পানাহারের আদব
কোনো কিছু পানাহারের পূর্বে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম এবং খাওয়ার পর আলহামদুলিল্লাহ বলিবে। কেননা, যে কাজ আল্লাহর নাম লইয়া করা হয় এবং কাজ সমাধা করার পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা হয় উহাতে বরকত হয় এবং শয়তান দূরে পালায়ন করে। বর্ণিত আছে- সাহাবাগণ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনার নিকট আসিয়া আরয করলেন- হে আল্লাহর রাসুল। প্রচুর পরিমাণে খাওয়া স্বত্বেও আমাদের পেট ভরে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিলেন, সম্ভবত তোমরা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আহার করো। তাহা না করিয়া সকলে একত্রে বসিয়া বিসমিল্লাহ্ বলিয়া আহার করিও। এমন করিলে খাবার বস্তুতে বরকত হবে এবং তোমরা তৃপ্তি লাভ করিবে।
হযর জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) হতে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন - লোক যখন গৃহে প্রবেশ করার এবং পানাহার করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে, শয়তান তখন তাহার চেলাদিগকে বলে আজ তোমরা রাতে না এই বাড়ীতে থাকিতে পারিবে আর না গৃহবাসীদের রাত্রের খাবারে অংশগ্রহণ করিতে পারিবে, এখান হইতে চলিয়া যাও। আর আল্লাহর নাম স্মরণ না করিলে শয়তান তাহার চেলাদিগকে বলে, আজ রাতে তোমরা এই গৃহে থাক এবং গৃহবাসীদের সাথে খাবারে অংশগ্রহণ কর।
হযরত হোযায়ফা (রা:), বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আহারের সময় আমরা উপস্থিত হইতাম এবং তাঁহার সাথে খাবারে অংশগ্রহণ করিতাম। যতক্ষণ পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবারের পাত্রে হাত না দিতেন আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতাম। একদিন খাবারের সময় আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। ইত্যবসরে একজন গ্রাম্য আরব সকলকে ঠেলা ধাক্কা দিয়া খাবারের পাত্রের দিকে হাত বাড়াইল! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহার হাত ধরিয়া ফেলিলেন। ঠিক তেমনি ভাবে একটি মেয়ে আসিয়াও খাবারে পাত্রে হাত দিতে চাহিলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহার হাতও ধরিয়া ফেলিলেন। অতপর তিনি এরশাদ করিলেন- যে খাবারের উপর বিসমিল্লাহ বলা না হয় সে খাবার শয়তান নিজের জন্য হালাল মনে করিয়া থাকে। শয়তান এই গ্রাম্য আরব এবং এই মেয়েটিকে লইয়া আসিয়াছে যে ইহাদের সাথে মিলিত হইয়া আহার করবে। এই জন্যই আমি তাহাদের হাত ধরিয়া রাখিয়াছি। অতপর তিনি বলিলেন - যে খোদার আয়ত্বে আমার জীবন তাহার শপথ, এই দুই জনের হাতের সাথে শয়তানের হাতও আমার মুষ্ঠিবদ্ধ। খাবারের সময় কেহ বিসমিল্লাহ বলিতে ভুলিয়া গেলে - যখনই স্মরণ হইবে তখনই বলিবে বিসমিল্লাহি আউয়ালিহি ও আখেরিহি।
হযরত আয়েশা (রা:), বলেন- খাওয়ার আরম্ভ ও শেষ লবণ দ্বারা করিবে। ডানহাতে ছোট গ্রাস তুলিবে, ভালভাবে চর্বন করিয়া আস্তে আস্তে গলাগ্ধকরণ করিবে। আহার্য বস্তুর একদিক হইতে খাওয়া আরম্ভ করিবে। খাবার বা পানির পাত্রে ফুক দিবে না আহারের সময় শ্বাস বন্ধ হইয়া আসিলে পাত্র হইতে মুখ সরাইয়া লইবে, শ্বাস গ্রহণ করত পুনরায় পানাহার করিতে আরম্ভ করিবে। কোনো কিছুতে হেলান না দিয়া বরং বসিয়া পানাহার করিতে আরম্ভ করিবে। স্বর্ণ বা চাঁদির পাত্রে পানাহার করা না জায়েজ। স্বর্ণ বা চাঁদির কালাই করা পাত্রে পানাহার করাও নিষিদ্ধ। এমন পাত্রে খাদ্য দ্রব্য আনিলে উহা অন্য পাত্রে উঠাইয়া খাইবে এবং এমন ব্যক্তিকে এরূপ কাজ করিতে নিষেধ করিয়া দিবে। স্বর্ণ বা চাঁদির গোলপদানী ব্যবহার করাও দোষণীয়। যেখানে এরূপ না জায়েজ বস্তুর সমাবেশ হয় সেখানে খাইবে না। ঘটনাক্রমে উপস্থিত হইলেও সেখান হইতে ফিরিয়া আসিবে এবং গৃহ স্বামীকে এইসব বস্তু ব্যবহার না করিবার জন্য উপদেশ দান করিবে। ভদ্রতার সাথে গৃহ স্বামীকে বলিবে। যে বস্তু না জায়েজ এবং হারাম উহা ব্যবহার করিও না-ইহার পরিণতি কখনও ভালো হইতে পারে না। এই সম্বন্ধে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন-যে ব্যক্তি স্বর্ণ বা চাঁদির বাসনে বা স্বর্ণ বা চাঁদিয়া কালাই করা পাত্রে পানাহার করে সেই ব্যক্তি দোযখের অগ্নি দ্বারাই তাহার পেট ভর্তি করিয়া থাকে।
খাবার পরে পাত্রে যাহা কিছু লাগিয়া থাকে উহা ভালোভাবে সাফ করিয়া খাবে। যাহাদের সাথে খাইতে বসিবে তাহাদের পদ মর্যাদা অনুযায়ী তাহাদের সাথে কথাবার্তা বলিবে। দুনিয়াদারের সাথে খাইতে বসিলে তাহাদের শিষ্ট ব্যবহার করিবে দরবেশের সাথে বসিলে তাহাদের আদব রক্ষা করিবে। বন্ধু-বান্ধবকে প্রশস্ত হাতে খাবার দিবে। আলেমদের সাথে খাইতে বসিলে তাহাদের নিকট শিষ্টতা শিক্ষা করিবে। অন্ধ ব্যক্তিকে প্রত্যেকটি খাবার বস্তুর গুণাগুণ বর্ণনা করিবে যেন সে কোনো কিছু হইতে বঞ্চিত না থাকে।
বিবাহের দাওয়াতে উপস্থিত হওয়া মুস্তাহাব। ইচ্ছা হইলে খাইবে অন্যথায় ফিরিয়া আসিবে এবং নতুন দম্পত্তির জন্য দোয়া করিবে। হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা:) হইতে বর্ণিত আছে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন-যে ব্যক্তি দাওয়াত গ্রহণ না করে সে আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের নাফরমানী করে। আর যে বিনা দাওয়াতে যায় সে চোর হইয়া প্রবেশ করেএবং ডাকাত হইয়া বহির্গত হয়। যেখানে বেশরীয়তী কোনো কাজ হয় না সেখানে উক্ত হাদিস প্রয়োজন। এমন স্থানে উপস্থিত হইলে সেখান হইতে চলিয়া আসিবে। ঢোল-ডগর, বাঁশি, নাচ, গান ইত্যাদি বেশরীয়তি কাজ। বিবাহের সময় শুধু দফ বাজানো জায়েজ।
হযরত শিবলীর নিকট লোকে জিজ্ঞাসা করিল গান শোনা কি জায়েজ। তিনি উত্তর করিলেন-গান এমন বস্তু যাহা মানুষকে গোমরাহীর দিকে ধাবিত করে। খাতনার দাওআত করা মোস্তাহাব নয়। এমন দাওয়াতে যাওয়াও ওয়াজিব নহে। পথে পাওয়া জিনিস উঠাইলে হীনতা প্রকাশ পায়। যে সমস্ত ভোজে গরীবদিগকে শরীক করা না হয় সে সমস্ত ভোজে উপস্থিত হওয়া মাকরুহ। কিন্তু বিবাহের দাওয়াতে গরীবও অভাবগ্রস্থকে দাওয়াত না করিলেও খাওয়া দোষনীয় নহে।
গৃহ স্বামীর গোপন কথায় কান দিবে না বা তাহার ঘরের আসবাব পত্রের দিকে বারবার দৃষ্টিপাত করিবেনা। উপস্থিত কাহাকেও বিরক্ত করিবেন না বা লোকের খাওয়ার দিকে তাকাইয়া থাকিবে না। গৃহস্বামী যাহা দিবে তাহাই খাবেই-উহার প্রতি অবহেলা করিবে না যে কথায় লোকে শরম পায় বা হাসে এমন কথা বলিবে না কেননা হাসির চোটে মুখের গ্রাস গলায় আটকাইয়া যাইতে পারে। খাওয়ার আগে পরে হাত ধোওয়া মুস্তাহাব। কাঁচা পেয়াজ, রসুন, ধনিয়া খাইবে না কেননা, দুর্গন্ধের জন্য উহা কাঁচা খাওয়া মাকরূহ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, যে এই সব দুর্গন্ধময় বস্তু খায় সে যেন আমাদের মসজিদে না আসে। মুখ হইতে বাহির করিয়া কোনো বস্তু পেয়ালায় রাখিবেনা এবং খাবার সময় খেলাল করিবে না এই উভয় কাজ মাকরূহ। খাবার বস্তুকে খারাপ বলা মেজবানের পক্ষে জায়েজ নহে। কেননা ইহাতে প্রথম পক্ষের হীনতা এবং দ্বিতীয় পক্ষের অজ্ঞতা প্রকাশ পায়। বর্ণিত আছে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাবার বস্তু সম্পর্কে ভাল মন্দ কোনো মতামতই প্রকাশ করিতেন না।
আমার জন্য অমুক খাদ্য তৈয়ার করো এরূপ আদেশ দেওয়া মেহমানের পক্ষে অনুচিত। যাহা দিবে তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকিবে। আদেশ দিলে মেজবানের পক্ষে বোঝা স্বরূপ হয় এবং সে দ্বিধাগ্রস্থ হইয়া পড়ে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন-আমি এবং আমার পরহেযগার উম্মতগণ লৌকিকতার প্রতি অসন্তুষ্ট। অবশ্য মেজবান যদি মেহমানের নিকট খাবার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে তবে দোষণীয় নহে। খাবার বস্তুর উপর মাছি বসিলে উহাকে খাবার বস্তুর মধ্যে ডুবাইয়া ছাড়িয়া দিবে। মাছি খাবার বস্তুতে পড়িয়া গেলে খাবার বস্তু খাওয়া দোষণীয় নহে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলিয়াছেন-তোমাদের খাদ্য বস্তুতে মাছি বসিলে উহাকে ডুবাইয়া ছাড়িয়া দাও। ঢক ঢক করিয়া পানি পান করিবে না। চুষিয়া চুষিয়া পান কর। পানি পান করিবার সময় মুখ হইতে তিনবার পানির পাত্র সরাইয়া শ্বাস গ্রহণ করিবে। পাত্র পৃথক না কলে পানিতে নিশ্বাস পড়ে। নিশ্বাস বা ফুক দেওয়া পানি পান করা মাকরূহ। পান করার পূর্বে বিসমিল্লাহ এবং পরে আলহামদুলিল্লাহ বলিবে।
মোট কথা পানাহারের মধ্যে বারটি আদব। উহার মধ্যে চারটি ফরয, চারটি সুন্নত এবং চারটি মুস্তাহাব।
ফরজ চারটি- বাম পায়ে ভর দিয়ে বসা, তিন আঙ্গুল দ্বারা খাওয়া, সম্মুখের দিক হইতে খাওয়া আরম্ভ করা এবং আঙ্গুল চাটিয়া খাওয়া। মুস্তাহাব চারটি- ছোট গ্রাস লওয়া ও ভালভাবে চিবাইয়া খাওয়া। মানুষের মুখের দিকে কম দৃষ্টিপাত করা, রুটি দস্তরখানে রাখিয়া উহার উপর তরকারী রাখিয়া খাওয়া এবং কোনো কিছুতে হেলান না দিয়া স্বাভাবিক ভাবে বসিয়া খাওয়া।

0 মন্তব্যসমূহ