সুখের সন্ধানে
মোঃ আশাফুল ইসলাম (চাঁদ)
অজ পাড়া গাঁ এর একটি চা
দোকান। না না অজ শব্দ দিয়ে হয়তো এখন আর কোনো গ্রামকে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ
নেই। এই গ্রামটির ক্ষেত্রেও ঠিক তাই।
এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। বেশ ভালো লাগছে। ছিমছাম সাজানো গোছানো বেশ বড় গ্রামটি। তিনটি মহল্লা বা পাড়ায় বিভক্ত। নুতন পাড়া, পুরাতন পাড়া ও পশ্চিম পাড়া। যে স্থানের কথা বলছি অর্থাৎ যে স্থানটির চা এর দোকান অবস্থিত সেই অংশের নাম নতুন পাড়া। গ্রামের মানুষ গুলোও বেশ আতিথ্য পরায়ণ। চা দোকানের স্থানটি বেশ পরিচিত। কয়েক দিনেই জেনে গেছি স্থানটিকে কেউ বলে গেটের উপর, কেউ বলে চাষিক্লাব মোড়, আবার নেতার মোড়ও বলতে শোনা যায়। একজন বয়স্ক মানুষকে জিজ্ঞেস করি স্থানটিকে গেটের উপর বলা হয় কেন। তিনি বলেন আমরাও শুনে আসছি আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। এই যে রাস্তা, একসময় এই রাস্তার উপর নাকি ছিল রেল লাইন, আর এইখানে ছিল রেলের গেট। তাই স্থানটিকে বলে গেটের উপর।
কয়েক দিনেই চা এর দোকানদার ছেলেটির সাথে বেশ আলাপ জমে উঠেছে। দোকানের সামনে এসে বসলেই বলে উঠে স্যার চা দেই। বড় কোন সাইনবোর্ড না হলেও লিগ্যাল সাইজের কাগজে কম্পিউটার কম্পোজ করে লেমিনেটিং করে দেয়ালের সাথে লাগানো আছে ‘স্বপ্নিল’ টি স্টল। লেখার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবছি। সেদিন যে কোচে এসেছি সেই কোচটির সামনের গ্লাসে বড় হরফে লেখা 'স্বপ্নিল' পরিবহণ। আবার কোচ থেকে নেমে যে ভ্যানে উঠলাম সেই ভ্যানের বডিতেও লেখা 'স্বপ্নিল' পরিবহণ। বিষ্ময় ভরে তাকিয়ে আছি ঐ ছোট্ট একটি লেখার দিকে। স্তরভেদে স্বপ্নের কত ব্যবধান। যার যার অবস্থান থেকে তার তার মতো করে সুখের সন্ধান করে চলেছে। ভাবতেই অবাক লাগে। দোকানদার ছলেটি বলে উঠলো স্যার চা। সম্বিত ফিরে পয়ে বললাম ও হ্যাঁ দাও। চা এর কাপে চুমুক দিচ্ছি আর ভাবছি।
ছেলেটি আবার বলে উঠলো স্যার
পান দেবো? ইতমধ্যে সে জেনে গেছে। পানের সাথে আমি কী কী খাই। বললাম
হ্যাঁ দাও। কাগজে জড়িয়ে দেবে। চা শেষ করে খালি কাপটা রেখে কাগজে মোড়ানো পানটি নিয়ে
উঠতেই পান মোড়ানো কাগজে একটি লেখার উপর নজর পড়লো।
একটু নড়েচড়ে বসলাম। লেখাটি
হচ্ছে সুখের ঠিকানা ----। পান মোড়ানো কাগজটি খুলে পান মুখে দিয়ে ভাবছি ছেলেটি কী
দুর্ভাগা পান জড়িয়ে সুখের ঠিকানাটা আমাকে দিয়ে দিলো? যার জন্য শহুরে জীবন থেকে কয়েক দিনের জন্য গ্রামে আসা। এতো সহজেই "সুখের
সন্ধান" পেয়ে যাবো ভাবতে অবাক লাগছে। যার সন্ধানে কতখানেই না গেছি। পাহাড় -
পর্বত, ঝর্ণা - লেক, সৈবাল - সৈকত কত খানেই
খুঁজেছি। যেখানেই দেখেছি আলোর ঝিকিমিকি, হৈ- হল্লোল রঙ্গীন ঠোঁটে হাসির বন্যা বয়ে যাচ্ছে, না জানি সেখানে কতো সুখের ছড়াছড়ি। কিন্ত না সবই মেকী। নিবিড় একান্তে মিশে
দেখেছি সেখানে চলছে রীতিমত সুখ নিয়ে কাড়াকাড়ি। আবার কোথাও কোথাও চলছে অতিমাত্রাই
বাড়াবাড়ি। আবার কোথাও কোথাও চলে হতা হাতি। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে ছাড়াছাড়ি।
পান মোড়ানো কাগজটি ভালো ভাবে ছাট করে আগ্রহভরে পড়তে থাকি। সুখের সন্ধান,,,,,,,,,,জেনে রাখুন এখানে দেয়া হলো সুখের সন্ধান।" প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাওয়া - না পাওয়ার আকাঙ্খা বা লালসা যেখানে নেই সেখানেই পাবে সুখের সন্ধান"। তবে,,,,, ও হো! এখানেই কাগজটা ছিঁড়ে দুই খণ্ড করা হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে ঐ তবে টা কী? চা এর দোকানদার ছেলেটিকে বললাম। এই ছেলে এই কাগজটার বাঁকি অংশটুকু আছে নাকি দেখতো। ছেলেটি বলে না স্যার হয়তো অন্য কাউকে পান জড়িয়ে দিয়েছি। ক্যান স্যার কিছু হয়েছে? বললাম না না তেমন কিছু না। ভাবছি! প্রয়োজনের অতিরিক্ত-----? প্রয়োজনের পরিধি পরিমাপক যন্ত্র বা কোন মানদণ্ড আদৌও আবিস্কার হয়েছে কিনা জানা নেই।
এমন সময় একজন পাশে এসে বলে বড়ভাই মসজিদে যাবেন না? একটু পরেই মাগরীবের আযান হবে। এরই মধ্যে গ্রামের কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। গ্রামে কয়েকটি গোষ্ঠী বা গোত্র যেমন সরদার, বিশ্বাস, শেখ, মালিথা, মোল্লা, মন্ডল, প্রামাণিক তাদের নিজস্ব পরিচিতি বহন করলেও একই ছাতার তলে অর্থাৎ ছায়া শীতল একই গ্রামে বসবাস করে আসছে অন্তরঙ্গভাবে। একই মসজিদে নামাজ আদায় করছে, একই ঈদগাহে এক কাতারে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে ঈদের নামাজ আদায় করে থাকে। একই কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত করে আসছে জানাযা শেষে একে অপরের আপনজনকে।
মাগরীবের নামাজ শেষে এশার
নামাজের আগপর্যন্ত মুরুব্বীদের সাথে আলাপচারিতার মধ্যদিয়ে সময় কেটে যায়। এই
গ্রামের কৃতিসন্তান, না শুধু এই গ্রামের বললে
ভুল হবে দেশের গর্ব বীর মুক্তিযোদ্ধা তিনি একজন প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান। তাঁর
সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে কয়েক দিনের মধ্যেই। তাঁকে চাচা বলে সম্বোধন করি। ভদ্রলোক
অত্যন্ত সদালাপী। একজন সামাজিক ও রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিত্ব। তাঁর সাথে কথায় কথায়
স্মৃতিচারণ করে সময়টা বেশ ভালই কেটে যায়। আর একজন অত্যন্ত ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন
আত্নসচেতন ব্যক্তি চাকুরী জীবন শেষে অবসর জীবনযাপন করছেন। সময় সময় তাঁর সাথে বসে
জীবনের অনেক স্মৃতিচারণ করে সময় কেটে যায়। যেহেতু আমিও একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারী
চাকুরীজীবী। এমনি ভাবে গ্রামের প্রতিটি স্তরের মানুষের সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে।
বিশেষ করে একটা বিষয় দেখে সবচেয়ে ভালো লেগেছে কৃঞ্চচুঁড়া যুবসংঘের স্বেচ্ছায়
রক্তদান কর্মসূচী। রক্তের গ্রুপভিত্তিক তালিকা করে সংরক্ষণ করে সর্বসাধারণের জন্য
স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি গ্রহণ করে সমাজে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে।
এতো কিছু ভালো লাগার মধ্যেও একটা বিষয় সবসময় মনকে তাড়া করে বেড়ায় সুখের সন্ধানটা ঐ তবের মধ্যে আটকে গেল।
গ্রামে রয়েছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। দেখতে গেলাম গ্রামের মানুষ গুলো কিভাবে স্বাস্থ্য সেবা পেয়ে থাকে। বেশ খানিক বসে দেখলাম গ্রামের অসহায় মানুষের দোরগোড়ায় কিভাবে স্বাস্থ্য সেবা পৌছে দিয়েছে সরকার।
কমিউনিটি ক্লিনিক এর স্বাস্থকর্মী মেয়েটি বেশ সদালাপী ও মিশুক। নিবিড় আন্তরিকতার সাথে রোগীদের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত পরামর্শ সহকারে তার বরাদ্দের সীমাবদ্ধতার মধ্য থকে কিছু ঔষধ পত্র দিয়ে একে একে বিদায় করছে। স্বাস্থ্যকর্মীর সাথে কথা শেষ করে আমি উঠে আসছি, এমন সময় এক বৃদ্ধাকে লাঠি ভর দিয়ে আসতে দেখে থেমে গেলাম। স্বাস্থ্যকর্মী দেখে শুনে পরামর্শ সহকারে কিছু ঔষধ পত্র দিয়ে বিদায় করলে বৃদ্ধা মহিলাকে জিঙ্গেস করলাম আপনি একা এসেছেন?
সে বললে। হ বাবা। একটা
ভ্যানে আইছি। ভ্যানটাতো ছেড়ি দিছি। এখন ঐ রাস্তার উপর গেলিগা ভ্যান পাবো।
বললাম চলেন আপনাকে রাস্তা
পর্যন্ত এগিয়ে দিই।
সে বললে না না আমি একলাই যাতি পারবোনে। একলাইতো আইচি । তাছাড়া এই দুনিয়ায় আসার সময়তো একলাই আইচি আর যাতিও হবি একলা। মদ্যিখানে কতজনার জন্যি কত কী করনু। এখুন কারও সুমায় নাই। কথার মধ্যে যেন একটা অভিমান, আক্ষেপের প্রতিধ্বনি শুনতে পেলাম। কথা বলতে বলতে টুক টুক করে রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকি। জিঙ্গেস করলাম, ‘আপনার ছেলে আছে না?’
সে বললে - ‘হ্যাঁ, ছেলি, ছেলির বৌ, নাতী, নাতনী সবই আছে। তারাতো আমার কাছে থাকে না। ছেলি আমার ঢাকায় চাকরী করে। ছেলি - বৌ নিয়ে বাসায় থাকে।’
বললাম, ‘আপনি বাসায় থাকতে পারেন না?’
হ্যাঁ বাবা ছেলির বাসায় কিছুদিন ছিনু। ভালো লাগে না। দম বন্ধ হয়ে আসতি চায়। বিটার বৌ কথায় কথায় উঠতি বসতি খুঁটা দিতিই থাকে। আমার কাশির শব্দটা নাকি ভালো না। আমার কাশির জন্যি নাকি ওদের ঘুম হয় না। তারপর আমি আমার স্বোয়ামির ভিটি যার মতন সুখের জাগা আর কোন খানি নাই। এখুন আমি একলাই স্বোয়ামির ভিঁটি ধরি পড়ে আছি। ছেলির বাবা ঐ এক ছেলি আর একটি মেয়ে ছোট্ট রাখি ওদের মানুষ করার ভার আমার উপর দিয়ে পরপারে চলে গেছে বাবা। বলতে বলতে মহিলাটি অঝোরে কান্নায় ভেঁঙে পড়লো। তাকে শান্তনা দেবার ভাষা আমি ঐ মুহুর্তে খুঁজে পাইনি। এরই মধ্যে রাস্তার উপর এসে গেছি। একটা ভ্যানও দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাটি বললে আমি এখুন যাই।
আমি বললাম একটু বসেন আরও কিছু কথা শুনি।
শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে। স্বাভাবিক স্বরে সে বলে তুমি শুনে কী করবে বাবা। আর তুমাকে বলেই বা কী হবি? তুমাকেতো চিনিনা।
বললাম শুনি না। এমন বেটার বৌদেরকে বলতেতো পারব আজ তোমরা মা দু'দিন পরে তোমরাও শাশুড়ি হবে। আপনার ছেলে কিছু বলে না?
সে বলে, হ্যাঁ ছেলি আমার বড্ড ভালো। সংসারে ঝামেলা বাড়বে ভেবে
ছেলি আমাকে বলে মা একটু ধৈর্য্য ধরো মা তোমার নাতি বড় হচ্ছে। এ কথার মানে কী বাবা? এ কথার মানে বুড়ি টা বুঝতে না পারলেও হয়তো কারও বুঝতে তেমন কষ্ট হচ্ছেনা।
আমি বললাম আপনার মেয়ে জামাই আছে না? তারা আপনার খোঁজ খবর রাখে না ?
সে বললে তারওতো আমার মতো
বুড়ো শাওড়ি আছে। আমার মায়া সেওতো একজনের বিটার বৌ। তারওতো আমার মত অবস্থা। বয়স হইছে। দোষ কারও
দেবো না বাবা দোষ এই পোড়া কপালের। আমরাওতো এক কালে বিটার বৌ ছিনু। এটা আমার কপালের
দোষ বাবা। কারো উপর আমার কোন আক্ষেপ নাই।
সবাই ভলো থাকুক। ওদের জন্য
দোয়া করি। আমার নাতি - নাতনী ওরা সুখি থাকলি আমার সুখ। স্বোয়ামির ভিঁটি ধরে এইভাবে চলে যাতি পারলি হয়।
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম ঔষুধ পত্র সেই সাথে অন্যান্য খরচের টাকা পয়সা কীভাবে আসে?
সে বললে ছেলি কিছু কিছু পয়সা কড়ি দেয়। আবার সরকার ভাতা দেয় দুই চারটি চৈ (হাঁস) মুরগি পুষি। ওতেই চলে যায়। এরই মধ্যে একটা ভ্যান এসে দাঁড়ালো। মহিলাটি বললে আমি এবার যাই বাবা। ঐ দিকে আবার চৈ (হাঁস) মুরগী গুলিকে খাতি দিতি হবি। আবার বেলা মাথার উপর হতি গড়ে যাচ্ছে স্যান (গোসল) করতি হবি অনেক দেরি হয়ে গেলো। এই জন্যিতো একটু আকাবাকি (তাড়াতাড়ি) করছি। আল্লাহ্ তুমাকে ভালো করুক বাবা। সুখে থাকো।
বললাম আচ্ছা ঠিক আছে। ভ্যানে মহিলাটির গমন পথের দিকে চেয়ে ভাবতে থাকি নিজে তেমন ঠিকমত চলতে পারে না। এতো কষ্টের মধ্যে থেকেও সে বলে আমি সুখেই আছি। তাহলে আমি আবার কোন সুখের সন্ধান করে বেড়াচ্ছি?
এই গ্রামের যে কৃতিসন্তান এর অবদান, যার জনসেবা ও সামাজিক মূল্যবোধ এর চিন্তা চেতনায় জমি ডোনেশন সহ তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করে সরকারের স্বাস্থ্য সেবা প্রন্তিক জনগনের দোরগোড়ে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। কমিুউনিটি ক্লিনিক এর দেয়ালে লাগানো সৌজন্যফলকে লেখা দেখলাম জমি ডোনেশনে এ্যাডভোকেট জনাব মোঃ আব্দুল হালিম বিশ্বাস। একজনের কাছে জানতে চাইলাম উনার পরিচয়। সংক্ষিপ্ত আকারে তিনি যা বললেন এই গ্রামের নুতনপাড়ার ঐতিহ্যবাহি সরদার গোষ্ঠির কৃতি সন্তান তিনি। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত। এইযে, কী বল্লেন? সৌজন্য ফলকে লেখা দেখলাম, পদবী বিশ্বাস আর আপনি বলছেন সরদার গোষ্ঠির সন্তান। এ কেমন হলো? তিনি বলেন এটাতো আমি বলতে পারবো না ভাই। সবাইতো সরদার গোষ্ঠীই বলে থাকে। আপনি বরং সরদার গোষ্ঠির কারও কাছ থেকে জেনে নেবেন।
বললাম আচ্ছা ঠিক আছে। এতদ
অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি ড্রেনেজ ক্যানেল রয়েছে।
সেই ক্যানেলের উপর ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তায় একটি ব্রিজ। ঐ ব্রিজের পাশে একটি
পাইকড় গাছ। গাছটি কবে কে লাগিয়েছিলেন তার খোঁজ কেউ না রাখলেও যিনি লাগিয়েছিলেন এমন
গাছ প্রেমী ব্যক্তি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তাঁকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। গাছটির সুশীতল ছাঁয়ায় দাঁড়িয়ে কত কিছুই না ভাবছি। ভাবছি একমাত্র নারী জাতিই
কেবল তার নিজের গোত্রের বা বংশের পদবী বিসর্জন দিয়ে একেবারে এক নুতনত্বের সাথে
মিশে গিয়ে আপন সত্বাকে হারিয়ে ফেলে। তাই ঐ মহিলাটি তার স্বামির ভিঁটায় একলা পড়ে
থেকেও বেশ সুখেই আছে। এমন সময় এক ভদ্রলোক ভ্যান থকে
নেমে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো।
ভদ্রলাকের মাথায় একঝাঁকড়া চুল তারউপর সাহেবি ক্যাপ, কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ, হাতে ক্যামেরা। গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দেখে মনে হলো কোনো সাংবাদিক কিংবা সিনেমার পরিচালক বা ক্যামেরাম্যন হবে। অথবা কোনো কবি সাহিত্যক হবে। আবার বেশ ভুষার অবস্থা দেখে এক অজানা আশঙ্কায় বিব্রতবোধ করতে থাকি। না জানি কোনো পাগলের পাল্লায় পড়লাম নাকি।
কিন্তু না তিনি ভদ্রচিতভাবে সাবলিল ভাষায় জিঙ্গেস করলেন, ভাই এখানে বিজয়কেতন মোড়টা কোথাই ভাই?
বললাম বিজয়কেতন মোড়ের কথাতো
শুনি নাই ভাই। তাছাড়া আমি এখানে নুতন, বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে এসেছি।
এমন সময় ভদ্রলোকটির মোবাইল
ফোনটা বেজে উঠলো। সরি,, ভাই। এই জায়গাটির নাম কী
ভাই?
বললাম এই জায়গাকেতো অনেককে
অনেক নামে বলতে শুনি। খাঁড়ারা নুতনপাড়া চাষীক্লাব মোড়েই বেশি পরিচিত। ভদ্রলোকটি
মোবাইল ফোনে অপর প্রান্তের সাথে কথা বলতে বলতে ইশারাই আমাকে ছালাম জানিয়ে ভ্যানে
উঠে রওনা দিলেন। উনার গমন পথের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি ভদ্রলোকের নিশ্চয় কোনো তাড়া
আছে। সেই সাথে একটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাকা খেতে থাকে। বিজয়কেতন...? লড়াই সংগ্রাম বা প্রতিযোগিতা বা কাজের মাধ্যমে জয় করে কোন
কিছু অর্জন করাই হচ্ছে বিজয়। আর কেতন অর্থ পতাকা বা
নিশান। যেমন ১৯৭১ সালে নয় মাস এক রক্তক্ষয়ী
লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয় অর্জন করে একটি স্বাধীন দেশ
ও লাল সবুজের পতাকা পেয়েছি। নিশ্চয় ঐ বিজয়কেতন মোড়ের কোন একটা
গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। ভদ্রলোক হয়তোবা সেই সুত্র ধরেই ঐ বিজয়কেতন মোড়ের খোঁজে
এসেছেন। ওহঃ ভদ্রলোকের মোবাইল নম্বরটা কেন যে রাখলাম না!
এই গ্রামে চাষীক্লাব সংলগ্ন আর একটি চা দোকান। লিটনের চা দোকান নামে পরিচিত। দু'টি কৃষ্ণচুড়া গাছের সুশীল ছাঁয়াতলে দোকানটির অবস্থান। দোকানটি বেশ খোলামেলা। সকালের দিকে তিন - চার ঘন্টা আবার বিকালের দিকে চার - পাঁচ ঘন্টা চা - পান বিক্রি করে থাকে।
দোকানটি খোলামেলা ও নিরিবিলি হওয়ায় যেসব লোকের পদচারণা বা নিত্যদিন যারা এখানে আসে এবং বসে তারা সবাই মুটামুটি বয়ষ্ক। প্রতিদিন চা এর আড্ডায় বসে একে অপরের সাথে আলাপচারিতার মধ্য দিয় সুখ - দুঃখের কথা বলে সময় কাটায়।
স্থানটির নাম চাষিক্লাব কেন? জানতে চাইলে একজন মুরুব্বি বিজ্ঞের সাথে বলতে লাগলেন।
বেশ স্পষ্ট মনে আছে তখন
আমার বয়স আনুমানিক ৮/১০ বছর হবে। ষাটের দশকের
প্রথম দিকের কথা। এই জনপদকে তদানিন্তন পাকিস্তান নামক দেশের একটি প্রদেশ, পূর্ব-পাকিস্তান বলা হতো। তখনকার সরকার
জি, কে প্রোজেক্ট যার পুরো অর্থ হলো গঙ্গা কপোতক্ষ সেচ প্রকল্প। পদ্মানদী থেকে
ঝিনাই পর্যন্ত ক্যানেল খনন করে কপোতাক্ষনদ পর্যন্ত বিস্তির্ণ এলাকায় সেচ প্রকল্প
চালু করে তদানিন্তন সরকার। ভেড়মারা সংলগ্ন পদ্মানদীর পাড়ে পাম্পহাউজ স্থাপন করে, পাম্পের সাহায্যে পদ্মানদী থেকে পানি উত্তোলন করে, মাঠে মাঠে পানি সরবরাহ করে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার লক্ষে, প্রকল্পের আওতায় প্রান্তিক চাষীদেরকে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য, সেচ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন স্থানে চাষীদের জন্য ক্লাব তৈরী করে। তারমধ্যে
এটা হলো একটি চাষীক্লাব। সেই থেকে এই স্থানের নাম চাষীক্লাব।
এই চাষীক্লাব ঘিরে এলাকা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। বিদ্যুতের আশির্বাদে এখকার মত মানুষের জীবন যাত্রা তখনকার দিনে এতো সহজ ছিল না। তখকার দিনে অর্থাৎ ষাটের দশকের কথা বলছি। তখন মাগরীবের নামাজের পরেই পুরো গ্রাম এমন নিকষকালো অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যতো যে, এশার নামাজের সময় একজন মানুষকেও বাহিরে দেখা যেতো না। দু'একজন এশার নামাজ পড়তে মসজিদে গেলেও তাদের হাতে থাকতো হারিকেন কারও কারও হাতে দেখা যেতো টর্চ লাইট। কেবল মাত্র এই চাষীক্লাবে হ্যাচাক লাইটের আলোয় গ্রামের চাষী ও কিছু গন্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে চাষীক্লাবের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মত বিনিয় চলতো। এমনকী ঐ হ্যচাকের আলোয় অনেক সাংস্কৃতিক অনূষ্ঠান ও নাটক যাত্রা পর্যন্ত হয়েছে এই চাষীক্লাব প্রাঙ্গণে। সেই হ্যাচাক আবার সবাই জ্বালাতে পারতো না, মেন্টেল বাঁধা, পাম্প করা এসব কাজের জন্য বিশেষ লোক ছিল সেই সময়।
একদিন একটা অনুষ্ঠান চলছিল, শব্দগান আবার অনেকে কবিগান বা পালাগানও বলে থাকে। ঐ পালাগান দুই তিন রাত্রী এমনকি সপ্তাহ ধরে চলত। হঠাৎ আলো কমে যতে দেখে একজন বলে উঠলো। এই ছলিমুদ্দি হ্যাচাকে হাওয়া দে। হ্যাচাক নামিয়ে হাওয়া দিতে গিয়ে মেন্টেল ভেঙ্গে গেল। সমস্ত এলাকা অন্ধকারে ডুবে গেল। যদিও অতিরিক্ত একটা হ্যাচক ছিল, সেটা জ্বালাতেও তো সময় লাগবে। কেউ কেউ হারিকেন টর্চলাইট নিয়ে অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। তাদের সঙ্গে থাকা হারিকেন জ্বালিয়ে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে থাকে। হ্যাচাক জ্বালানোর অপেক্ষায়। যেমন বাস চলতে চলতে টায়ার লিক হয়ে হাওয়া বের হয়ে গেলে চাকা বদল না হওয়া পর্যন্ত যাত্রীদের যেমন অপেক্ষা করতে হয় ঠিক তেমন।
জিঙ্গেস করলাম এই যে কৃঞ্চচুঁড়া গাছ দেখছি গাছটির বয়স কত হতে পারে? দেখে তো মনে হচ্ছে এই গাছের বয়স অনেক।
তিনি বলেন এই চাষীক্লাব ঘিরে বেশ কিছু কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ ছিল। ওভারশিয়ার, পাটোয়ারী, বেলদারদের বসবাসের জন্য ছিল স্টাফ কোয়র্টার পরিবারবর্গ নিয়ে তারা চাকরী করতেন। শেচ প্রকল্পের কাজ তদারকি করতেন। কালের বিবর্তনে আজ তার প্রয়োজনিয়তা হারিয়ে গেছে। জরাজীর্ণ অবয়ব নিয়ে সেই ক্লাবঘর আর স্টাফ কোয়ার্টার কালের স্বাক্ষী হয়ে টিকে আছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। তাদের সময়ে লাগানো এই কৃঞ্চচুঁড়া গাছ। তখন থেকে হিসাব করলে ৬০/৬৫ বছর হবে এই গাছের বয়স।
প্রসঙ্গ শেষ হতে না হতেই চা এর দোকানের এক কোণ হতে একজন বলে উঠলেন। শুনছো কছিম ভাই, পশ্চিমপড়ার রমিজ ব্যাপারি ছেলেটাকে লেখাপড়া করিয়ে ভালোঘরে বিয়ে দিয়ে বেশ সুখেই আছে।
সঙ্গে সঙ্গে একজন কথা ধরে
ফেলল।
সে বলে উঠলো। আরে কথাটা এমন নয়। বিয়ে দিয়েছে নয়, বিয়েটা দিতে হয়েছে। এই বিয়ের কারণে তিনটি পরিবারের মধ্যে দুরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তাকি জানো ?
সে বলে না তাতো জানি না। বলো শুনি কী ঘটনা।
তাহলে শোন, মেয়ের বাবা তার এক বন্ধুকে কথা দিয়েছিল তার বন্ধুর ছেলের সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দেবে। আর রমিজ কথা দিয়েছিল তার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে তার ছেলের বিয়ে দেবে। কিন্তু ছেলে মেয়েদেরকে তারা কেউ কিছুই জানাই নাই। এদিকে ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে তাদের নিজেদেরমত করে কষতে থাকে ভালোবাসার এক জটিল হিসাব। সেই হিসাবের জট খোলা উভয় পক্ষের বাবা মা এর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই তাদের মতের বাইরে বাধ্যহয়ে এই বিয়ে দিতে হয়েছে। এখন বোঝো এই বিয়ের ফলাফল কী দাঁড়ালো। উভয় পরিবারের মধ্যে এখন সাপে নেউলে সম্পর্ক। তাই বলছি ছেলে মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে পূর্ব থেকে কথা দিতে নেই। আর ছেলে মেয়েদেরও ভাবা উচিৎ। বাবা মা কতো আশায় বুকে বেঁধে তাদের সন্তানদেরকে মানুষ করে তুলতে চায়। বাবা মা এর দিকটাও ছেলে ময়েদেরকে একটু ভেবে দেখতে হবে। তবে একটা কথা হলো কী, জন্ম - মৃত্যু - বিয়ে সম্পূর্ণ আল্লাহ্'র হাতে। আর সুখের কথা বললে না? সুুখ হচ্ছে একটা আপেক্ষিক - তত্ব। সম্পূর্ণ আত্মার প্রশান্তি। এ জগতে তারাই সুখি যারা অল্পতেই খুশি। আবার এই জগতে দুঃখি তারাই, যারা করে শুধু চাই চাই।
এ কী বলছো ভাই, এমন কথাতো শুনিনি। আমরা জানি ওদের সম্পর্ক বেশ ভালো একপাশ থেকে আরএক জন বলে উঠলো।
আরে বাহিরের অবস্থা দেখে মানুষের ভালো মন্দ বিচার করা যায় না। একজনের সম্পর্কে জানতে বা বুঝতে হলে তার সাথে নিবিড় ভাবে মিশতে হয়। মনুষের মাঝে উঠা বসা করতে হয়। তবেই একজনের সম্পর্কে কিছুটা জানা যায়।
চা এর দোকানের এই গল্পকে কী বিশেষণে বিশেষায়ীত করা যায় সেটাই ভবনার বিষয়। টিভি চ্যানেল খুললেই দেখা যায় অনেক বুদ্ধিজীবি বুদ্ধির যুক্তি তর্কে একে অন্যের সমালোচনা করে থাকে। তাকে বলে টক-শো। কিন্তু চা এর দোকানে এই কথোপকথন, তাকে কী বলা যাবে? শ্রমের বিনিময়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করে তাদেরকে শ্রমজীবি বলা হয়ে থাকে। আবার যারা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদেরকে কৃষিজীবি বলা হয়ে থাকে, আইন পেশায় যারা জীবিকা নির্বাহ করে তাদেরকে আইনজীবি বলা হয়ে থাকে। বুদ্ধি নিয়ে যাদের বিচরণ যারা বুদ্ধির বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করে তাদেরকে বুদ্ধিজীবি বলা হয়ে থাকে। কিন্তু চা এর দোকানের এই গল্পকে শুধু গল্প বলে উড়িয়ে দেবে? না। চা এর দোকানের গল্প যে একেবারে বস্তবধর্মী একথা এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এখানে যে সব কথোপকথন হয়ে থাকে সবই বাস্তবধর্মী, বাঙালী সংস্কৃতির শিঁকড়ের গল্প। উন্মুক্ত এই আলাপচারিতার মাধ্যমে অতিতের অনেক কিছু জানা যায়।
কথাটা শুনে বেশ ভলো লাগলো" এই জগতে তারাই সুখি, যারা অল্পতেই খুশি"। তবে প্রয়োজনের পরিধি আর অল্পের পরিমান নির্ণয় নিয়েই যত বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি।
গ্রামের প্রায় মানুষের সাথে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে একজন মুরুব্বির কাছে জেনেছি এই গ্রামে অর্থাৎ নুতন পাড়া পুরাতন পাড়ায় কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের লেখা পড়ার জন্য একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনিয়তা উপলব্ধি করে আসছিলো এলাকাবাসী বেশ কিছু দিন ধরে। কিস্তু উপযুক্ত উৎসাহী উদ্যোক্তা বা অভিভাবকের অভাবে কাজে হাত লাগাতে পারে নাই। তিনি বলেন....
এই গ্রামের নুতন পাড়ার ঐতিহ্যবহি সরদার গোষ্ঠির এক কৃতিসন্তান অত্যন্ত সাদা মনের দুরদৃষ্টি সম্পন্ন এমন এক আলোকিত মানুষ যিনি একজন এম এ, এল এল বি। আইন পেশার সত্য মিথ্যার যুক্তি তর্কের জালে না জড়িয়ে চাকুরী নিয়েছিলেন তদানিন্তন পাকিস্তান আমলে হাবিব ব্যাংকে ম্যানেজার পদে। অতঃপর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে সেই হাবিব ব্যাংক অগ্রণী ব্যাংক নামে পরিচালিত হতে থাকে। তিনি উক্ত ব্যাংকে চাকুরীরত এ জি এম (ফরেন শাখা) পদ থেকে চাকুরী হতে অবসর গ্রহণ করে ঢাকার নিজ বাসায় অবসর জীবন যাপন করলেও গ্রমের মানুষের খোঁজ খবর রাখতেন প্রতিনিয়ত। এরই মধ্যে কোন এক বিশেষ দিনে উনি গ্রামে এসে সকল স্তরের মানুষদেরকে ডেকে তাঁর মনের লালিত স্বপ্ন এই অঞ্চলের ছোট ছোট শিশু কিশোরদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন এর প্রয়োজনিয়তা তুলে ধরেন।
গ্রামের মানুষ গুলোতো একেবারে হতবাক। যেন মেঘ না চাইতেই জল। তারা সমস্বরে বলে উঠলো। আমরাওতো বেশ কিছুদিন ধরে এমন একটি স্কুলের প্রয়োজনিয়তা অনুধাবন করে আসছি। কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবো স্থির করে উঠতে পারছি না। উনি বললেন শুরুটা করতে হবে এমন জায়গা থকে প্রথমে স্থান নির্বাচন। তারপর নাম নির্ধারণ। এখন সেই জমি বিদ্যালয়ের নামে রেজিস্ট্রি করতে হবে। তার পরে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে। এরই মধ্যে স্থান নির্বাচন এবং নামও নির্ধারণ হয়ে গেল। শর্ত স্বাপেক্ষে যিনারা জমি ডোনেশন করবে তাদের পরিবারের মধ্যে শিক্ষিত ছেলে বা মেয়ে শিক্ষকতা করার উপযুক্ত থাকলে তাকে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। আবার কেউ যদি মোটা অংকের টাকা ডোনেশন করেন তাদের বেলাতেও ঐ নীতি অনুস্মরন করা হবে। তবে সরকারের শিক্ষানীতিমালা অনুস্মরণ করেত হবে যথাযথভাবে।
এর পরেও স্বেচ্ছাসেবী যুবসমাজ এর দ্বায়ীত্বটা গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রেখে বিদ্যালয় নির্মাণ কমিটি গঠন করে কাজ শুরু হয়ে গেল। কে কোন পদ পেলো আর না পেলো কে সভাপতি, কে সাধারণ সম্পাদক হলেন সেটা না ভেবে ছোটোখাটো মান অভিমান ভুলে সবাই মিলেমিশে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অতিতের সবকিছু ভুলে, একটা মহত উদ্দ্যেশ্য সামনে রেখে শুরু হয়ে গেল স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাঁশ কাঠ সংগ্রহের কাজ। যাদের বাঁশ ঝাড় আছে তারা কেউ কোন আপত্তি করেনি। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই প্রয়োজনিয় বাঁশ কাঠ সংগ্রহ হয়ে গেল। শুরু হয়ে গেল স্কুলঘর নির্মাণের কাজ।
একই সাথে চাষীক্লাবের পরিত্যক্ত বিল্ডিং এর রুমে কিছু চেয়ার, বেঞ্চ, টেবিল সংগ্রহ করে পূর্ব সিদ্ধান্তক্রমে শিক্ষক নিয়োগ করে শুরু হয়ে গেল শ্রেনী ভিত্তিক ছাত্র ছাত্রী পাঠদানের কর্য্যক্রম। অনেকে আবার বলতে থাকে ঐ দেখো পাগলের দলের কাণ্ড দেখো। এই ভাবে কখনও ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া হয়। যেকোন কাজের শুরুটা পগলামী মনে হলেও তার ফলাফল হয় সুখের। নিয়োগপ্রাপ্ত চার জন শিক্ষকের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সর্বস্তরের জনগণের স্বতস্ফুর্ত সহযোগীতায় অল্প কিছুদিনের মধ্যে স্কুলঘর পাঠদানের উপযোগী হয়ে উঠলে সেখানে পাঠদানের কার্য্যক্রম স্থানান্তর করা হয়।
অতঃপর সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের নীতিমালা অনুযায়ী স্কুলটি নিবন্ধনের আবেদন করলে অল্পদিনের মধ্যে নিবন্ধিত হয়ে যায়। অবশ্য এর পিছনে ছিল সুষ্ঠু তদারকি। পর্যায়ক্রমে শিক্ষানীতিমালার আওতায় ফ্যাসালিটিজ বিভাগ থেকে অনুদানের আওতায় স্কুল ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। যেহেতু খাঁড়ারা পুরাতনপাড়া ও নুতনপাড়া দুই পাড়ার মধ্যস্থলে স্কুলটির অবস্থান সেহেতু স্কুলটি খাঁড়ারা মধ্যপাড়া প্রথমিক বিদ্যালয় নামে ১৯৯১ সালে স্থাপিত হয়। চারজন শিক্ষক বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক সাহের সৃজনশীল চিন্তাচেতনায় ছাত্র ছাত্রী পাঠদানের পাশাপাশি নিবিড় তত্বাবধান ও পরিচর্যায় নান্দনিক শোভামণ্ডিত গৌরবোজ্জ্বল অবয়বে দাঁড়িয়ে আছে মানুষ গড়ার প্রাথমিক স্তরের এই বিদ্যাপীঠ।
পরবর্তীকালে সকল প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ এর আওতায় বিদ্যালয় টি জাতীয়করণ হয়ে যায়। বর্তমানে স্কুলটি "খাঁড়ারা মধ্যপাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়" নামে পরিচালিত হয়ে আসছ।
আলোকিত মানুষ গড়ার প্রথম স্তর এই প্রাথমিক বিদ্যালয়, যাঁর লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের অবকাঠামো দিক দিয়ে এত দ্রুত উন্নতি সাধন হয়েছে, এলাকার গর্ব শ্রদ্ধাভাজন সেই মহানুভব ব্যক্তি আজ আর আমাদের মাঝে নেই। এক সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর সংবাদে এলাকার সর্বস্তরের মানুষের মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া । তাঁর মরদেহ এলাকায় আনা হলে সর্বস্তরের জনগণ শ্রোদ্ধাভরে জানাযায় অংশগ্রহণ করেন এবং বিনম্র চিত্তে এলাকার কবরস্থানে সমাহিত করেন। সেই মহানুভব ব্যক্তিত্ব যাকে এলাকাবাশী গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে তিনি হলেন মরহুম মোছাদ্দেক আহাম্মেদ। এই গ্রামে ঐতিহ্যবাহী সরদার গোষ্ঠীর কৃতিসন্তান। এলাকার মানুষের কাছে তিনি বাবু নামে পরিচিত।
বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন প্রধান শিক্ষক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা যিনি পদাধিকার বলে স্কুুল পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সচিব। কোনো এক জাতীয় দিবসে ক্রীড়া অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমন্ত্রন জানালে উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। প্রধান শিক্ষক সাহের তাঁর সূচনা বক্তব্যে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে গ্রামবাসীর পক্ষ হয়ে এই স্কুলের স্বপ্নদ্রষ্টা মরহুম মোছাদ্দেক আহাম্মেদ(বাবু) সাহেবের বিদেহী আত্নার শান্তি কামনা করে আল্লাহ্ পাকের দরবারে দোয়া চেয়ে তাঁর বক্তব্য শুরু করেন। জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা সাহেবর কথার সাথে সুর মিলিয়ে বলতে হয় গ্রামের সর্বস্তরের মানুষ যেন এমন মহানুভব ব্যাক্তিকে স্মরণ রাখে এবং তাঁর বিদেহী আত্নার শান্তি কামনা করে আল্লাহ্পাকের দরবারে দোয়া প্রার্থনা করেন।
আসরের নামাজ মসজিদে আদায় করে বের হচ্ছি।
এমন সময় একজন বলে উঠলেন।
বড়ভাই চলেন উপর থেকে ঘুরে
আসি। কয়েক দিনেই উনার সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। বললাম উপর মানে বুঝতে পারলাম
নাতো।
তিনি বললেন
জি,কে ক্যানেলের উপর। মানে ৬ নং ব্রিজের উপর। সাদা ঘরের কাছে বেশ খোলামেলা জায়গা।
গোলবাথান রেলওয়ে স্টেশনের পাশে। অবশ্য এখন আর ঐ স্টেশনের কোনো নিদর্শন সেখানে নেই।
শুনেছি এক সময় ছিল তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। কালের বিবর্তনে প্রয়োজনিয়তা হারিয়ে সেই
গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে ইতিহাসের অতল তলে। চলেন ঐ ব্রিজের উপর উন্মুক্ত
বাতাসে বসে কিছুক্ষণ সময় কাটানো যাবে।
বললাম হ্যাঁ চলেন যাওয়া যাক। ইতিমধ্যে
হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার উপর এসে গেছি। উনাকে বললাম একটা ভ্যান আসুক।
উনি বললেন। না না ভ্যান
লাগবে না। এইতো এতটুকু পথ। আধা কিলোমিটারও হবে না। তাছাড়া বিকেলে একটু হাঁটাহাঁটি
করা ভালো। কি যে বলবো ভাই সাহেব, এই যান্ত্রিক যুগে এসে আমরা
একেবারেই হাঁটতে চাই না। আমাদের ছোটবেলার কথা বলছি। তখন আমরা মিরপুর হাইস্কুলে
পড়ি। তিন সাড়েতিন মাইল পথ হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে গেছি। আবার প্রতি
সপ্তাহে মিরপুর গোহাটে গরু ছাগল ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বেচা কেনা করতে সবাই পায়ে
হেঁটে যাতায়াত করেছে নির্দিধায়। অবশ্য এছাড়া কোনো উপায়ও ছিল না। তেমন কোনো
যানবাহনও ছিল না। ছিল না কোনো ভাল রাস্তা ঘাট। এই যে, যে কার্পেটিং করা রাস্তার উপর দিয়ে আমরা এখন হাঁটছি। মোটরসাইকেল, ভ্যান ছুটে চলছে আবার ঐ যে দেখছেন হুইল সু অর্থাৎ চাকাযুক্ত জুতা পরে ছেলেরা কিভাবে ছুটে বেড়াচ্ছে। তখকার দিনে কদার
মধ্যে পা পিঁছলে কত যে আছাড় খেয়েছি এই রাস্তার উপর। বর্ষাকাল জুড়ে এমন কাদা হতো
পায়ে হেঁটে চলাই দুঃষ্কর হয়ে পড়তো। পুরো বর্ষাকাল জুড়ে যাদের সাইকেল ছিল তারা
তাদের সাইকেল ঘরে তুলে রাখতে হয়েছে।
একদিনতো স্কুলে যাবার পথে
পিছলে পড়ে গিয়ে সমস্ত জামা কাপড় কাদায় ভরে গেল। বইগুলো ঝুলানো হাতব্যাগে ছিল।
বইগুলো কাদা থেকে বেঁচে গেল কোনরকমে। সেদিন আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। বাড়িতে ফিরে
কর্দমাক্ত পোষাক ছেড়ে পরিস্কার হয়ে অন্য পোষাক পরে স্কুলে যাওয়ার মত আর কোন পোষাক
ছিল না। তার উপর তিন সাড়েতিন মাইল পথ হেঁটে গিয়ে প্রথম পিরিওড
ধরা যাবে না। এ এই যে আমরা এসে গেছি।
বললাম ঐ যে আপনি বললেন সাদাঘর, সেটি কোথায় ?
উনি বললেন এই যে দেখছেন ছোট্টো ঘর একেই বলে সাদাঘর, কোনো কোনো বয়স্ক মহিলারা ধলাঘরও বলে থাকে আবার চুনঘরও বলে কেউ কেউ। আসলে এটা সাদাঘরও নয়, ধলাঘরও নয়, চুনঘরও নয়। আদতে এটি হচ্ছে একটি সেডঘর। সাদা চুনকাম করা ছিল তাই সাদাঘর বা চুনঘর বলে থাকে সবাই।
কথা বলতে বলতে আমরা ব্রিজের উপর উঠে গেছি। তিনি বলতে থাকেন যখন এই ক্যানেল খনন করা হয় তখন নুতন অবস্থায় ক্যানেলের রক্ষণাবেক্ষণকারী হিসাবে বেলদার নিয়োগ করা ছিল। তারা টহল দিয়ে ক্যানেলের কোথায় কি অবস্থা দেখতো। বেলদারদের থাকার জন্য এই সেডঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। যাতেকরে ক্যানেলের তদারকিতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে। চলতি পথে ক্লান্ত পথিকও অনেকসময় এখানে বসে একটু জিরিয়ে নিত। কালের বিবর্তনে আজ তার প্রয়োজনিয়তা হারিয়ে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর আশেপাশে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু দোকানপাট। এই সাদাঘর ঘিরে কিছু কথা বলতে হয়। পাকিস্তান আমলে মিলেটারী এসে ক্যাম্প করে সাদাঘরের উপরে এবং আশেপাশে বিভিন্ন ধরণের মেশিনপত্র সেট করে তারা কি যে করতো তারাই জানতো।
তিনি বলতে থাকেন আর আমি আগ্রহভরে শুনতে থাকি। কারো অতিতের স্মৃতিচারণের গল্প কেউ যদি আগ্রহভরে শুনে তাহলে তার স্মৃতিময় গল্পটা বলতে বেশ ভাল লাগে। আগ্রহভরে উনার কথা গুলি আমি শুনছি আর উনিও সাবলিল ভঙ্গিতে স্বাচ্ছন্দ্য ভাবে বলে যাচ্ছেন তার স্মৃতিময় ঘটনাবলি।
ব্রিজের উপর বসে বেশ ভালো লাগছে। আরও অনেকে বসে একে অপরের সাথে আলাপচারিতার মধ্যদিয়ে সময় কাটাচ্ছে পড়ন্ত বিকেলে। বিস্তির্ণ ফাঁকা মাঠে আমন ধানের রোপণকৃত সবুজ চারাগুলোর কচি ডগা দখিনা হাওয়ায় ঢেউ খেলে যাচ্ছে। দুরথেকে মনে হচ্ছে সারা মাঠজুড়ে যেন সবুজ কার্পেট বিছানো। শরতের শান্তপ্রকৃতি চারিদিকে সবুজের সমারহ উপভোগ করছে সবাই বসে। আমরাও সামিল হলাম ব্রিজের রেলিং এর উপর বসে। শুভ্রতার প্রতীক শরতের খণ্ড খণ্ড শুভ্র মেঘমালার ছুটে চলা দৃশ্য দেখে প্রাণটা ভরে উঠলো। আরও কিছুক্ষণ বসতে পারলে বেশ ভলো লগতো। কিন্তু আর বেশিক্ষণ ধরে বসে থাকা যাবে না। একটু পরেই মাগরীবের আযান হবে। পশ্চিম আকাশে সূর্যটা গোল একটা লাল বলের আকার ধারণ করেছে। সেই লাল আলো শরতের শুভ্র মেঘের উপর পড়ে এক মনোরম দৃশ্যের সৃষ্টি করেছে। যেন নিপুণ কোনো এক শিল্পীর রং তুলিতে আঁকা এক চিত্রকর্ম। একটু পরেই দিগন্তপাটে বসে যাবে লাল গোলাকৃতি সূর্যটা। বললাম চলেন ভাই এবার উঠা যাক।
উনি বললেন হ্যাঁ চলেন। হাঁটতে হাঁটতে কিছু কথা হবে। কেমন লাগছে ভাই আমাদের গ্রামটা?
বললাম বেশ ভাল। এতগুলো
গোষ্ঠি বা গোত্র যাই বলি না কেন আপনারা যে একে অপরে মিলেমিশে এক সৌহার্দপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্যদিয়ে বেশ সুখেই বসবাস করে আসছেন সত্যিই
প্রশংশনীয়। ইচ্ছে হয় এই গ্রামে থেকে যাই। কিন্তু তাতো সম্ভব নয়, যেখান থেকে এসেছি সেখানেতো ফিরে যেতেই হবে। সব ইচ্ছা কি আর পূরণ হয়? যদিও ইচ্ছা হলো সকল কাজের প্রথম শর্ত। তাইবলে কি সকল কাজ সাফল্যের মুখ দেখে? অনেক যত্ন সহকারে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে কৃষক ফসল ফলালো।
কিন্তু প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগপূর্ণ পরিস্হিতিতে ফসল ঘরে তোলার আগমুহুর্তে সমস্ত
ফসল নষ্ট হয়ে গেল। কৃষকেরতো ইচ্ছা ছিল ফসলগুলো ঘরে তুলতে।
তিন বলেন হ্যাঁ ভাই, বর্তমানে আমরা বেশ সহাবস্থানের মধ্যদিয়ে বসবাস করছি তার যেমন প্রশংশনীয় দিক
আছে। তেমনি অতিত তিক্ততার ইতিহাস যে একেবারে নেই তা নির্দিধায় বলা যাবে না।
কর্ত্রীত্বের লড়াই হউক, অস্তিত্বের লড়াই হউক, স্বার্থের লড়াই হউক আর জীবন ধারনের লড়াই হউক সেই আদিকাল থেকে যুগ যুগ ধরে চলে
আসছে। আর এ লড়াই ব্যক্তি জীবন, পারিবারীক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন প্রতিটি
ক্ষেত্রে বিরাজমান। চলমান এই প্রতিদ্বন্দিতামূলক লড়াই এর বলয় থেকে এই গ্রাম নিরপেক্ষ থাকবে কী করে। কোনো একটা তুচ্ছ ঘটনাকে
কেন্দ্রকরে দাঙ্গাবাজী বা তিক্ততার সৃষ্টি যে এই গ্রামে হয়নি তা নয়। সেদিকে আলোকপাত না করাই ভাল। কথায় আছে
ময়লা ঘাঁটলে কেবল দুর্গন্ধই ছড়ায়। আর ক্ষতস্থানে যত নাড়াচাড়া করা যায় ক্ষতস্থানের সংক্রমন ততই বেড়ে যায়। বৃহৎ কোনো কল্যানকর কাজে অতিতের তিক্ততা ভুলে যাওয়াটাই
মহানুভবতার পরিচয় বহণ করে। বেশকয়েক দিন হলো আপনাকে দেখছি, আপনি চাঁদ ভাই এর বন্ধু। ইতিমধ্যে হয়তো জেনে গেছেন
এই খাঁড়ারা নুতন পাড়ায় কয়েকটি গোষ্ঠির বসবাস। যেমন সরদার, মোল্লা, মণ্ডল, মালিথা, শেখ, বিশ্বাস, প্রামানিক সবাই অতিতের
তিক্ততা ভুলে সকলের প্রচেষ্টায় এই গ্রামে মানুষ গড়ার প্রাথমিক স্তর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করে এক মহানুভতার দৃষ্টান্ত
স্থাপন করেছে। তার পরেও বলতে হয় যেখানে আলো সেখানে ছায়াতো থাকবেই। ছায়াকে তো আপনি
এড়িয়ে চলতে পারবেন না। যুগ যুগ ধরে একটা কথা প্রচলিত হয়ে আসছে প্রদীপের নিচেই
অন্ধকার।
বললাম হ্যাঁ আপনার কথায় বেশ যুক্তি আছে। আলোর বিপরীতেইতো ছায়ার অবস্থান। অতিত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে হবে। অতিতের ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করতে হবে আর যেগুলো নেতিবাচক সেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তা বর্জন করতে হবে অর্থাৎ নেতিবাচক দিকগুলো ভুলে গিয়ে সামনের দিকে এগুতে হবে। এরই মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মসজিদের কাছে এসে গেছি। মুয়াজ্জিন সাহেব আযান দিতে শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে আমরাও অযুখানাতে অযু করে নামাজ আদায় করতে মসজিদে প্রবেশ করি।
ড্রইংরুম আবার বেডরুমও বলা যায়। একপাশে একটি খাট আর সোফাসেট এবং এক কর্ণারে রয়েছে একটি বুকসেল্ফ পাশে একটি ড্রেসিংটেবিল বেশ পরিপাটি করে সাজানো রুমটি। বুকসেল্ফে সাজানো বেশ নামি দামি লেখকের বই। এ্যাটাস্ট বাথরুম। আমার বন্ধুর বাড়ি। যে বাড়িতে আমি বেড়াতে এসেছি। গ্রামের বাড়ি হলেও বেশ সুন্দর রুচিসন্মত পরিবেশ বান্ধব বাড়িটি। সব মিলিয়ে একটা ঐতিহ্যের ছাপ রয়েছে পুরো বাড়িটিকে ঘিরে। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, নারিকেল, সারিবদ্ধ সুপারি গাছ বেষ্টিত কোলাহলমুক্ত মনোরম এক শান্ত পরিবেশ। সাঁঝ লাগতে না লাগতেই ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক যেন এক আলাদা আমেজ সৃষ্টি করে তোলে। এশার নামাজ আদায় করে খাওয়া-দাওয়া সেরে ভাবলাম একটা বই পড়ি। বুকসেল্ফে অনেক গুলি বই এর মধ্যে নজর পড়লো একটি বই এর প্রতি "দেনমোহর" লেখক আসমান আলী। দেনমোহর মুসলিম সমাজে অতি পরিচিত একটি শব্দ। ইসলামী বৈবাহিক সম্পর্কিত একটি শব্দ। গুরুত্বের দিক দিয়ে শব্দটির রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ বিশেষ ভুমিকা। এই দেনমোহর নামক আর সি সি পিলারের মজবুত ভিত্তির উপর গড়ে উঠে এক একটি সংসার নামক বহুতল ভবন। আবার অন্যভাবে বলতে গেলে দেনমোহর নামক ভেলায় চড়ে আমরা এই সংসার সমুদ্র পাড়ি দিয়ে চলেছি। কৌতুহল জাগলো বইখানা পড়ে দেখি। বইখানা নিয়ে পড়তে থাকি। এমন সময় আমার বন্ধু এসে বলে। কিরে দোস্ত কী করিস?
আমি বল্লাম, এইতো বসে আছি। একটা বই পড়ছি। জানিস দোস্ত, গল্পকার অতি নিখুঁত ভাবে সামাজিক চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন এই দেনমোহর বইটিতে। অতঃপর দুই বন্ধু বসে গল্প করতে থাকি। বেশ কিছুদিন হলো এসেছি। এবার যে, যেতে হবে দোস্ত।
বন্ধু বলে উঠলো। আরে যাবিক্ষণ। এইতো সবে এলি আর এরই মধ্যে যাওয়া যাওয়া শুরু করলি। তোর সাথে তো তেমন কথায় হলো না। আমিও ঠিকমত সময় দিতে পারছি না। ডাক্তারের কাছে ছুটাছুটি করে। তুইও তোর মত করে ঘুরছিস। এরই মধ্যে এলাকায় বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিস। আচ্ছা, তোর সাথে কতদিন দেখা হয়নি বলতো?
বল্লাম এই ধর প্রায় দশ/এগার বছর হবে। তুই অবসর নিয়ে বাড়িতে চলে আসলি, আর তার দুই মাস পর আমিও অবসর নিয়ে বাড়িতে চলে যাই। এরপর থেকে তো আর দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। যদিও ফোনে প্রতিনিয়ত কথা হয়েছে।
বন্ধু বলে উঠলো, দোস্ত আগামীকাল ফজর নামাজের পর তোকে একখানে নিয়ে যাবো। যেখানে রয়েছে আমার ছোট্ট বেলার দুু'টি অবিস্মরণীয় ঘটনা। সেখানেই হতে পারতো আমার জীবনাবসান। আল্লাহ্পাকের কি অশেষ রহমত, দু'টি সঙ্কটাবস্থা থেকে অলৌকিক ভাবে জীবন ফিরে পেয়েছি আমি। আজ কদিন ধরে ভাবছি আমার জীবনের অবিস্মরণীয় গল্পটা তোকে শুনাবো। হ্যাঁ গল্পইতো, অতিতের কোনো ঘটনা কাউকে শুনালে তাকে তো গল্পই বলা হয়ে থাকে তাই না? হুটকরে এলি আবার কখন হুট করে চলে যাবি। কবি সাহিত্যকদের তো আবার এক যায়গায় বেশিদিন থাকতে ভাল লাগে না। তারা খুঁজে বেড়ায় তাদের লেখার উৎস কোথায় পাবে। আমি একটা বিষয় ভেবে দেখেছি কবি সাহিত্যক গবেষকদের কিসের সঙ্গে তুলনা করা যায় বলতে পারিস ?
আমি ভাবতে থাকি, কিসের সঙ্গে... কিসের সঙ্গে.... না বলতে পারলাম না?
বন্ধু বলে, বলতে পারলি না তাইতো? তবে শোন, মৌমছির সঙ্গে।
আমি বল্লাম, মৌমাছির সঙ্গে? তার মানে?
বন্ধু বলে, বুঝলি না? মৌমাছি প্রথমে স্থান নির্বাচন করে মৌচাক তৈরী করে। তারপর ঘুরে ঘুরে মুখে করে ফুল থেকে বিন্দু বিন্দু মধুরস সংগ্রহ করে মধুকোষে জমা করে। তারপর বাচ্চা ফোটানো শেষে তৈরীকৃত শুন্য মৌচাক ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে আবার বাসা বাঁধে। মৌমাছির মত কবি সাহিত্যকরাও তো ঘুরে ঘুরে সাহিত্যের উৎস থেকে বিন্দু বিন্দু সাহিত্যরস সংগ্রহ করে কলমের মুখ দিয়ে বই নামক মৌচাকের মৌকোষে সংরক্ষণ করে থাকে। তারপর আবার অন্য কোন উৎসের খোঁজে বের হয়। কি ঠিক বলেছি?
আমি বল্লাম, আরে দোস্ত এভাবেতো কখনও ভাবিনি। তুই কী ভাবে.....।
বন্ধু আবার বলে, শুধু তাই নয়। আর একটু ভেবে দেখ, মৌচাকের মধু কিন্তু সকলেই ভাঙতে বা সংগ্রহ করতে পারে না। এর জন্য সমাজে বিশেষ পেশার লোক থাকে। তেমনি বই নামক মৌচাকের সাহিত্যকোষে সংরক্ষীত সাহিত্যরস বা সাহিত্যমধু সবাই আহরণ করতে পারে না। এর জন্য সমাজে বিশেষ সাহিত্যানুরাগী লোক থাকে।
আমি বল্লাম, আরে দোস্ত তুই এতদুর ভাবিস? আমি যে একেবারে অবাক হয়ে যাচ্ছি।
বন্ধু বলে, আরে এতে ভাবাভাবি বা অবাক হওয়ার কিছুই নেই। যেটা বাস্তব সেটাইতো বল্লাম। নাকি? হ্যাঁ রাত দশটা বেজে গেল, নে ঘুমিয়ে পড় দোস্ত। সকালে দেখা হবে ইনশাআল্লা। বলেই সে নিজের রুমে চলে গেল।
আমি বসে ওর গমন পথের দিকে চেয়ে অবাক দৃষ্টিতে ভাবতে থাকি। বলেতো গেল ভাবাভাবির কিছুই নেই। আরো বলে গেল ঘুমুতে। কিন্তু কি করে ঘুমুবো! ওর জীবনে কি এমন ঘটেছিল তা না জানা পর্যন্ত চোখে ঘুম আসবে কী করে। অপর দিকে যে কথা শুনিয়ে গেল, সাহিত্যাঙ্গনে যতটুকু বিচরণ করেছি এমনি করেতো কখনও ভাবিনি! তার উপর আবার সুখের সন্ধানে গল্পটার সমাপ্তি টানতে হবে। সুখের সন্ধানে কতখানেই না গেলাম...! যা হউক ভাবতে ভাবতে এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, ফজরের আজান কানে আসতেই আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসলাম। অযু করে নামাজ আদায় শেষে বন্ধুর অপেক্ষায় বসে আছি। এর মধ্যে সে এসে বলে হ্যাঁ দোস্ত চল এবার যাওয়া যাক।
বের হলাম বন্ধুর সেই অবিস্মরণীয় ঘটনাস্থলের উদ্দ্যেশে। দু'জন পাশাপাশি হেঁটে চলছি। চাষিক্লাব সংলগ্ন ব্রিজের উপর উঠে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বলে, এই যে এইখানে ঘটেছিল লোমহর্ষক সেই ঘটনাটি। অবশ্য এখন আর সেই আগের ব্রিজটি নেই। সেই ব্রিজ ভেঙে নান্দনিক এই ব্রিজ পুঃন নির্মান করা হয়েছে। হ্যাঁ, গল্পটা বাড়িতেই তোকে শুনাতে পারতাম। প্রশ্ন করতে পারিস। কেন বাড়িতে বসে শুনালাম না?
বললাম, হ্যাঁ বাড়িতে বসেই বলতে পারতিস। এখানে আসার বিশেষত্ব কী?
বন্ধু বলে, বিশেষত্ব হচ্ছে ঘটনা যেখানে সংঘটিত হয় সেখানে গেলে মনের অনুভুতিটা জাগ্রত হয়। দৃশ্যপটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। একটু ভেবে দেখ। মসজিদে নামাজ আদায় করে যে তৃপ্তি পাওয়া যাবে। বাড়িতে নামাজ আদায় করে কী সেই তৃপ্তি পাওয়া যাবে? ঈদের নামাজ ঈদের মাঠে আদায় না করলে ঈদের আনন্দ কী পাওয়া যায়? মৃতব্যাক্তির উদ্দ্যেশে যে কোনো স্থান থেকে দোয়া করলে সেই দোয়া তার কাছে পৌছে যায়। তবে কবরস্থান যেখানে আমাদের অতি প্রীয় আপনজন চিরনিদ্রায় শায়ীত সেখানে গিয়ে দোয়া করলে অন্তরে যে দ্বীনি অনুভুতি আর পরকালের ভাবনা জাগ্রত হয়, অন্যকোন স্থান থেকে দোয়া করলে তেমন অনুভুতি কী জাগ্রত হয়? হয় না।
বল্লাম, না তাই কী আর হয়। এখন বল শুনি কী এমন ঘটেছিল যে, ঘটনাস্থলে নিয়ে এলি।
বন্ধু বলে, তখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি। সেই ষাটের দশকের কথা। পরীক্ষার আর অল্প কিছু দিন বাকি। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ভোরে আযানের সময় উঠে পড়াশেষে একটু ফর্সা হতেই ভাবলাম হেঁটে আসি। হাঁটতে হাঁটতে ব্রিজের উপর এসে ঠিক এইখানে দাঁড়িয়ে আছি। কার্তিক মাসের শেষের দিকে হবে। সকালের দিকে একটু ঠাণ্ডা থাকায় গায়ে চাদর জড়িয়ে মুক্ত হাওয়ায় দাঁড়িয়ে বেশ ভাল লাগছে। ব্রিজের উপর আরও অনেকে আছে। তারা একে অপরের সাথে আলাপচারিতায় মগ্ন। আমার মত আমি একা ব্রিজের এক মাথায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি পশ্চিম দিক থেকে সোজা রাস্তা ধরে একটি শেয়াল হেঁটে আসছে। শেয়াল দেখলে মনে এক কৌতুহল জাগে আয় তু বলে কুকুরকে ডাক দিয়ে থাকে প্রায় সবাই। বিশেষ করে ছেলেপেলেদের মধ্যে এই প্রবনতা বেশি কাজ করে। আমিও তাই করলাম। ব্রিজ থেকে নেমে শেয়ালের দিকে একটু এগিয়ে যেই বলেছি আই তুু। অমনি ক্ষীপ্রগতিতে আমার দিকে ছুটে আসলো শেয়ালটি। আমি দৌড়ে গিয়ে ব্রিজের উপর উঠতেই শেয়াল আমাকে ধরে ফেললো। আমি ব্রিজের রেলিং ধরে গায়ের চাদর পা পর্যন্ত নামিয়ে দিলাম। আর বাঁ হাতে রেলিং টা শক্তকরে ধরে ডান পা দিয়ে লাথি মেরে শেয়ালটাকে সরাতে থাকি। সরে গিয়ে আবার হা করে ছুটে কামড় দিতে আসে, আর আমি লাথি মেরে সরাতে থাকি। যেহেতু আমার হাতে কিছু নেই। এরমধ্যে চাদর গা থেকে পড়ে গেছে। একটা বুদ্ধি মাথায় কাজ করছে আমি রেলিং ছাড়ছি না। রেলিং ছাড়লেই পড়ে যাবো। আর দৌড় দেওয়ার তো কোনো সুুযোগ নেই। আমাকেতো শেয়ালটা ধরেই ফেলেছে।
বল্লাম, ব্রিজের উপর আর লোকগুলো কী করছিল? তারাতো কিছু নিয়ে এগিয়ে আসতে পারতো।
বন্ধু বলে, তারা যে কে কোথায় দেখার সুযোগ কোথায় আমার। আমিতো লাথির উপর লাথি মরে শেয়ালের
সাথে লড়াই করে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে শেয়াল কাবু হয়ে পড়ে। শেষের এক লাথি খেয়ে ব্রিজের
উপর পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারে না। কুকুর যেমন ঘাড় বাড়িয়ে শুয়ে থাকে ঠিক তেমনি ভাবে
পড়ে আছে। আমি তখন রেলিং ছেড়ে শেয়ালের ঘাড়ে এক
পা আর পিঠের উপর এক পা দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। সঙ্গে সঙ্গে আমার এক চাচা, তাঁর হাতে ছিল কাঁসার বদনা। তিনি এসে, পড়ে থাকা শেয়াল যার উপর আমি
দাঁড়িয়ে আছি সেই শেয়ালটির মাথায় কাঁসার বদনা দিয়ে মেরে মাথা মুখ থেঁতলিয়ে ভরাট
গলায় বলেন, এবার নামো মেরে ফেলেছি।
কথাটা শুনে আমার হাসি পেল।
না হেসে থাকতে পারলাম না। হাঃ হাঃ হাঃ।
বন্ধু বলে, কিরে হাসছিস যে। হাসার মত কিছু বলেছি? না বানিয়ে বানিয়ে এতক্ষণ তোকে আষাঢ়ে গল্প শুনাচ্ছি? আরে এটি ছিল আমার জীবন মরণ লড়াই।
বল্লাম, আরে না না সে জন্য হাসছি না। তুই যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিস তাতে তুই অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। হাসি পাচ্ছে এই জন্য যে তুই যখন শেয়ালের সাথে লড়াই করছিস তখন তাদের কি ভুমিকা ছিল? যখন শেয়াল তোর লাথি খেয়ে খেয়ে মরার মত পড়ে আছে তখন তোর চাচা এসে বদনা দিয়ে মেরে বীরত্বের সাথে বলে এবার নামো মেরে ফেলেছি।
বন্ধু বলে, না না তাঁর দিক থেকে তিনি ঠিকই করেছেন। ঘটনাটা তো মুহুর্তে ঘটে গেল। সবাইতো দৃশ্যটা দেখে হতবাক। তাদের হাতেওতো কিছু ছিল না ঐ মুহুর্তে। তখনও সূর্য পুরোপুরি উদ্ভাসিত হয়ে চারিদিকে আলো ছড়ায়নি। তাছাড়া জীবনের মায়াতো সবারই আছে। আর ঐ সময় এসে যদি তিনি না মারতেন শেয়ালটা তার দুর্বলতা কাটিয়ে আবার যদি আমাকে আক্রমন করতো? তখন আমি কী করতাম?
আর সাহসিকতার কথা বল্লি না? আরে এখানে সাহসের কিছুই নেই। পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছি। এতে সাহসের কিছু নেই। কথায় আছে পরিস্থিতিই পরিনত করে তোলে। আর এ ছাড়াতো আমার কোনো উপায় ছিল না আগাগোড়ায় আমার ভয়টা একটু বেশি। বিশেষ করে ভুতের ভয়। রাতে একা একা আমি বেরুতে পারি না আজও। থাক সে কথা।
আর একটি ঘটনাও ঘটেছিল এই ক্যানেলের ঠিক এইখানে, সেটি আরো ভয়ঙ্কর ভাবতেই গা শিউরে উঠে। তখন এখানে কোনো ব্রিজ ছিল না। বর্ষাকালে মানুষ কলার মাড় যাকে ভেলা বলে সেই মাড়ে করে পারাপার হতো। আমি তখন খুবই ছোট ক্লাস থ্রি কিংবা ফোরে পড়ি। বাড়াদি প্রাইমারী স্কুলে পড়তে যেতাম কয়েকজন মিলে। কলার মাড়ে এই ক্যানেল পার হয়ে স্কুলে যতে হতো বর্ষাকালে। আর তখনকার দিনে প্রাইমারী স্কুলের যা অবস্থা ছিল। চারচালা কানেস্তা টিনের ছাওনি, আর বেড়া বলতে কিছু ছিল না। একদিনের একটা ঘটনা মনে হলে এখনও নিজেকে বোকা ভাবি। স্কুল থেকে আসছি রাস্তায় একজন জিঙ্গেস করলেন। এই যে বাবু শোনো, আগামীকাল তোমাদের স্কুল খোলা থাকবে? আমি বল্লাম আমদের স্কুলতো কখনই বন্ধ হয় না। স্কুল সব সময় খোলাই থাকে। স্কুলের বেড়ায়ইতো নাই। উনি বল্লেন আহা আমি বলছি আগামীকাল কী তোমাদের ছুটি থাকবে? বলেছিলাম না ছুটি থাকবে না।
এই দেখ এসব কথা তোকে শুনানো মানে মা এর কাছে মামার বাড়ির গল্প শুনানোর মতই হবে। তুইওতো একজন কালের স্বাক্ষী। অবশ্য তোদের শহরের স্কুুলের কথা ভিন্ন। মাস্টারদের মধ্যে সবার নাম মনে নেই তবে একজন মাস্টারের নাম আজো মনে আছে জনাব ইদ্রস আলী মাস্টার তিনি আবার বুদি মাস্টার নামে এলাকায় বিশেষ পরিচিত ছিলেন। বাবা-মা'র পরেই উনাদের কাছে আমার প্রথম হাতে খড়ি।অন্যান্য মাস্টারদের নাম যদিও মনে নেই তাঁদের বিদেহী আত্নার শান্তি কামনা করে তাঁদের সকলকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। মহান আল্লাহ্পাক তাঁদেরকে জান্নত নসিব করেন।
হ্যাঁ এখন মূল প্রসঙ্গে আসি যার জন্য তোকে এখানে আনা। সেদিন সকালের দিকে মুশুলধারে বৃষ্টি হয়ে গেল। চারিদিকে পানি থৈথৈ করছে। এই ক্যানেল পানিতে ভরে গেছে। প্রবল শ্রোতে ঋষিপাড়ার দোহা থেকে ভেসে আসা কচুরি পানা ছুটে চলছে। অনেকে খ্যাপলাজাল বা ঝাঁকিজাল দিয়ে মাছ ধরছে। আমরা সমবয়সী কয়েকজন মিলে এই যে,এইখানে ক্যানেলের কিনারের পানিতে নেমে ঝাঁপাঝাঁপি করছি আর একে অপরের গায়ে পানি ছিটাছেটি খেলছি। যা ছোট্টো বেলার কৌতুহী চারিত্রীক বৈশিষ্ঠ্য। নুতন পানি পেয়ে ব্যাঙেরা লাফালাফি করে যেমন আনন্দ পায় ঠিক তেমন। আমাদের মধ্যে থেকে একজন আমাকে ধরে বলে এই তুইতো সাঁতার জানিস না ঐ পানা ধর সাঁতার শিখে যাবি। বোকার মত আমি যেই পানা ধরতে গেছি অমনি শ্রোতে আমাকে টেনে নিয়ে গেল। আমি তখন পানিতে একবার ভেসে উঠি আবার ডুবে যাই।এই ভাবে ভেসে যেতে থাকি। এক পর্যায় আর ভেসে উঠতে পারছি না। একেবারে ডুবে যাচ্ছি। আর ভেসে উঠার শক্তি নেই। সেখানে একজন (মতলেব ভাই) খ্যাপলাজাল বা ঝাঁকিজাল দিয়ে মাছ ধরতে ছিলেন। তিনি হাত থেকে জালের ডুরি ছেড়ে দিয়ে প্রায় ডুবন্ত অবস্থা থেকে আমাকে উদ্ধার করেন। তাঁর বিদেহী আত্নাঁর শান্তি কামনা করে তাঁকে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। আল্লাহ্পাক যেন তাঁকে জান্নাত নসিব করেন। মহান রাব্বুল আল্আমিনের অশেষ রহমতে নিশ্চিত মৃত্যুুর দুয়ার থকে সেদিন অলৌকিক ভাবে আমি ফিরে আসি। এখানে আসলেই আমি ফিরে যাই আমার অতিতের সেই ছোট্ট বেলায়। আর সেই জন্যই তোকে এখানে আনা।
বল্লাম, হ্যাঁরে দোস্ত তোর জীবনে ঘটে যাওয়া সংকটানাপন্ন দু'টি ঘটনা সত্যিই মর্মান্তিক ও বেদনাদয়ক। আল্লাহ্পাকের অশেষ রহমত ছাড়া এই অবস্থা থেকে কেউ ফিরে আসতে পারে না। তাইতো বলে, "রাখে আল্লাহ্ মারে কে"।
গ্রামের কেন্দ্রস্থিত একটি জামে মসজিদ। একজন মুরুব্বি, সামাজিক ও ধর্মীয় অনুরাগী অত্যান্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তিনি মসজিদ কমিটির সভাপতি। একদিনেই যতদুর জেনেছি তিনি গ্রামের সকলের কাছেই সন্মানিত ব্যাক্তি। গ্রামের বিভিন্ন উন্নয়ন মুলক সামাজিক ও ধর্মীয় কাজে রয়েছে তাঁর বিশেষ ভুমিকা। সর্বজন শ্রদ্ধেয় এমন একজন মানুষের নাম প্রসঙ্গ ক্ষেত্রে উল্লেখ না করলে অতৃপ্তি থেকে যায়। তিনি হলেন জনাব মোঃ আবু বক্কর সরদার। তাঁকে সবাই মেম্বর সাহেব বলে ডেকে থাকে। তাঁর সাথে কোনো একসময় একান্তে বসে কথা প্রসঙ্গে জেনেছি তনি একসময় ইউ পি মেম্বার ছিলেন তাঁকে চাচা বলে সন্মোধন করি। বয়সের ভারে চলায় বলায় কিছুটা অসংলগ্নতা পরিলক্ষীত হলেও তাঁর কাছে জানতে চাইলাম মসজিদের বয়স কত হতে পারে?
তিনি যা বললেন, আমিও সঠিক বলতে পারব না। আমার বয়স বর্তমানে ৮২/৮৩ বছর হবে। আমিও বংশপরম্পরায় শুনে আসছি এই মসজিদের জন্য যিনি জমি দান করেছেন তিনি হলেন মরহুম আকবর আলী মণ্ডল, আকবর ড্রাইভার নমেই তিনি বেশি পরিচত। বৃটিশ আমলে রেলের ড্রাইভার ছিলেন তিনি। আবার এটাও শুনেছি ১৯১২ সালে যখন হার্ডিঞ্জ ব্রিজ চালু হয় তখন পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথম ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন চালানোর সময় তিনি ঐ ট্রেনের ফায়ারম্যন ছিলেন। সেই হিসাবে আনুমানিক একটা হিসাব করলে প্রায় একশো বছরের বেশি হবে।
একজন কোরআনে হাফেজ ইমাম সাহেবের ইমামতিতে প্রতি ওয়াক্তিয় নামাজ আদায় করে থাকেন মুসুল্লিগণ। জুম্মার নামাজেও তিনি ইমামতি করে থাকেন। মসজিদটি বেশ খোলা মেলা স্থানে অবস্থিত। মসজিদটির মনোরম দিক হলো। মুসুল্লিদের জন্য অজুখানা। এরই মধ্যে এই গ্রামের একজন বয়স্ক মুসল্লির সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে আমার। তাঁর কাছে জানতে চাইলাম এতো সুন্দর অযুখানার ডিজাইন কে করেছে?
তিনি যা বল্লেন - - এই অযুখানার সাদৃশ্য এতদঅঞ্চলে বিরল। যা এই নূতনপাড়ার ঐতিহ্যবাহি সরদার গোষ্ঠীর এক মহানুভব কৃতিসন্তানের দেওয়া নকশা ও তাঁর একক অনুদানে নির্মিত এই অয়ুখানা। সেই সাথে বাউণ্ডারী ওয়ালও করে দিয়েছেন তিনি। মুসুল্লিদের এবাদতে যাতে কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে মসজিদে এ সি স্হাপন করে দিয়েছেন তিনি।
এমন দানশীল মহানুভব
ব্যক্তি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সেই মহানুভব ব্যক্তির নাম জানতে চাইলাম।
তিনি বলেন, দেখুন ছেলেটি প্রচার বিমুখ। অযুখানায় সৌজন্য ফলক পর্যন্ত সে লাগায় নাই। কাজই
আত্নতৃপ্তির একমাত্র মাধ্যম। সষ্ঠু সুন্দর সফল কাজই দিতে পারে আত্নার প্রশান্তি।
তবে আপনি এই গ্রামের মেহমান আপনি যখন জানতে চাইলেন তাই বলছি। গ্রমের মানুষের কাছে
তথা এলাকায় ছেলেটি খোকন নামেই বেশি পরিচিত। তিনি এই গ্রামের ঐতিহ্যবাহী সরদার
গোষ্ঠীর একজন কৃতিসন্তান, গ্রামে না থাকলেও গ্রামের
মানুষের সাথে তার রয়েছ নিবিড় সম্পর্ক।
মসজিদের ইমাম সাহেব বাস্তবতা ও ইসলামিক জ্ঞান রাখেন অসাধারণ। আসর নামাজ শেষে মাগরীবের আগপর্যন্ত ছোট ছোট ছলে মেয়েদের কোরআন শিক্ষা দিয়ে থাকেন। আবার মাগরীবের পর থেকে এশার নামাজের পূর্ব পর্যন্ত বয়ষ্ক মানুষদের কোরআন শিক্ষা দিয়ে থাকেন ও কোরআন হাদিসের আলোকে আলোচনা করে থাকেন। তিনি একজন সদালাপী মিষ্টভাষী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। বয়সে ছোট হলেও তাঁর সাথে বেশ সখ্যতা গড়ে উঠেছে। একদিনেই তাঁর সাথে স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি। সময় সময় আসর নামাজের পর আবার কখনো মাগরীব নামাজের পর এশার আগ পর্যন্ত তাঁর সাথে বসে ইসলামী বিষয়ভিত্তিক কিছু আলোচনা হয়। ইমাম সাহেব এক জুম্মার নামাজে খুৎবার পূর্বে সংক্ষিপ্ত বয়ানে দু'টি বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে কোরআন হাদিস ও বাস্তবতার আলোকে যেভাবে উপস্থাপন করলেন সেই ভাবে হয়তো আমি উপস্থাপন করতে পারব না। তবুুও চেষ্টা করছি কিছুটা আলোকপাত করতে।
কোরআন হাদিসের আলোকে ইমাম সাহেব দুইটি বিষয়ের উপর বক্তব্য রাখেন। একটি বিষয় হচ্ছে নাম বা পরিচিতি। এই নামটা কী এবং কেনো? তিনি বলেন নামের সাহয্যে আমরা কোনো কিছু সম্পর্কে পরিচিতি হয়ে চিনতে বা জানতে পারি। নামের সাহয্যে আমরা একে অপরকে চিনে থাকি। নামের গুণবাচক দিক দিয়ে আমরা ভাল মন্দ পৃথক করে থাকি। মহান আল্লাহ্পাক রাব্বুল আল্আমিন ভালবেসে একটা জাতি সৃষ্টি করে তার একটি সুন্দর নাম দিলেন ইনসান যার অর্থ মানবজাতি। আবার মানুষকে চেনার জন্য নাম পদবি ও গুণকাচক নামের সাহায্যে ভাল মন্দ পৃথক করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এই যে আমি আমার কথায়ই বলবো অন্য কারো কথা বলে কাউকে খাটো করবো না। বাবা মা আমার নাম রেখেছেন ফয়সাল। মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি তাই নামের সাথে মোহম্মদ যুক্ত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোন ফয়সাল? তখন আমার বংশ বা গোষ্ঠির পদবী জোয়ার্দার এসে আমার নামের সাথে যুক্ত হলো। তার পরে আমার যা অর্জন গুণবাচক দিক গুলো আমার নামের সাথে যুক্ত হলো। যেমন আমি একজন কোরআনে হাফেজ তাই আমার নামের সাথে হাফেজ যুক্ত হয়ে এখন পুরো নাম দাঁড়ালো হাফেজ মোঃ ফয়সাল জোয়ার্দার। সর্বপরি আমি আপনাদের এই মহল্লার মসজিদের ইমাম। এখন একটা বিষয় লক্ষ্য করুন আমার নামের চারটি অংশের মধ্যে তিনটি অংশই জন্মগতসূত্রে পারিবারিক ভাবে পাওয়া একটি মাত্র আমার নিজের অর্জন। তাহলো হাফেজ। আবার দেখেন একজন ডাক্তার, একজন এ্যাডভোকেট, একজন ইন্জিনিয়ার, একজন হাজি সাহেব এগুলো তাদের নিজস্ব অর্জন। তাহলে এখন বুঝুন একজন মানুষকে চিনতে হলে কতগুলি ধাপ পার হতে হলো। এতো গেল একজন মানুষের বাহ্যিক রূপ। তার ভালো মন্দ বুঝতে হলে তার সাথে একান্ত ভাবে আন্তরীকতার সাথে মিশতে হেবে। তাকে ভালবাসতে হবে। শ্রদ্ধা ও স্নেহের চোখে দেখতে হবে। তার পরেও পুরোপুরিভাবে চিনতে না পারলেও অনেকটা চেনা যাবে। পুরোপুরিভাবে জানা যাবে তার আখলাখ বা তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর, তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে।
সারকথা হচ্ছে আমি বা আপনি যে একজন মুসলিম তার পরিচয় প্রকাশ পাবে কোরআন হাদিসের আলোকে। আমাদের অর্জিত জীবন পরিচালনার মধ্য দিয়ে। সর্বপরি যিনি এতকিছু নাজ-নিয়ামত দিয়ে আমাদেরকে সৃষ্টি করলেন তাঁর পরিচয় কিভাবে পাবো? তাঁকে চিনতে হলে তাঁর সৃষ্টির মাঝে তাঁকে চেনা যাবে। তাঁর সৃষ্টির মাঝেই পাওয়া যাবে তাঁর পরিচয়। আসুন আমরা কোরআন হদিসের আলোকে জীবন গড়ি। তবেই আমরা ইহলোকে ও পরলোকে সুখে শান্তিতে কাটাতে পারবো।
দ্বিতীয় বিষয় হলো পবিত্রতা। পবিত্রতা সম্পর্কে তিনি যা বুঝাতে চেয়েছেন পবিত্র স্থানে যেতে হলে পবিত্র হয়ে যতে হয়। পবিত্রতা হচ্ছে ঈমানের অঙ্গ। আর ঈমানের ভুষণ বা পোশাক হচ্ছে লজ্জা। কথিত আছে লজ্জা হলো নারীর ভুষণ। কথাটা ঠিক এমন নয়। লজ্জা কেবল নারীর সম্পদ নয়। লজ্জা নারী পুরুষ উভয়ের থাকতে হবে। যার লজ্জা নাই সে এহেন কাজ নাই তা করতে পারে না। কেউ যদি কোন অশ্লীল কাজ করে বসে, তাহলে বলে থাকে তোর কী চোখের পর্দা নেই। আবার এও বলতে শুনা যায় চোখের মাথা খেয়ে বসেছিস নাকি? লজ্জার অপর নাম ভয়। লোকলজ্জার ভয় যার মধ্যে বিরাজমান সে কখনো অন্যায় অসামাজিক কাজে লিপ্ত হতে পারে না। লজ্জাস্থান বলতে সাধরণত শরীরের বিশেষ কোন অঙ্গকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু এর বাইরেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ লজ্জাস্থান তাহলো চোখ যাকে বলা হয়ে থাকে দৃষ্টি। এই দৃষ্টি নামক লজ্জাস্থানটি সুষ্ঠু সংরক্ষণ বা হেফাজত করতে হলে যা করণীয় তাহলো আত্নশুদ্ধি। আর এই আত্নশুদ্ধি করতে কোন আর্থের প্রয়োজন পড়ে না। যা প্রয়োজন তাহলো দুইটি শর্ত মেনে চলতে হবে। শর্ত দু'টি হলো অনুতপ্ত আর অনুশোচনা। তাহলেই আত্নিক পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। আর আত্ন শুদ্ধিই একমাত্র পন্থা যা এনে দিতে পারে আত্নিক পবিত্রতা। শারীরিক পবিত্রতা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আত্নিক পবিত্রতা অতিগুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র আল্ কোরআনের প্রথম সুরা সুরা আল্ ফাতেহা'র প্রতিটি বাক্য বা আয়াতে প্রার্থনার মধ্যদিয়ে আত্নসমর্পনের মাধ্যমে অনুতপ্ত - অনুশোচনার কথাই বলা হয়েছে।
ফুলের সৌরভ যেমন মনকে প্রফুল্ল করে তোলে যা কখনও চোখে দেখা যায় না। তেমনি পবিত্রতার সৌরভে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠে যা কখনও চেখে দেখা যায় না। উপসংহারে ইমাম সাহেব যা বুঝাতে চেয়েছেন বা যা বুঝেছি তাহলো লজ্জা নামক ভুষণ বা পোষাক ঈমানকে আচ্ছাদন করে রাখে যা "ষড়ুরিপু" নামক মানব আত্মার ছয়জন শত্রুর কবল থেকে ঈমান সংরক্ষিত বা হেফাজত থাকবে। আর ঈমান সংরক্ষিত থাকলে ইসলামের বাঁকি অঙ্গগুলিও সংরক্ষণ বা হেফাজত থাকবে। যার মধ্যে সংরক্ষীত থাকবে সুখি সুন্দর জীবন গড়ে তোলার একমাত্র পন্থা ইবাদত। আর এই ইবাদত কেবলমাত্র নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকতের মধ্যে সীমবদ্ধ নয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র, যেমন চাকরী ব্যবসা যে যে পেশায় নিয়োজিত সেটাই তার ইবাদত আর সেই পেশা কোরআন হাদিসের আলোকে ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হলে তবেই পাওয়া যাবে আত্নার প্রশান্তি ও প্রকৃত সুখ। পরিমিত চাহিদার মধ্যে থেকে জীবন পরিচালনা করতে হবে আস্থা আর নিষ্ঠার সাথে।
দু'টি বিষয়ই আমাদের জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে রয়েছে অতি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য। দু'টি পা এর উপর ভর করে যেমন আমরা সামনের দিকে এগিয়ে চলি, তেমনি সচ্ছ নির্মল আত্নিক পবিত্রতা আর পরিচিতি আমাদেরকে পার্থিব ও পরলৌকিক সুখ-শান্তির পথে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ইমাম সহেবের বক্তব্য শুনে চা এর দোকানের সেই পান মোড়ানো কাগজে লেখা সুখের ঠিকানার সেই "তবে......." শব্দটির জট খুলে গেল। আসলে সুখ নিজের হাতের মুঠোয়। সুখের সন্ধানে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অল্পতে যারা খুশি জীবনে তারাই সুখি।
##### সমাপ্ত #####

0 মন্তব্যসমূহ