আপেক্ষিক তত্ত্ব
ড্যানিশ জ্যেতির্বিজ্ঞানী ওলে ক্রিস্টেনসেন রোমা (Ole Christensen Roemer) ১৬৭৬ সালে সর্বপ্রথম আবিষ্কার করেন আলো অনেক বিশাল বেগে চললেও বেগটির কিন্তু একটি সসীম মান আছে। বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহগুলো পর্যবেক্ষণ করলে আপনি দেখবেন, মাঝে মাঝে এরা চোখের আড়ালে চলে যায়, কারণ তখন এরা বিশাল গ্রহটির পেছনে থাকে। মনে করা হয়েছিল যে বৃহস্পতির উপগ্রহদের গ্রহণ (বৃহস্পতির আড়ালে চলে যাওয়া) নির্দিষ্ট সময় পর পর ঘটবে। কিন্তু রোমা খেয়াল করলেন, গ্রহণগুলো নির্দিষ্ট সময় মেনে হচ্ছে না। তাহলে কি উপগ্রহগুলো তাদের কক্ষপথে থাকা অবস্থায় কোনোভাবে গতি বাড়িয় বা কমিয়ে ফেলে? তাঁর কাছে ছিল আরেকটি বিকল্প ব্যাখ্যা। আলো যদি অসীম বেগে চলে, তাহলে পৃথিবীতে বসে আমরা নিয়মিত বিরতিতে গ্রহণ দেখব-ঠিক যে মুহূর্তে তা ঘটবে তখনেই, কসমিক ক্লকের দেওয়া টিকের মতো। যেহেতু আলো যেকোনো দূরত্বই মুহূর্তের মধ্যে পার হয়ে যাবে, তাই বৃহস্পতি পৃথিবীর কাছে আসল কি দূরে গেল তাতে কোনো পার্থক্য তৈরি হবে না।
এবার কল্পনা করুন যে আলো একটি নির্দিষ্ট বেগে চলছে। সে ক্ষেত্রে আমরা প্রতিটি গ্রহণ দেখবা তা ঘটে যাবার কিছু সময় পরে। কতটুকু দেরি হবে তা নির্ভর করবে আলোর বেগ এবং পৃথিবী থেকে বৃহস্পতির দূরত্বের ওপর। বৃহস্পতি থেকে যদি পৃথিবীর দূরত্ব অপরিবর্তিত থাকে তাহলে প্রতিটি গ্রহনের ক্ষেত্রে একই পরিমাণ করে দেরি হবে। কিন্তু বাস্তবে বৃহস্পতি অনকে সময় পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে। এ সময়গুলোতে প্রতিটি গ্রহণের চিত্র আমাদের চোখে পৌঁছতে ক্রমান্বয়ে কম দূরত্ব পাড়ি দিতে হবে। ফলে গ্রহণের দৃশ্য আমাদের চোখে ক্রমান্বয়ে আগের চেয়ে দ্রুত আসবে। উল্টোভাবে বৃহস্পতি যখন পৃথিবী থেকে দূরে সরবে তখন প্রতিটি গ্রহণকে ক্রমান্বয়ে দেরিতে ঘটতে দেখা যাবে। কতটুকু আগে বা পরে গ্রহনের এই দৃশ্য পৌঁছাবে তা নির্ভর করবে আলোর বেগের ওপর। ফলে আমরা আলোর বেগ মাপার উপায় পেয়ে যাচ্ছি। রোমা সাহেব েএ কাজটিই করেছিলেন।
তিনি লক্ষ করলেন, পৃথিবী বৃহস্পতির কক্ষপথের নিকটবর্তী হবার সময় বৃহস্পতির একটি উপগ্রহের গ্রহণ অপেক্ষাকৃত আগে ঘটছে এবং পৃথিবী বৃহস্পতি থেকে দূরে সরার সময় গ্রহণ অপেক্ষাকৃত দেরিতে হচ্ছে। এই পার্থক্য কাজে লাগিয়ে তিনি আলোর বেগ হিসাব করে ফেললেন। অবশ্য তিনি খুব বেশি নিখুঁতভাবে পৃথিবী ও বৃহস্পতির দূরত্বের পরিবর্তন পরিমাপ করতে পারেননি। ফলে তাঁর মাপা আলোর বেগ হয়েছিল সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৪০ হাজার মাইল, যার আধুনিক মান হলো সেকেন্ডে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার মাইল। তবুও আলোর বেগকে সসীম প্রমাণ করা এবং একই সাথে তার মান বের করার ক্ষেত্রে রোমার অর্জনটুকু ছিল বড়ই গুরুত্বপূর্ণ। নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথম্যাটিকা প্রকাশিত হবার দশ বছর আগেই তিনি তার ফলাফল ঘোষণা করেন।
[বৃহস্পতি উপগ্রহদের গ্রহণ কখন দেখা যাবে সেটা একদিকে গ্রহনের সময়ের ওপর নির্ভর করে, আবার বৃহস্পতি থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে কত সময় লাগে তার ওপর নির্ভর করে ফলে বৃহস্পতি যখন পৃথিবীর কাছে আসে, তখন গ্রহণ বেশি বেশি হতে দেখা যায়। আর গ্রহটি পৃথিবী থেকে দূরে যেতে থাকলে গ্রহণ কম চোখে পড়ে।]আলোর চলাচল সম্পর্কে প্রকৃত তত্ত্ব পেতে তবু ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল কিছু বিচ্ছিন্ন তত্ত্বকে জোড়া দিতে সক্ষম হলেন। এই তত্ত্বগুলো সেই সময় পর্যন্ত তড়িৎ চৌম্বক বলের ব্যাখ্যায় ব্যবহৃত হতো। প্রাচীনকাল থেকেই তড়িৎ ও চৌম্বক বলের সাথে মানুষের পরিচয় থাকলেও মাত্র অষ্টাদশ শতকে এসে ব্রিটিশ রসায়নবিদ হেনরি ক্যাভেন্ডিশ ও ফরাসি পদার্থবিদ চার্লস কুলম্ব দুটো চার্জিত বস্তুর মধ্যে ক্রিয়াশীল তড়িৎ বল পরিমাপ করার সূত্র তৈরি করেন। কয়েক দশক পর উনবিংশ শতকের শুরুতে কয়েকজন পদার্থবিজ্ঞানী চৌম্বক বলের জন্যও অনুরূপ সূত্র বানিয়ে ফেলেন। ম্যাক্সওয়েল গাণিতিকভাবে দেখালেন যে কণিকাদের সরাসরি পারস্পরিক ক্রিয়ার কারণে এই তড়িৎ ও চৌম্বক বলের সৃষ্টি হয় না; বরং প্রতিটি তড়িৎ আধান (চার্জ) ও প্রবাহ (কারেন্ট) - এর চারপাশের অঞ্চলে একটি ক্ষেত্র (Field) তৈরি করে। এই ক্ষেত্রই নিকটস্থ অন্য সব আধান ও প্রবাহের ওপর বল প্রয়োগ করে। তিনি দেখলেন যে একটিমাত্র ক্ষেত্রই তড়িৎ চৌম্বক বল বহন করে। অর্থাৎ, তড়িৎ ও চৌম্বক বল আসলে একই বলের অবিচ্ছদ্য রূপ। তিনি এর নাম দিলেন তড়িচ্চুম্বকীয় বল (Electromagnetic force)। আর বল বহনকারী ক্ষেত্রটির নাম দিলেন তড়িচ্চূম্বকীয় ক্ষেত্র।
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকে পূর্বাভাস পাওয়া গেল, তড়িচ্চূম্বকীয় ক্ষেত্রের মধ্যে তরঙ্গের মতো উত্তেজনা (disturbance) দেখা যেতে পারে। এ ছাড়াও এই তরঙ্গ চলবে একটি নির্দিষ্ট গতিতে, অনেকটা পুকুরে সৃষ্ট ঢেউয়ের মতো। এই গতি পরিমাপ করে তিনি দেখলেন এর মান হচ্ছে আলোর বেগের সমান। আজকে আমরা জানি, ম্যাক্সওয়েলের তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৪০০থেকে ৭০০ ন্যানোমিটারের মধ্যে থাকলে তা আমাদের চোখে দৃশ্যমান আলো হিসেবে ধরা দেয়। (ক্রমান্বয়ে চূড়া ও খাঁজ তৈরি হওয়াকে বলে তরঙ্গ, আর চূড়া ও খাঁজগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্বকে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বলে) যেসব তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চেয়ে কম তাদেরকে অতিবেগুনি, এক্স-রে এবং গামা রশ্নি বলে। অন্যদিকে, আরো বড় দৈর্ঘ্যের তরঙ্গকে বেতার (এক মিটার বা তার চেয়ে বড়), মা
ইক্রোওয়েভ (প্রায় এক সেন্টিমিটার) অথবা অবলোহিত বিকিরণ (এক সেন্টিমিটারের এক হাজার ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম কিন্তু দৃশ্যমান পাল্লার চেয়ে বড়) বলে।

ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব থেকে বোঝা গেল, বেতার বা আলোক তরঙ্গ একটি নির্দিষ্ট গতিতে চলবে। পরম আদর্শ স্থির বস্তু বলতে কিছু নেই-নিউটনের এই বক্তব্যের সাথে এই কথাকে ঐকতানে আনা কঠিন হয়ে গেল। কারণ এমন কোনো আদর্শ না থাকলে একটি বস্তুর গতির ব্যাপারে সবাই একমত হতে পারবে না। এটি কেন হয় বুঝতে হলে আবারও মনে করুন আপনি ট্রেনের মধ্যে পিং-পং খেলছেন। আপনি ট্রেনের সামনের দিকে বলটিকে ছুড়ে দিলেন। আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে যদি এর বেগ ঘন্টায় দশ মাইল হয়, তাহলে আপনি আশা করবেন যে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো কোনো পর্যবেক্ষক বলটিকে ঘন্টায় একশ মাইল বেগে যেতে দেখবে। এর মধ্যে দশ হচ্ছে ট্রেনের সাপেক্ষে বেগ এবং নব্বই হচ্ছে প্ল্যাটফর্মের সাপেক্ষে ট্রেনের নিজস্ব বেগ। বলের গতিবেগ আসেল কত, ঘন্টায় দম মাইল নাকি একশ মাইল? আপনি একে কার সাপেক্ষে বলবেন-ট্রেনের নাকি পৃথিবীর? পরম আদর্শ স্থির বস্তু বলে কিছু না থাকলে আপনি বলটির জন্য কোনো পরম গতি নির্ধারণ করতে পারবেন না। একইভাবে আপনি কার সাপেক্ষে বলছেন তার ওপর ভিত্তি করে ঐ একই বলের গতি যেকোনো কিছু হতে পারে। নিউটনের তত্ত্ব সত্য হলে একই নীতি মানতে হবে আলোকেও। তাহলে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বে আলোক তরঙ্গের বেগ নির্দিষ্ট থাকার কী অর্থ?

[আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, কারো মত অন্য কারো সাথে যদি নাও মেলে, তবুও প্রত্যেকেরই নিজস্ব মত সঠিক।]
ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বকে নিউটনের সূত্রের সাথে সন্ধি করানোর জন্য ইথার নামক একটি বস্তু কল্পনা করা হলো। ধরে নেওয়া হলো যে এটি সব জায়গায় উপস্থিত। এমনকি এটি আছে শূন্য স্থানেও। বিজ্ঞানীরা এই ইথারের ধারণাকে লুফে নিলেন। তাঁরা ভাবলেন, যেমনি করে জল তরঙ্গের জন্য পানি বা শব্দ তরঙ্গের জন্য বাতাস দরকার, তেমনি তড়িচ্চুম্বকীয় শক্তির প্রবাহের জন্যও একটি মাধ্যমের প্রয়োজন। এই মত অনুসারে, শব্দ তরঙ্গ যেভাবে বাতাস বেয়ে চলে তেমনি আলোক তরঙ্গ চলে ইথার বেয়ে। ফলে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ থেকে প্রাপ্ত আলোর বেগকে ইথারের সাপেক্ষে বিবেচনা করতে হবে। ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষক আলোকে ভিন্ন বেগে আসতে দেখতে ঠিকই, কিন্তু ইথারের সাপেক্ষে এর বেগ থাকবে একই।
এই মতের পরীক্ষা নেওয়া যেত। মনে করুন, একটি উৎস থেকে আলো নির্গত হলো। ইথার তত্ত্ব অনুসারে, আলো এর নিজস্ব বেগে ইথার ভেদ করে চলে। আপনি ইথারের মধ্য দিয়ে আলোর দিকে যেতে থাকলে, আলোর দিকে আপনার গতিবেগ হবে ইথারে আলোর বেগ ও ইথারে আপনার নিজস্ব বেগের যোগফলের সমান। আপনি স্থির থাকলে বা অন্য কোনো দিকে গেলে আলোর বেগ যা হতো, এ ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি হবে। কিন্তু আমরা কোনো আলোক উৎসের দিকে সর্বোচ্চ যে বেগে যেতে পারি তার তুলনায় আলোর বেগ অনেক বেশি হওয়ায় বেগের এই পার্থক্য পরিমাপ করা সহজ কাজ ছিল না।
১৮৮৭ সালে অ্যালবার্ট মাইকেলসন (যিনি পরে প্রথম আমেরিকান হিসেবে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পান) ও এডওয়ার্ড মর্লি নিবিড় যত্নের সাথে একটি কঠিন পরীক্ষা পরিচালনা করেন। পরীক্ষার স্থান ছিল ক্লিভল্যান্ডের কেইস স্কুল অব অ্যাপ্লাইড সায়েন্স (বর্তমানে এর নাম কেইস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটি)। তাঁরা বুঝতে পারলেন, যেহেতু পৃথিবী এর কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে সেকেন্ডে প্রায় বিশ মাইল বেগে ঘুরছে, তাহলে তাদের পরীক্ষাগারও ইথারের মধ্য দিয়ে অপেক্ষাকৃত বেশি বেগে ছুটবে। কিন্তু কেউই জানতা না কোন দিকে বা কত গতিতে ইথার সূর্যের সাপেক্ষে গতিশীল অথবা আদৌ এটি গতিশীল কি না। কিন্তু বছরের বিভিন্ন সময়ে পৃথিবী এর কক্ষপথের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে (এবং ভিন্ন দিকে গতিশীল) থাকায় একই পরীক্ষা বারবার করার মাধ্যমে এই অজানা বিষয়টি জেনে ফেলার আশা ছিল। এই উদ্দেশ্যে মাইকেলসন ও মর্লি সাহেব পরীক্ষাটিকে এভাবে সাজালেন-ইথারের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর গতির দিকে (যখন আমরা আলোক উৎসের দিকে গতিশীল) প্রাপ্ত আলোর বেগকে এই গতির সমকোণের দিকে (যখন আমরা উৎসের দিকে গতিশীল নই) আলোক বেগের সাথে তুলনা করতে হবে। বিস্ময়ের সাথে তাঁরা লক্ষ করলেন, উভয় দিকেই আলোর বেগ ঠিক একই!
১৮৮৭ থেকে ১৯০৫ সাল। ইথার তত্ত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্ট কম করা হলো না। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা ছিল ডাচ পদার্থবিজ্ঞানী হেনড্রিক লরেন্টজের। তিনি মাইকেলসন-মর্লি পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফলের ব্যাখ্যা দেবার জন্য বললেন, ইথারের মধ্য দিয়ে চলার সময় বস্তুর দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে যায় ও ঘড়ি ধীরে চলে। কিন্তু ১৯০৫ সালে সুইশ প্যাটেন্ট অফিসের একজন অখ্যাত ব্যক্তি একটি বিখ্যাত গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন। ব্যক্তিটি আর কেউ নন, স্বয়ন আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি বললেন, আমরা যদি পরম সময়ের ধরণ বাদ দিতে রাজি হই, তাহলে ইথারের কোনো প্রয়োজনই পড়ে না (আমরা একটু পরই এর কারণ দেখব।) কয়েখ সপ্তাহ পরে বিখ্যাত ফরাসি গণিতবিদ অঁরি পয়েনকেয়ার একই রকম কথা বললেন। পয়েনকেয়ারের চেয়ে আইনস্টাইনের যুক্তিগুলো পদার্থবিদ্যার মূলনীতির বেশি কাছাকাছি ছিল। পয়েনকেয়ার সমস্যাটিকে নিতান্তই গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছিলেন। এমনকি তিনি তাঁর জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্তও আইনস্টাইনের ব্যাখ্যা মেনে নেননি।
আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্ত্বের মৌলিক স্বীকার্যে বললেন, যেকোনো বেগে মুক্তভাবে গতিশীল সকল পর্যবেক্ষকের জন্য বিজ্ঞানের সূত্রগুলো একই থাকবে। নিউটনের গতি সূত্রের জন্যও এটি সঠিক ছিল। কিন্তু আইনস্টাইন একে আরেকটু লম্বা করে এতে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বও নিয়ে এলেন। অন্য কথায়, যেহেতু ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব বলছে আলোর বেগের একটি নির্দিষ্ট মান আছে, অতএব মুক্তভাবে গতিশীল সকল পর্যবেক্ষক একই মান পাবেন। এ ক্ষেত্রে তারা কত বেগে উৎস থেকে দূরে যাচ্ছেন বা কাছে আসছেন তা মোটেই বিবেচ্য নয়। এই সাধারণ বক্তব্যের মাধ্যমে ইথার বা অন্য কোনো পছন্দনীয় প্রসঙ্গ কাঠামোর ব্যবহার করা ছাড়াই ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণের অর্থ স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হলো। এর অনেকগুলো সুদূরপ্রসারী ভূমিকা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা ছিল স্বাভাবিক বুদ্ধির বিপরীত।
যেমন, সকল পর্যবেক্ষক যদি আলোর বেগ একই মাপেন তাহলে আমাদেরকে সময়ের ধরণা পাল্টে ফেলতে হয়। গতিশীল ট্রেনের কথা আবার একটু ভাবুন। চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা দেখেছি, কেউ ট্রেনের মধ্যে পিং-পং বলকে ওপরে ও নিচে বাউন্স করিয়ে এদেরকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি নড়তে দেখলেও প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো কেউ বলটিকে প্রায় চল্লিশ মিটার যেতে দেখবে। একইভাবে ট্রেনে থাকা পর্যবেক্ষক কোনো আলো জ্বালালে আলোর অতিক্রান্ত দূরত্ব সম্পর্কেও দুই পর্যবেক্ষক ভিন্ন মত দেবেন। আমরা জানি, দূরত্বকে সময় দ্বারা ভাগ দিলে বেগ পাওয়া যায়। তাহলে তাদের দুজনের মাপা দূরত্ব যদি ভিন্ন হয়, সে ক্ষেত্রে তাদের উভয়ের পরিমাপকৃত আলোর বেগ একই হতে হলে তাদের দুজনের মাপা সময়ও ভিন্ন হতে হবে। অর্থাৎ, আপেক্ষিক তত্ত্ব আমাদের মাথা থেকে পরম সময়ের ভাবনা সরিয়ে ফেলতে চায়। বরং প্রত্যেক পর্যবেক্ষক তাঁর ঘড়িতে সময়ের জন্য নিজস্ব একটি মান পাবেন। একই রকম ঘড়ি দিয়ে সময় মেপেও অন্য কেউ একই মান নাও পেতে পারেন।
আপেক্ষিক তত্ত্ব মেনে নিলে ইথার নামক কোনো কিছুর উপস্থিতির প্রয়োজনই নেই। মাইকেলসন-মর্লি পরীক্ষায় এই ইথারের কোনো অস্তিত্ব ধরা পড়েনি। বরং আপেক্ষিক তত্ত্বের দাবি হলো, স্থান ও কাল সম্পর্কে আমাদের মৌলিক ধারণাটিই পাল্টে ফেলতে হবে। আমাদেরকে মেনে নিতে হবে যে, ‘কাল’ ‘স্থান’ থেকে একেবারে আলাদা ও স্বতন্ত্র নয়। দুটো একত্রে মিলেমিশে তৈরি করেছে স্থান-কাল নামে একটি জিনিস। এই ধারণাগুলো বুঝে নেওয়া একটু কঠিনই বটে। পদার্থবিজ্ঞানীরাও আপেক্ষিক তত্ত্বকে মেনে নিতে অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছিলেন। আইনস্টাইন আগেভাগেই এটি বুঝে ফেলার মাধ্যমে তাঁর উন্নত কল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। নিজের যুক্তির প্রতি আত্মবিশ্বাস তাঁকে সেই যুক্তিগুলোর ফলাফল বের করতে উদ্বুদ্ধ করে, যদিও সেই ফলাফল নিয়ে যাচ্ছিল অদ্ভুত কিছু সিদ্ধান্তের দিকে।
আমরা সবাই জানি, কোনো স্থানের একটি বিন্দুর অবস্থান বোঝানোর জন্য আমরা তিনটি সংখ্যা বা স্থানাঙ্ক ব্যবহার করি। যেমন আমরা হয়তো বলতে পারি, কোনো কক্ষের একটি বিন্দু কোনো একটি দেয়াল থেকে ৭ মিটার দূরে আছে, অপর একটি দেয়াল থেকে ৩ মিটার এবং মেঝে থেকে ৫ মিটার ওপরে আছে। অথবা আমরা বলতে পারি এভাবে-একটি বিন্দু একটি নির্দিষ্ট অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে এবং সমুদ্র স্তর থেকে একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় আছে। আমরা আমাদের সুবিধামতো যেকোনো তিনটি স্থানাঙ্ক ব্যবহার করতে পারি। অবশ্য এই স্থানাঙ্কদের গ্রহণযোগ্যতার একটা সীমারেখা আছে।
চাঁদের অবস্থানকে পিকাডিলি সার্কাসের পশ্চিম ও উত্তর এবং সমুদ্র স্তর থেকে উচ্চতার মাধ্যমে বোঝানো হলে তা অবশ্যই বাস্তবসম্মত হবে না। এ ক্ষেত্রে বরং আমরা এ রকম তিনিটি স্থানাঙ্ক ব্যবহার করতে পারি: এক. সূর্য থেকে এর দূরত্ব। দুই, গ্রহদের কক্ষীয় তল থেকে দূরত্ব এবং তিন, সূর্য ও চাঁদের সংযোজক রেখা এবং সূর্য ও কাছাকাছি থাকা অন্য কোনো রক্ষত্র যেমন প্রক্সিমা সেন্টোরির সংযোজক রেখা দুইটি দ্বারা উৎপন্ন কোণ। আবার আমাদের গ্যালাক্সিতে সূর্যের অথবা লোকাল গ্রুপে আমাদের গ্যালাক্সির অবস্থান বর্ণনা করতে গেলে এই স্থানাঙ্কগুলোও কাজে আসবে না। সত্যি বলতে পরস্পরকে ছেদ করা অনেকগুলো দাগের মাধ্যমে আমরা পুরো মহাবিশ্বের অবস্থান নির্দেশ করতে পারি। সেক্ষেত্রে একটি বিন্দুর অবস্থান বোঝানোর জন্য প্রতিটি দাগে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানাঙ্ক বসাতে হবে।
স্থানের তিনটি মাত্র (Dimension) আছে বলতে আমরা বুঝি একটি বিন্দুর অবস্থান নির্দেশ করতে আমরা তিনটি সংখ্যা বা স্থানাঙ্ক ব্যবহার করি। এর সাথে সময় যোগ করলে স্থান-কাল পরিণত হয়।
নির্দিষ্ট কোনো স্থান ও সময়ে ঘটা কোনো ঘটনাকে আপেক্ষিক তত্ত্বের স্থান-কালে চারটি সংখ্যা বা স্থানাঙ্ক দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এখানেও স্থানাঙ্কের ব্যবহার নির্ভর করে ইচ্ছার ওপর। আমরা সময়ের সাথে স্থানের যেকোনো তিনিটি সুসংজ্ঞায়িত স্থানাঙ্ক ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে স্থান ও কালের স্থানাঙ্কের মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই। স্থানের যেকোনো দুটি স্থানাঙ্কের মধ্যে যেমন সত্যিকারের কোনো পার্থক্য থাকে না ব্যাপারটা ঠিক তেমনই। আমরা চাইলে নতুন একগুচ্ছ স্থানাঙ্ক ব্যবহার করতে পারি। যেমন স্থানের প্রথম স্থানাঙ্কটি বানানো হবে স্থানের আগের স্থানাঙ্কের প্র্রথম ও দ্বিতীয় স্থানাঙ্কের সমন্বয়ে। তাহলে পৃথিবীতে কোনো বিন্দুর অবস্থান বোঝানোর জন্য জায়গাটি পিকাডিলি থেকে কত মাইল উত্তরে ও পশ্চিমে আছে তা না বলে আমরা বলতে পারি এটি পিকাডিলি থেকে কত মাইল উত্তর-পূর্ব ও কত মাইল উত্তর-পশ্চিমে আছে। একইভাবে আমরা সময়ের জন্য নতুন স্থানাঙ্ক ব্যবহার করতে পারি। আগের সময়ের (সেকেন্ডের হিসাবে) সাথে পিকাডিলির উত্তর দিকের দূরত্ব সমন্বিত করে এটা তৈরি করা যেতে পারে। এই দূরত্বের একক হতে পারে আলোক সেকেন্ড।
আপেক্ষিক তত্ত্বের আরেকটি সুপরিচিত ফলাফল হলো ভর ও শক্তির সমতুল্যতা। আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 এদের মধ্যে সম্পর্ক নির্দেশ করে। এখানে E হল শক্তি, m হলো ভর এবং c হলো আলোর গতিবেগ। অল্প কিছু ভরকে বিশুদ্ধ তড়িতচুম্বকীয় বিকিরণে রূপান্তরিত করলে কী পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে না বের করতে এই সূত্র খুব বেশি কাজে লাগে। আলোর বেগের মান অনকে বড় একটি সংখ্য হওয়ায় পদার্থকে শক্তিতে রূপান্তর করে বিপুল পরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়। হিরোশিমা শহরকে ধ্বংস করেছে যে বোমা তাতে ভর ছিল এক আউন্সেরও কম। কিন্তু সূত্রটি থেকে আমরা আরও জানতে পারছি যে বস্তুর শক্তি বাড়তে থাকলে এর ভরও বেড়ে যায়। আর ভর বাড়লেই কিন্তু ত্বরণ (বেগ বৃদ্ধি) বাধাপ্রাপ্ত হয়।
শক্তির একটি রূপ হচ্ছে গতিশক্তি। একটি গাড়িকে গতিশীল করতে যেমন শক্তির প্রয়োজন হয়, তেমনি যেকোনো বস্তুর গতি বাড়াতেই শক্তির প্রয়োজন। বস্তুকে গতিশীল করতে যে শক্তি খরচ করতে হয়, গতিশীল বস্তুর গতিশক্তির সাথে তার আদৌ কোনো পার্থক্য নেই। এর ফলে বস্তু যত বেশি দ্রুত চলে, ততই এর গতিশক্তি বেড়ে যেতে থাকে। কিন্তু ভর ও শক্তির সমতুল্যতা অনুসারে গতিশক্তি বাড়ার কারণে বস্তুর ভরও বেড়ে যায়। এ কারণে একটি বস্তু যত বেশি দ্রুত চলে, তার গতি আরও বৃদ্ধি করা ততই কঠিন হয়ে পড়ে।
আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে চলা বস্তুর ক্ষেত্রে এই প্রভাব সত্যিই লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। যেমন, আলোর ১০ শতাংশ গতিতে চলা বস্তুর ভর স্বাভাবিকের চেয়ে মাত্র ০.৫ শতাংশ বেশি হবে। কিন্তু আলোর ৯০ শতাংশ গতিতে চলা বস্তুর ক্ষেত্রে ভর স্বাভাবিকের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি হবে। আলোর গতির কাছাকাছি যেতে থাকলে ভর আরও বেশি বাড়তে থাকে। ফলে বেগ আরও বাড়তে তুলনামূলক আরও বেশি শক্তির প্রয়োজন হয়। আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে একটি বস্তু কখনোই আলোর সমান গতি অর্জন করতে পারবে না। কারণ ততক্ষণে এর ভর হয়ে যাবে অসীম। আর ভর ও শক্তির সমতুল্যতা অনুসারে আলোর গতি অর্জন করতে হলে খরচ করতে হবে অসীম পরিমাণ শক্তি। এই কারণেই যেকোনো সাধারণ বস্তু সব সময় আলোর চেয়ে অল্প গতিতে চলতে বাধ্য হয়। আলো বা যেসব তরঙ্গেদের অভ্যন্তরীণ কোনো ভর নেই, তারাই কেল আলোর সমান গতিতে চলতে পারে।
১৯০৫ সালে প্রকাশিত হয় আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব। একে বিশেষ বলার কারণ হচ্ছে, সকল পর্যবেক্ষকের কাছে আলোর বেগ কেন একই থাকে এবং আলোর কাছাকাছি গতিতে চললে কী ঘটবে এটি তা ব্যাখ্যা করতে পারলেও নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্রের সাথে েএর বনিবনা হচ্ছিল না। নউটনের তত্ত্ব বলছে, কোনো একটি মুহূর্তে বস্তুরা একে অপরের সাথে যে বলের মাধ্যমে আকৃষ্ট হয় তা এদের সেই মুহূর্তের দূরত্বের ওপর নির্ভরশীল। এর অর্থ হবে, আপনি একটি বস্তুকে সরিয়ে দিলে আরেকটির ওপর এর দ্বারা ক্রিয়াশীল বল সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে। যেমন ধরুণ, হঠাৎ করে সূর্য উধাও হয়ে গেল। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা জানি আরও আট মিনিট পৃথিবী আলোকিত থাকবে (কারণ সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে এটুকু সময়ই লাগে)। কিন্তু নিউটনের মহাকর্ষীয় সূত্র অনুসারে সূর্য উধাও হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবী সূর্যের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলবে এবং কক্ষপথ থেকে ছিটকে দূরে চলে যাবে। অর্থাৎ, সূর্য উধাও হয়ে যাবার মহাকর্ষীয় প্রভাব আমাদের কাছে চলে আসবে অসীম গতিতে। কিন্তু আলোর চেয়ে বেশি এই গতি বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্বকে মহাকর্ষীয় তত্ত্বের সাথে জোড়া লাগাতে আইনস্টাইন ১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে অনকেগুলো প্রচেষ্টা চালান। ব্যর্থ হন তাঁর প্রতিটিতেই। শেষ পর্যন্ত ১৯১৫ সালে তিনি এর চেয়ে বড় বৈপ্লবিক তত্ত্ব নিয়ে আসেন। একেই এখন আমরা জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা সার্বিক (বা সাধারণ) আপেক্ষিক তত্ত্ব বলি।
0 মন্তব্যসমূহ