একটা এতিমখানা চালানো সহজ। কারণ সেখানে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দেখা শুনা করা হয়ে থাকে তাদেরকে শাসন করা যায়। এবং তারা শাসন মানে। কিন্তু বুড়ো বয়সে তাদেরকে শাসন করবেন কী ভাবে। দেখে তো একেবারে অবাক। সেই বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে দেখি বৃদ্ধাশ্রমটি দু'টি অংশে বিভক্ত এক অংশে কিছু বৃদ্ধা আর এক অংশে কয়েক জন বৃদ্ধ। দেখি এক বৃদ্ধা ঘরের একটা খুঁটিকে শক্ত করে ধরে এমন আত্নচিৎকার করে বলছে। না না আমার দাদুকে আমার কাছে থেকে নিয়ে যেতে দেবো না। কইগো স্বপ্নার বাপ তুমি কোথায় গেলেদেখো দেখো ওরা আমার দাদু ভাইকে নিয়ে যাচ্ছে। না না আমি কিছুতেই দাদু ভাইকে নিয়ে যেতে দেবো না। না না আমি কিছুই খাবো না। যা যা তোরা সবাই চলে যা। দুর হ আমার সামনে থেকে। বলছে আর হাও মাও করে কাঁদছে। তারপর বৃদ্ধদের অংশে গিয়ে দেখি সে আর এক কাণ্ড। এক বৃদ্ধের সে কী যে কাকতি মিনতি। যাকে সামনে পাচ্ছে তাকে জড়িয়ে ধরে বলছে একটা বিড়ি দাওগো, দাও না একটা বিড়ি। আমি একটা টানই দেবো। দাও না একটা বিড়ি, আমি মলাম গো। কথাটা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো। তাহলে বোঝেন ঐ বৃদ্ধা ও বৃদ্ধকে কী করে বোঝাবেন

ছেলেটির শিষ্টাচার ও ভদ্রচিত্ত গঠনমূলক কথা শুনে বেশ ভালো লাগলো। এর মধ্যে একজন বলে উঠলেন। বাবাজী তোমার ও তোমার বাবার উদ্দ্যেশ্য সফল হউক তা আমরা চাই। কথা হচ্ছে এই মসজিদের বাউণ্ডারী ওয়ালটা পূর্বদিকে একটু বাড়াতে পারলে কোনো দুর্যোগপূর্ণ দিনে ঈদের জামাত টা আমরা মসজিদে সেরে নিতে পারতাম। তখন পিয়ার আলী ভাই বলে উঠলো। দেখুন আমার এই বাড়ির জমি বাইশ শতক।  মসজিদের জন্য পাঁচ শতক নিয়ে বাঁকি অংশ বৃদ্ধাশ্রমের নামে রেজিস্ট্রি করে নিন। প্রাক্তন চেয়ারম্যান সাহেব একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তিনি মসজিদ কমিটির সভাপতি। তিনি বলে উঠলেন পিরু ভাই দিবেনই যখন আর দুই শতক বাড়িয়ে সাত শতক মসজিদে আর পনের শতক ট্রাস্টের নামে রেজিস্ট্রি করে দেন। শেষে সর্বসন্মতিক্রমে এই সিদ্ধন্তই গৃহীত হলো। আর ট্রাস্টের নাম হবে "পিয়ার আলী বৃদ্ধাশ্রম" আগামী সাত দিনের মধ্যে কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করার সদ্ধান্ত গৃহীত হলো। সেই সাথে সরকারী নীতীমালা অনুসরণ করে একটা গঠনতন্ত্র প্রনয়ণ করারও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর  আলোচনা সমাপ্তি ঘোষণা করে যার যার গন্তব্যস্থলে চলে গেলো। পিয়ার আলী ভাই বলে উঠলেন। সুজন ভাই আপনি পরে যাবেন। দুর থেকে এসেছেন। তাছাড়া আপনার সাথে আরও কিছু কথা আছে। কিছুক্ষণ বসে পিয়ার আলী ভাই ও তার ছেলে যাকে উনারা বাবু বলে থাকেন তার সাথে আলাপচারিতার একপর্যায়ে বাবু বলে। আঙ্কেল আমার ইচ্ছা ছিলো বাড়িটাকে একটা এতিমখানা বানাই। কিন্তু বাবার ইচ্ছা বৃদ্ধাশ্রম করার। কারণ বৃদ্ধ বয়সে মানুষ বড়ই অসহায় হয়ে পড়ে। এমনও মানুষ আছে যাদের সন্তানাদি এমনকি আপনজন বলতে কেউ নেই। 

আমি বললাম বাবাজী, তোমাদের উদারতা ও মহানুভবতা অবশ্যই প্রসংশনীয়। তোমার বাবা ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। তোমার বাবার বিশ্বাস ও আস্থার উৎস জানতে গিয়ে তোমার বাবার সাথে আমার পরিচয়। আর এই ধারণাটা আমিই তোমার বাবাকে দিয়েছিলাম। কথা বলতে বলতে জোহরের নামাজের আযান হয়ে গেলো। মসজিদে নামাজ আদায় করে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে আমি বাড়ির উদ্দ্যশে রওনা দেই

দু'এক দিন পরেই খামে ভর্তি একটা হাত চিঠি এক ভদ্রলোক আমাকে দিয়ে গেলো। খামটি খুলে দেখি "পিয়ার আলী বৃদ্ধাশ্রম" এর কমিটি লিস্ট। আমাকে কমিটির সদস্য পদে রাখা হয়েছে। এবং আগামী শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে মিটিং এ উপস্থিত থাকার অনুরোধ করা হয়েছে। ভাবতে থাকি এমন একটি সমাজ উন্নয়নমূলক ভালো কাজে সম্পৃক্ত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। পরবর্তী বিশেষ স্মরণীয় একটি  দিন পিয়ার আলী ভাই এর  শুভ জন্মদিনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বর, স্থানীয় যুবসমাজ ও স্থানীয় সর্বস্তরের জনসাধারণের শতস্ফুর্ত উপস্থিতিতে  "পিয়ার আলী বৃদ্ধাশ্রম " এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পিয়ার আলী ভাই এর ছেলে মোঃ বদি-উজ্জামান (বাবু) দিকনির্দেশনা স্বাগত বক্তব্যে এলাকাবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তার বাবার লালিত স্বপ্ন তথা এমন একটি মহতি কাজে সর্বপ্রকার সহযোগীতা থাকবে সেই সাথে সকলের দোয়া চেয়ে বলেন আগামী সপ্তাহে আমাকে কানাডা ফিরে যতে হবে। ট্রাস্টের পরবর্তি কার্য্যক্রম আপনাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় চালিয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ্। আল্লাহ্ হাফেজ। বলেই তার স্বাগত বক্তব্য শেষ করে। প্রধান অতিথি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় তাঁর গঠনমুলক বক্তব্যের মাঝে "পিয়ার আলী ও আম্বিয়া খাতুন" কে বৃদ্ধাশ্রমে তালিকা ভুক্ত করে শুভ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় পিয়ার আলী বৃদ্ধাশ্রমের কার্য্যক্রম।  

বাড়ির অনতিদুর এক-দেড়'শ গজের মাথায় একটি চৌপথ। চৌপথ ঘিরে বেশ কিছু দোকানপাট গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে একটি ফার্মেসী। গ্রাম্য ভাষায় যাকে বলে ঔষুধের দোকান। আসরের নামাজ আদায় করে হাঁটা হাঁটি করে মাগরীবের আগ পর্যন্ত ফার্মেসীতে বসে কিছু সময় কাটিয়ে থাকি। ফার্মেসীর ছেলেটির নাম আঁখি বেশ সদালাপী ও মিষ্ট ভাষী। যুব উন্নয়ন সংস্থা থেকে আর.এম.পি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ফার্মেসী চালায় সেই সাথে গ্রামের মানুষদেরকে প্রাথমিক ভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে থাকে

ফার্মেসী বা ঔষুধের দোকানে বসলে গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয় উপলব্ধি করা যায়। একদিন এক ওয়াজ মাহফিলে হুজুরের বয়ানে শুনেছি, আপনারা আপনাদের অসুস্থ প্রিয়জনকে দেখতে যাবেন তাদের পাশে দাঁড়াবেন। আর বয়োবৃদ্ধ আত্মীয় স্বজনকে দেখতে যাবেন। এতে করে রুগীর মনে যেমন শান্তনা ও সাহস যোগাবে তেমনি আপনার মনে এক অনুভুতি জাগবে মানুষ কতবড় অসহায় আর কিসের এত বড়াই। একদিন আমার আপনার ভাগ্যে এমন অবস্থা নেমে আসতে পারে

ফার্মেসীতে বসে আছি, এমন সময় কয়েকজন ছেলে ছালাম দিয়ে আমাকে বলে। আঙ্কেল, আপনার সাথে একটা বিষয়ে কিছুু পরামর্শ করতে চাই সেই সাথে আপনার সহযোগীতা কামনা করছি। যদি আপনার সময় থাকে। ছেলে গুলো গ্রামেরই, ওদের কার্যক্রম দেখে খুব ভালো লাগে। এ কদিনেই আমার সাথে বেশ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শিমুলপলাশ আর সজল। ওরা "কৃঞ্চচুঁড়া যুব সংগঠন" নামে একটা সংগঠনের মাধ্যমে রক্তের গ্রুপ ভিত্তিক একটি তালিকা করে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচীর আওতায় রক্তদান সহ সমাজ উন্নয়ন ও আর্তমানবতা সেবা মূলক কাজে অংশ গ্রহণ করে থাকে

আমি বললাম, হ্যাঁ বাবা বলো কী ভাবে তোমাদের সহযোগীতা করতে পারি। গ্রামের জন্য আমি তো তেমন কিছুই করতে পারিনি যেহেতু আমি গ্রামে ছিলাম না। মাত্র বছর খানেক হলো অবসর নিয়ে বাড়িতে এসেছি। এখনও গ্রামের পরিবেশে খাপ খাওয়ায়ে উঠতে পারিনি, তোমাদের পাশে দাঁড়িয়ে এই অবসর জীবনে সমাজের জন্য যদি একটা কিছু করতে পারি তাহলেতো নিজেকে ধন্য মনে করবো

ছেলেদের মধ্যে থেকে সজল নামে ছেলেটি বলে। জী আঙ্কেল আপনিতো অনেকদিন গ্রামে ছিলেন না। তাই বলছি ঐ মল্লিকপাড়ার জাফর চাচার কথা কী আপনার মনে আছে?

বললাম, মল্লিকপাড়ার জাফর, মানে আমদের জাফরান ভাইসেই ছোট বেলায় কোথা থেকে এসে মল্লিক বাড়িতে কাজ করতে থাকে। সেই থেকে সে যেখান থেকে এসেছিল সেখানে আর ফিরে যায় নাই। খেলাধুলায় সে ছিল পটু। বিশেষ করে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহি গাদন ও হা ডুডু খেলা খুব ভালো খেলতো। মল্লিক বাড়ি তাকে দিয়ে একটা টিম গঠন করে দিয়েছিল। তাকে তেমন কোন কাজ করতে হতো না। খেলার টিম নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে কত শীল্ড কাপ জিতে এনে দিয়েছিল ঐ জাফরান মল্লিক বাড়িেতে। অল্প দিনের মধ্যে বেশ পরিচিত মুখ হয়ে উঠে জাফরান। তারপর আমি চাকরীতে চলে গেলে আর তেমন কিছু জানা নেই তার সম্পর্কে। হ্যাঁ বলো কী হয়েছে তার?

ছেলেদের মধ্যে থেকে শিমুল বলে উঠল। জী আঙ্কেল আপনাদের সেই খেলোয়াড় জাফরান অর্থাৎ জাফর চাচা এখন বার্ধক্যজনিত কারণে এক দুরাবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করছে। তাকে দেখাশুনার কেউ নেই। একটা মেয়ে আছে মাঝেমধ্যে এসে দেখাশুনা করে থাকে। কিন্তু সে তো দুরে থাকে তার উপর তার সংসার আছে। এদিকে তার যা আছে তাতে তার খাওয়া পরার কোনো অসুবিধা হয় না। কেবল তাকে দেখাশুনার কেউ নেই একলা ভিঁটায় পড়ে থাকে। তাই বলছিলাম আমরা শুনেছি বকুলপুরে একটা বৃদ্ধাশ্রম চালু হয়েছে, আপনি ঐ বৃদ্ধাশ্রমের কার্যপরিচালনা পর্ষদের একজন সদস্য। আপনি যদি জাফর চাচা'র জন্য ওখানে একটা ব্যবস্থা করে দিতেন

আমি বল্লাম, হ্যাঁ তোমরা ঠিকই শুনেছো। কোনো এক ঘটনা প্রবাহে আমি ঐ বৃদ্ধাশ্রমের কার্যক্রমের সাথে যুক্ত আছি। তবে কথা হচ্ছে সংস্থাটি একটা ট্রাস্টের মাধ্যমে সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকে। সেখানে কিছু শর্তসাপেক্ষে পরিবার কিংবা সমাজের দ্বায়িত্বশীল ব্যক্তির স্বাক্ষরিত ফরম পূরণ করে বৃদ্ধাশ্রমে কাওকে ভর্তি করা হয়ে থাকে

ছেলেদের মধ্যে থেকে পলাশ বলে, আঙ্কেল আমরা তার মেয়ে জামাই ও মল্লিকবাড়ির কয়েকজনের সাথে আলোচনা করে আপনার কথা বলেছি। তারা দ্বায়িত্ব নিয়েই ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আপনার সাথে কথা বলতে বলেছে। এখন আপনি যদি.....

আমি বল্লাম, ঠিক আছে তাহলে কালকে... না কালকে নয় এই কাল শব্দটির উপর গ্রামের মানুষের একটা বিরুপ ধারণা রয়েছে। তোমরা বরং পরশুদিন এই সময় এখানে আমার সাথে দেখা করবে কেমন?

জী আঙ্কেল। ছালাম জানিয়ে ছেলেগুলো চলে গেল। আমিও মাগরীবের নামাজ আদায় করার জন্য মসজিদের দিকে হাঁটতে থাকি আর ভাবতে থাকি তথ্যপ্রযুক্তি ইন্টারনেট সেবা আমাদের জীবনযাত্রা যেমন সহজ করে দিয়েছে তেমনি অন্যদিকে আমাদের সমাজে কিছু সংখ্যক যুবসমাজ ইন্টারনেটের কু-প্রভাবে আসক্ত হয়ে বিপথগামী হয়ে পড়ছে। সেখানে এই ছেলেগুলো আর্তমানবতার সেবা ও সমাজ উন্নয়ন মূলক কাজে বিশেষ ভুমিকা রেখে চলেছে। সমাজের দ্বায়ীত্বশীল ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তারা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে

রাতেই সিদ্ধন্ত নিলাম আগামী কাল বকুলপুর গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের কার্যক্রম দেখে আসব সেইসাথে জাফর ভাই এর বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আর বেশ কিছুদিন পিয়ার আলী ভাই এর সাথে দেখা হয়নি। সকালে নাস্তা সেরে রওনা দিলাম বকুলপুর। পিয়ার আলী ভাই এর সাথে দেখা করে বৃদ্ধাশ্রমে আরো কয়েকজন বৃদ্ধ ভর্তি হয়েছে তাদের সাথে কথা বলে বৃদ্ধাশ্রমের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সাহেবের সাথে দেখা করে জাফর ভাই এর বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করি। সভাপতি সাহেব বিষয়টা বিবেচনায় নিয়ে ট্রাস্টের শর্তসাপেক্ষে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। অফিস থেকে ফরম নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি

পরেরদিন ফার্মেসীতে গিয়ে ছেলেদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। ইতিমধ্যে ছেলেগুলো এসে ছালাম দিয়ে পলাশ বলে আঙ্কেল, জাফর চাচার বিষয়টা কী কিছু করতে পেরেছেন আঙ্কেল?

হ্যাঁ বাবা তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছি। সব ব্যবস্থা করে এসেছি। এই নাও এই ফরমটা পুরণ করে যত তাড়াতাড়ি পার প্রস্তুতি  নিয়ে জাফর ভাইকে বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করে আসতে পারবে

ফরমটা নিয়ে পলাশ ছেলেটি বলে ঠিক আছে আঙ্কেল যত শিঘ্রই পারি আমরা ব্যবস্থা নেব। আচ্ছা এখন তাহলে আমরা আসি আঙ্কেল, আসছালামু আলাইকুম

বললামওয়া আলাইকুম আসছালাম। আচ্ছা এসো

দু'দিন যেতে না যেতেই ফরম পুরণ করে এনে পলাশ বলে এই নিন আঙ্কেল। দেখেন ঠিক আছে কিনা। আর আপনি যেদিন বলবেন ঐ দিনই জাফর চাচাকে ভর্তি করে দিয়ে আসবো

ফরমটা নিয়ে ঠিক আছে কিনা পরখ করে দেখে বললামহাঁ ঠিক আছে। আর শুভকাজে দেরি করতে নেই। আজ কী বার? বুধবার। তোমরা প্রস্তুতি নাও আগামী শুক্রবার জাফর ভাইকে ভর্তি করে দিয়ে আসবো ইনশাআল্লাহ্

সজীব বলে, জী আঙ্কেল তাই হবে। আপনি ঠিকই বলেছেন শুভকাজে দেরি করতে নেই। আমরা এখন আসি আঙ্কেল, আসছালামু আলাইকুম বলে ছেলেগুলো চলে গেল

ছেলেদেরকে সাথে নিয়ে সেই সাথে মল্লিক বাড়ির একজন ও জাফর ভাই এর জমাইকে সাথে নিয়ে জাফর ভাইকে পিয়ার আলী বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করে দিয়ে আসি। আর এই ভেবে নিজেকে ধন্য মনে করি যে ছেলেগুলোর মহতী কাজের সাথে সম্পৃক্ত  হতে পেরে। সেই সাথে ছেলে গুলোকেও ধন্যবাদ জানাই এই জন্য যে বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেটের কু-প্রভাবের মোহে আজ যুবসমাজ যে পঙ্কিল অবক্ষয়ের মধ্যে দুর্গন্ধ নর্দমায় নিমজ্জিত হয়ে সমাজে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে তাদেরকে ধিক্কার দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। সেখানে এই ছেলে গুলো সমাজ উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখে সমাজে গৌরবোজ্জ্বল সৌরভ ছড়াচ্ছে। স্যালুট জানই তাদের প্রতি। গ্রাম বাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে "কাদার মধ্যে থেকেও গোঁচই মাছের গায়ে কাদা লাগে না"। তেমনি এই ছেলে গুলো সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যে থেকেও সমাজ উন্নয়ন ও আর্তমানবতা সেবায় আত্মনিয়োগ করে যাচ্ছে তারা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।

দেখতে দেখতে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। এর মধ্যে বৃদ্ধাশ্রমের পরিধি তথা আশ্রিতদের সংখ্যা বেড়ে গেছে। মাঝে মাঝে আমি দেখেতে যাই তারা কে কেমন আছে। তারপরেও মাঝে মধ্যে মাসিক সভায় থাকতে হয়। সেদিন গিয়ে দেখি আঙ্গিনায় বকুল গাছের নিচে চেয়ারে বসে এক ভদ্রলোক বই পড়ছেন। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। চেহারাতে একটা ঐতিহ্যের ছাপ। চুল গুলো সম্পূর্ণ সাদা, চাপ দাড়ি। কাছে গিয়ে ছালাম দিতেই বই থেকে মুখ তুলে ওয়া আলাইকুম আসছাম বলে আমার দিকে তাকিয়ে পাশের চেয়ারে বসতে বললেন। জিঙ্গেস করলাম কী বই পড়ছেন ভাই সাহেবউনি বলেন এই জীবন সায়ন্নে এসে কী আর পড়বো ভাইসাহেব! এই যে দেখুন বেদূঈন সামাদ এর "বেলাশেষে "। জীবন চলার পথে যেতে যেতে লক্ষ্য করে দেখি নিজের ছায়াটা পূর্বদিকে নিজের চেয়ে বড় হয়ে গেছে। বুঝতে আর বাঁকি রইল না জীবন নামক সূর্য টা মধ্য গগন থেকে অনেকখানি পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। আর কিছুক্ষণ পরে জীবনাকাশে সন্ধা ঘনিয়ে আসবে, তারপর নিকষকালো আঁধারে ঢেঁকে যাবে জীবন নামক সূর্যের দীপ্ত আলো। উনার আধ্যাত্মিক কথার মানে বুঝতে খুব একটা কষ্ট হলো না। কারণ আমিও তো উনার পর্যায়কালের একজন। উনার জ্ঞানগর্ব কথাগুলি বেশ ভালো লাগলো আলাপচারিতার এক পর্যায়ে জানতে পারলাম ভদ্রলোকের নাম সাদিক সাহেব পুরো নাম মোঃ সিদ্দিকুর রহমান। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। যাঁদেরকে বলা হয়ে থাকে মানুষ গড়ার প্রথম স্তরের কারিগর। এখানে কেনো! জানতে চাইলে তিনি বলেন এটাতো বৃদ্ধাশ্রম মানে বৃদ্ধদের নিবাস তাই না? আমি বিব্রত হয়ে বললাম হ্যাঁ না মানে...। উনি আবার বলে উঠলেন আমি এখানে কোনো ভিজিটর বা পরিদর্শক হয়ে আসিনি, আমি এখানে থাকতে এসেছি স্বেচ্ছায়। বেশ ভালই লাগছে সমবয়সীদের সাথে সময়টা বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছে। এটাই চেয়েছিলাম এমনই এক গ্রামীণ মনোরম পরিবেশ পাশেই মসজিদ এমন এক পরিবেশে জীবনের শেষ দিন গুলি যেন কাটিয়ে দিতে পারি। আমারতো কোনো কিছুর অভাব নেই। অভাব কেবল নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী। জিঙ্গেস করি বড়িতে আপনার কেউ নেই? তিনি এক দীর্ঘস্বাস ছেড়ে বলেন একমাত্র ছেলে সে এখন অস্ট্রেলীয়ার নাগরীক সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে হাত ধরাধরি করে যাকে নিয়ে সংসার নামক মহাসড়ক ধরে পথ চলা শুরু করি। আমার জীবন সঙ্গী খোকার মা দুঃখের ভাগ মাথায় নিয়ে সমস্ত সুখের ভাগটা আমাকে দিয়ে আজ পাঁচ বছর হলো চলে গেছে সেই না ফেরার দেশে। হ্যাঁ বলতে পারেন সুখেই আছি।  কিন্তু একে কী সুখ বলে?

আমি বিষ্ময় হয়ে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে উনার কথা শুনে যাচ্ছি। কথার মাঝে নেই কোনো মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগের ছাপ। কথার স্বরে ও ভঙ্গিতে কেবল বুঝা যায় সাথী হারা নিঃস্বঙ্গ একাকিত্বের বেদনার সুর। আমি বললাম আপনি ছেলের কাছে অস্ট্রেলিয়া থাকতে পারেন না? উনি বলেন, হ্যাঁ ভাই সাহেব ওখানে ছিলাম কিছুদিন। ভালো লাগেনি। অজানা এক কিসের টানে মনে স্বস্তি পেতাম না। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর হাত ধরাধরি করে যাকে সাথে নিয়ে চলেছি তাকে এই দেশের মাটি রেখে মনে কখনও স্বস্তি পাইনি ভাই। বলতে বলতে এবার উনার কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠলো অশ্রুসজল কণ্ঠে বলতে থাকে। সেদিন এশার নামাজ শেষে ঘুমুতে যাবো এমন সময় আমার গিন্নী বলে উঠলো ওগো আজ আমার যেনো কেমন লাগছে, মনের মধ্যে ভালো লাগছে না। হঠাৎ আমার হাত দু'টি ধরে বলে ওগো আমাকে মাফ করে দিও। অনেক অন্যায় করে ফেলেছি তোমার কাছে। আমার বুকে মাথা রেখে মিনতি কণ্ঠে বলে, বলো মাফ করে দিলে তো? আমার খোকার সাথে আর দেখা হলো না। ওকে বলো.....। কথা থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম এসব অলক্ষুণে কথা বলতে নেই আল্লাহ্ নারাজ হয়। ঔষধ গুলো খেয়ে শুয়ে পড়ো সব ঠিক হয়ে যাবে। জৈষ্ঠের শেষের দিক প্রচণ্ড গরম। ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে অতিতের কিছু স্মৃতিচারণ, আর একমাত্র সন্তান আমাদের খোকা স্কলারশীপ নিয়ে অস্ট্রেলীয়াতে অধ্যয়নরত তাকে ঘিরে আলাপ করতে করতে  ঘুমিয়ে পড়ি। ভোরে ফজরের আযানের সময় আমাকে ডেকে তোলে সেদিন আর আমাকে সে ডাকে নাই। ঘুম থেকে উঠে আমি তাকে  ডাকি কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। গায়ে হাত দিয়ে ডাকতেই অনুভব করি তার শরীর ঠাণ্ডা বরফের মত। উদগ্রীব উৎকণ্ঠায় আলো জ্বালিয়ে পরোখ করে দেখি তার প্রাণহীন নিথর দেহ পড়ে আছে বিছানায়। আমি হতবাক হয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি তার চিরনিদ্রায় শায়িত শান্ত ফ্যাকাসে মুখপানে। একান্তে পাশে থেকেও কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। সেদিনের সেই অপ্রত্যাশিত আকষ্মিক ঘটনা আজও ভুলতে পারিনা। আর কী করেইবা ভুলবো বলুন! সে ছিল আমার অর্ধাঙ্গিনী আমার খোকার মা। বলতে বলতে তিনি আর কিছু বলতে পারেন না গণ্ড বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে

আমি সৌজন্যমুলক শান্তনা দিয়ে তাঁকে বলি দুঃখ করবেন না ভাই সাহেব এখানে কারো হাত নেই। এখন দোয়া করা ছাড়া কিছুই করার নেই। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে দোওয়া করি মহান রাব্বুল আল্আমিন উনাকে জান্নাত নসিব করেন। আবার দেখা হবে বলে আমার পরিচয় দিয়ে মোবাইল নম্বর আদান প্রদান করে উনার নিকট থেকে বিদায় নিয়ে পিয়ার ভাই, ভাবি ও জাফর ভাই এর সাথে কথা বলে বড়ির উদ্দ্যেশে রওনা দিই। আর ভাবতে থাকি জীবনের শেষ দিকটা কার কী ভাবে কাটবে তা কেউ বলতে পারে না। আল্লাহ্পাকই নির্ধারণ করে রেখেছেন কাকে কী অবস্থায় রাখবেন।

বাড়িতে এসে ভাবির কথাটা বার বার কানে বাজতে থাকে। তিনি বলছিলেন আবার আসবেন ভাই সাহেব আপনার ভাই এর শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। তেমন কিছু খেতে চাচ্ছে না। আপনার সাথে পরিচয় হওয়ার পরথেকে আপনি আমাদের অতি আপনজন হয়ে উঠেছেন। আপনি যেন আমার মা'র পেটের ভাই। আমারতো ভাই নেই। ভাবতে থাকি সবারই বয়স হয়েছে শেষ জীবন কার কেমন কাটবে কে জানে। বাড়িতে আমরাও কেবল দু'জনই থাকি ছেলে-মেয়ে যার যার কর্মক্ষেত্রে। বয়সতো আর কম হলো না। চাকুরী থেকে অবসরযাপন এক যুগ পেরিয়ে গেলো

বকুলপুর থেকে আসা প্রায় মাস হয়ে আসল। বৃদ্ধাশ্রমে যেতে যতে আমারও একরকম ভালো লেগে গেছে সমবয়সীদের সাথে কিছুটা সময় কাটাতে আমারও বেশ ভালো লাগে। ফযরের নামাজ আদায় শেষে হাঁটাহাঁটি করছি এমন সময় ফোনটা বেজে উঠলো। এতো সকালে ফোন? বিশেষ কারণ ছাড়া এতো সকালে কেউ কারো কাছে ফোন দেয় না। ফোন হাতে নিয়ে দেখি সাদিক সাহেব। রিসিভ বাটন টিপতেই অপর প্রান্তের প্রশ্নের উত্তরে বললাম হ্যাঁ ভাই আমি সুজন বলছি। কী বললেন! এ কী বলছেন আপনি! পিয়ার আলী ভাই আর নেই! হ্যাঁ হ্যাঁ আমি এখনই রওনা দিচ্ছি। পরক্ষণেই আবার সভাপতি সাহেবের ফোন উনারও ঐ একই কথা

দুঃখভারাক্রান্ত মনে বকুলপুর গিয়ে হাজারও মানুষের উপস্থিতিতে পিয়ার আলী ভাই এর জানাযা শেষে দাফনক্রিয়া সম্পন্ন করে ব্যাথিত হৃদয়ে বাড়ি ফিরে আসি। আর ভাবতে থাকি। হায়রে মানুষ জীবদ্দশায় যাকে দোওয়া করতে বলা হয়ে থাকে হাজার বছর বেঁচে থাকো। মানুষ কী কখনও হাজার বছর বেঁচে থাকেআসলে হাজার বছর বেঁচে থকার অর্থ হলো মহানুভবতা ও কৃতীত্বের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকা। আজ তেমনই এক মহানুভব ব্যক্তি পিয়ার আলী না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেও তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে তাঁর মহানুভবতা ও কৃতিত্বে গড়া প্রতিষ্ঠান "পিয়ার আলী বৃদ্ধাশ্রম "